সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতি লাগবে কি না, রায় কাল
সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ

প্রচলিত আদালতে জনশৃঙ্খলা বিনষ্টের বিচার বেআইনি: হাইকোর্ট

স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এলাকার জনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের বিধায় প্রচলিত আদালতে এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার বেআইনি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।

মো. মফিজুল হক ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ গত বছরের ২৩ নভেম্বর এ রায় ঘোষণা করেন। সম্প্রতি উক্ত ফৌজদারি রিভিশন মামলায় প্রদত্ত রায়ের ১৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।

আদালতে রিভিশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান দুলু। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আশেক মোমিন, সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল লাকী বেগম ও ফেরদৌসি আক্তার।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

মামলা সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ইয়লিপুর উপজেলার ভদ্রপাড়া গ্রামে সরকারী রাস্তা কেটে জনসাধারণের চলাচলের পথ বন্ধ করে বেআইনিভাবে বোরো ধান আবাদ ও পাট বুননের চেষ্টার অভিযোগে একই এলাকার ৭ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়।

২০০৪ সালের ২৪ মার্চ ভদ্রপাড়া গ্রামবাসীর পক্ষে হোসেন আলী নামের এক ব্যক্তি উলিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি বরাবর এ সংক্রান্ত এজাহার দায়ের করেন।

মামলার আসামিরা হলেন- মো. মফিজল ও তাঁর ছয় ছেলে যথাক্রমে মাহবুবর রহমান, মোকলেছুর রহমান, মমিনুল ইসলাম, মজা মিয়া, মাইদুল ইসলাম (মুকুল) ও মন্টু মিয়া।

এতে বলা হয়, ২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সকালে ভদ্রপাড়া মৌজার ৪০৬নং দাগের সরকারী রাস্তা কোদাল দিয়ে কেটে আসামিরা নিজেদের জমির সাথে একত্র করে বোরো ধানের চারা রোপণকালীন এজাহারকারী ও গ্রামবাসী বাধা দেন। আসামীরা বাধা না মেনে ধানের চারা রোপণ করেন। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এমতাবস্থায় একই বছরের ২১ মার্চ আসামীরা সরকারী রাস্তার পূর্বদিকের মাথায় হালচাষ করে পাট আবাদ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এসময় এজাহারকারী ও গ্রামবাসীর সাথে আসামিদের বচসা হয় এবং একপর্যায়ে আসামিরা মামলার বাদী ও এলাকাবাসীকে ভয়ভীতি দেখায়।

বিচারিক ও আপীল আদালতের রায়

এজাহার প্রসিকিউশন, সাক্ষীদের জবানবন্দী ও জেরা, উভয়পক্ষের যুক্তিতর্কসহ সকল বিচারিক প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে মামলার অভিযুক্ত ৩ নং আসামি মোখলেছুর রহমানকে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দণ্ডবিধির ৪৩১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।

পাশাপাশি বাকী ৬ আসামীকে খালাস প্রদান করা হয়। আসামিরা একই পরিবারের সদস্য, ১নং আসামি মফিজল হক বাকী ছয় আসামির পিতা এবং মফিজল অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ও রোগাক্রান্ত, তাঁর ছেলে ২ নং আসামি মাহবুবর রহমানও বয়স্ক হওয়ায় ৩নং আসামি মোখলেছুর রহমানকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। কুড়িগ্রামের প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক এস.এম শাহ হাবিবুর রহমান ২০০৫ সালের ৩০ মার্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

পরবর্তীতে একই বছরের ২৩ জুলাই এ রায়ের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন বাদী পক্ষ। আপিল মঞ্জুর করে ২০০৬ সালের ১৬ নভেম্বর বিচারিক আদালতের রায় রদ ও রহিত করে রায় ঘোষণা করেন অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফারজানা বেগম। রায়ে সকল আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের প্রতি সাজা পরোয়ানা ইস্যু করেন।

ফৌজদারি রিভিশন ও হাইকোর্টের রায়

অধস্তন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে ফৌজদারি রিভিশন দায়ের করেন। ওই আবেদন শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। পরবর্তীতে রুলটি চূড়ান্ত করে রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে হাইকোর্ট বলেন, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী প্রত্যেক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এলাকার জনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের।

জনসাধারণের চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হোক বা নাহোক পায়ের চলার এমন পথ, মাঠ, চলাচলের রাস্তা, সরকারী রাস্তা নর্দমা, পরিবেশ, জলবায়ু, জলাভূমি, তথা সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, নদ-নদীর পাড়, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, নালা, ঝিল, ঝিরি ও সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, পাহাড়-পর্বত, বন, বন্যপ্রাণী এবং বাতাস এই সব কিছুর অবৈধ দখল, দূষণ এবং বিনষ্ট ‘জনশৃঙ্খলা’ এর অন্তর্ভুক্ত।

উক্ত জনশৃঙ্খলা সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের ধারা ৯৩(১) মোতাবেক এসবের অবৈধ দখল, দূষণ ও ক্ষতিসাধন বেআইনি। একই আইনের ধারা ৯৩(২) অনুযায়ী এসবের অবৈধ দখল, দূষণ ও বিনষ্টকারীদের পরিষদ নোটিশ প্রদান করে অপসারণ ও দূষণ প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে।

রায়ে আদালত আরো বলেন, স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন দ্বারা দণ্ডবিধির ধারা ৪৩১ কার্যত (de facto) বাতিল হয়ে গেছে, তথা এটি কার্যকারিতা হারিয়েছে। সুতরাং থানায় এ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের এখতিয়ারবিহীন ও বেআইনি। আলোচ্য অভিযোগটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিরাবর দাখিল করা উচিত ছিল।

উলিপুর থানার ওসি অভিযোগটি গ্রহণ না করে ইউনিয়ন পরিষদে দাখিলের পরামর্শ দেওয়া উচিত ছিল। তা না করে ওসি এখতিয়ারবহির্ভূত এবং বেআইনিভাবে অভিযোগ গ্রহণ করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তাও এখতিয়ারবহির্ভূত এবং বেআইনিভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। বিচারিক ও আপিল আদালতও এখতিয়ারবহির্ভূত এবং বেআইনিভাবে মামলাটির বিচারকার্য পরিচালনা করেন বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট।

সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে আদালত রুলটি উপর্যুক্ত নির্দেশনা ও পরামর্শসহ চূড়ান্ত করে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আদালত বিচারিক ও আপিল আদালতের রায় ও দণ্ডাদেশ বাতিল ঘোষণা করেন।

রায়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অবগত করার নির্দেশ 

এই রায় ও আদেশের অনুলিপি ই-মেইলে প্রেরণের মাধ্যমে দেশের সকল বিচারককে অবগত করার জন্য হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেন।

একইসঙ্গে রায় ও আদেশের অনুলিপি ই-মেইলে প্রেরণের মাধ্যমে দেশের সকল থানার ওসিকে অবহিত করা ও তদানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার নিমিত্ত প্রেরণের জন্য হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেন।

এছাড়াও দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে রায় ও আদেশ সম্পর্কে অবহিত করা ও তদানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার নিমিত্ত ই-মেইলে প্রেরণের জন্যও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেন।