কক্সবাজারের ডিসিকে হাইকোর্টে তলব
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ছবি: জয়দীপ্তা দেব চৌধুরী

সালিশকারী নিয়োগের নীতিমালা তৈরির নির্দেশ

সালিশ প্রক্রিয়ায় সালিশকারী (আরবিট্রেটর) নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, একটি গাইডলাইন (নীতিমালা) তৈরি করে প্রধান বিচারপতির অনুমোদনক্রমে নির্দেশনা আকারে কার্যকর করতে হবে, যাতে সারা দেশের জেলা জজরা তা অনুসরণ করতে পারেন। একই সঙ্গে এ মামলার সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে ভবিষ্যতে সালিশকারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অবৈধভাবে সালিশকারী নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে দেওয়া রায়ে এ নির্দেশনা এসেছে। বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছেন।

এর আগে গত ১৪ মার্চ হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে রুল জারি করেন। রুলে মামলার বাদীপক্ষ থেকে মনোনীত সালিশকারী অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মুজিবুল কামালের পরিবর্তে মঞ্জুরুল বাসিতকে সালিশকারী নিয়োগ করে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের গত ১৫ জানুয়ারি দেওয়া আদেশ কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

একই সঙ্গে কোন কর্তৃত্ববলে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ মামলার আবেদনকারীর পক্ষ থেকে মনোনীত সালিশকারী (আরবিট্রেটর) পরিবর্তন করেছেন, তা জানতে চান। পাশাপাশি নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ সালিশি মামলাগুলোতে কাদের সালিশকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, তারও তালিকা দাখিল করতে বলেন।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজকে ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে এ তথ্য দাখিল করতে বলা হয়। এরপর এ বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ১১ মে হাইকোর্ট রায় দেন। সম্প্রতি এ রায়ের ১১ পৃষ্ঠার একটি অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, আমরা ঢাকার জেলা জজের কাছ থেকে ব্যাখ্যা তলব করেছিলাম। কিন্তু আমরা তার ব্যাখ্যা থেকে যা পেয়েছি, তাতে সে তার নিয়োগের সঠিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেছে।

রায়ে আরও বলা হয়েছে, আদেশের দ্বিতীয় অংশে আমরা ঢাকার জেলা জজ হিসেবে তার নিয়োগ পাওয়ার দিন থেকে আরবিট্রেটর নিয়োগের তালিকা চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তার আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা সুনির্দিষ্ট না করে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা সরবরাহ করেছে। এটা স্পষ্ট যে, জেলা জজ রুল জারির সময় দেওয়া দুটি আদেশেরই বিচ্যুতি করেছে।

জানা যায়, সুবাস্তু ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পরিচালকদের একটি বিরোধ সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার চুক্তি রয়েছে। এখানে সুবাস্তু ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পক্ষ থেকে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. মুজিবুল কামালকে সালিশকারী নিয়োগ করা হয়। অন্যপক্ষ ৩০ দিনের মধ্যে সালিশকারী নিয়োগ না করায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন করা হয়।

এরপর গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত অন্যপক্ষে সালিশকারী নিয়োগের পাশাপাশি সুবাস্তু ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পক্ষ থেকে নিযুক্ত সালিশকারীকে পরিবর্তন করে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মঞ্জুরুল বাসিতকে সালিশকারী নিয়োগ করেন।

এটা আইনের লঙ্ঘন দাবি করে সুবাস্তু ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক নাজমুল হক খান হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন আবেদন করেন। এ আবেদনে সালিশকারী নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা চান আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল কাইয়ূম। পরে হাইকোর্ট চূড়ান্ত রায়ে নীতিমালা তৈরি না করে এটি করার জন্য রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতি নির্দেশ দেন।

ব্যারিস্টার মো. আব্দুল কাইয়ূম বলেন, ২০০১ সালে আরবিট্রেশন আইন হওয়ার পর আজ পর্যন্ত এ আইনের কোনো বিধিমালা হয়নি। আইনের ১২ ধারায় বলা আছে, কীভাবে সালিশকারী নিয়োগ হবে। পক্ষগণ তাদের চুক্তি অনুযায়ী সালিশকারী নিয়োগ করতে পারে। তিনজনের আরবিট্রেশন হলে প্রত্যেক পক্ষ থেকে একজন করে সালিশকারী নিয়োগ করবে। কোনো পক্ষ তার নিজের সালিশকারীর নাম প্রস্তাব করে অন্যপক্ষকে তার সালিশকারী নিয়োগের আহ্বান জানাবে। সেক্ষেত্রে ৩০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ সালিশকারী নিয়োগে ব্যর্থ হলে, অন্যপক্ষ জেলা জজের কাছে আবেদন নিয়ে যায়। তখন জেলা জজ যে পক্ষ সালিশকারী নিয়োগ দেয়নি, সেই পক্ষে একজন সালিশকারী নিয়োগ করতে পারে।

ব্যারিস্টার কাইয়ূম আরও বলেন, নীতিমালা না থাকায় জেলা জজ কাকে সালিশকারী নিয়োগ করবেন, সেক্ষেত্রে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। জেলা জজ চাইলেই যে কাউকে সালিশকারী নিয়োগ করতে পারেন। জেলা জজের হাতে একটি অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা রয়েছে। ফলে অভিযোগ রয়েছে, জেলা জজের পছন্দের কাউকে সালিশকারী নিয়োগ করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি ২০, ৩০, ৪০ কিংবা ৫০টি মামলায় সালিশকারী নিযুক্ত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিতর্ক উঠছে। তাই বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্যই সালিশকারী নিয়োগে একটি নীতিমালা চেয়েছিলাম। বিচার বিভাগ যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেজন্য নীতিমালা করা দরকার। কে সালিশকারী হবেন, কে কতটা মামলায় নিযুক্ত হতে পারবেন ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। হাইকোর্ট বিভাগ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে একটি নীতিমালা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

জানা যায়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে প্রচলিত বিচারব্যবস্থায় পদ্ধতিগত জটিলতার মুখে পড়েন। আদালতের মাধ্যমে একটি মামলা নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর এমনকি যুগ পার হয়ে যায়। এমনই এক পরিস্থিতিতে দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রচলিত বিচারব্যবস্থার চেয়ে সালিশ ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর। বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে পাস করা হয় সালিশ (আরবিট্রেশন) আইন-২০০১। এ আইনের মাধ্যমে প্রচলিত আদালতের বাইরে শুধু সালিশের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিশ কেন্দ্র (বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার বা বিআইএসি)।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০১ সালে আরবিট্রেশন আইন হওয়ার পর আজ পর্যন্ত এ আইনের কোনো বিধিমালা হয়নি। আইনের ১২ ধারায় বলা আছে, কীভাবে সালিশকারী নিয়োগ হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সালিশকারী নিয়োগ নিয়ে বারবার বিতর্ক উঠছে। এর আগে গত ৫ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির কাছে ঢাকার জেলা জজের বিরুদ্ধে আরবিট্রেটর নিয়োগে সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ দাখিল করেন। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও রিটায়ার্ড জাজেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মাহমুদুল কবির ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো. শফিকুল ইসলাম তালুকদার এ অভিযোগ দাখিল করেন।

অভিযোগে বলা হয়, বর্তমান ঢাকা জেলা জজ আদালতে যোগদানের পর অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. মঞ্জুরুল বাসিতকে প্রায় ১০০টি মোকদ্দমায় আরবিট্রেটর নিয়োগ করেছেন। এসব মামলায় জেলা জজের সঙ্গে যোগসাজশে তার বিশ্বস্ত দুই থেকে চারজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজকেই আরবিট্রেটর হিসেবে নিয়োগ করান মঞ্জুরুল বাসিত। তারা আবার পরে বাসিতকেই আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করেন। এভাবে তিনি কখনো আরবিট্রেটর বা চেয়ারম্যান হিসেবে জেলা জজ আদালতের নিয়োগ করা ৯৫ শতাংশ আরবিট্রেশন মোকদ্দমায় যুক্ত থাকেন। আর কোনো আরবিট্রেটর মঞ্জুরুল বাসিতকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করতে অসম্মতি জানালে তাদের পরে আর আরবিট্রেটর হিসেবে নিয়োগ করা হয় না। জেলা জজের এমন আচরণে অনেকে তাকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করতে বাধ্য হন। ফলে জেলা জজ ও মঞ্জুরুল বাসিত ‘আরবিট্রেশন সিন্ডিকেট’ হিসেবে পরিচিত।

এ ছাড়া অন্য একটি আরবিট্রেশন মামলায় সালিশকারী পরিবর্তন করায় গত ২৯ মে ঢাকার জেলা জজকে সশরীরে হাইকোর্টে তলব করা হয়েছে। আগামী ১৮ জুন সকাল ১১টায় তাকে সশরীরে হাজির হতে বলা হয়েছে। হাজির হয়ে কোন কর্তৃত্ববলে আবেদনকারীপক্ষ কর্তৃক নিয়োগকৃত ও মনোনীত সালিশকারী বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে (বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি) পরিবর্তন করে তার স্থলে অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ দিলীপ কুমার ভৌমিককে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন, তার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।