শিশু আইনে জটিলতা ও বিচারে প্রভাব
ইফতি হাসান ইমরান, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মুন্সীগঞ্জ।

শিশু আইনে জটিলতা ও বিচারে প্রভাব

ইফতি হাসান ইমরান: ‘শিশু আইন ২০১৩’ এর বিদ্যমান জটিলতা নিরসনে ‘শিশু (সংশোধন) আইন ২০১৮ (২০১৮ সনের ৫৪ নং আইন)’ প্রণয়ন করে বিদ্যমান শিশু আইনে সংশোধনী আনা হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আইনি জটিলতা এখনো রয়ে গেছে।

প্রচলিত সব আইনে কম বেশি জটিলতা থাকলেও শিশু আইনের ক্ষেত্রে এসব জটিলতাগুলো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, আবার কোনো ক্ষেত্রে আইনের মূল উদ্দেশ্য তথা ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে বাধা মনে হয়েছে এবং বিচার কাজে প্রতিকূল প্রভাব সৃষ্টি করছে মনে হয়েছে। যেমন-

১.

শিশুর হেফাজতকারী ব্যক্তি কর্তৃক শিশুর শ্রবনশক্তি নষ্ট, দৃষ্টি শক্তি নষ্ট, ইন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত, মানসিক বিকৃতি ও অঙ্গহানি এসব গুরুতর জখম ঘটালে শিশু আইনের ৭০ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ড।

কিন্তু একই অপরাধ কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির প্রতি ঘটালে অর্থাৎ ভিকটিম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে অপরাধ সংগঠনে ব্যবহৃত অস্ত্রের ভিত্তিতে তা ‘দি পেনাল কোড ১৮৬০’ এর ৩২৫ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর কারাদণ্ড এবং ৩২৬ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক একজন ব্যক্তি (অপরাধী) রামদা দিয়ে আঘাত করে কোনো শিশুর পা কেটে ফেললে তার সর্বোচ্চ সাজা ৫ বছর কারাদণ্ড কিন্তু একই ব্যক্তি যখন ১৮ বছর তা তদুর্ধ ব্যক্তির পা একইভাবে কেটে ফেলে সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

একই অপরাধ কিন্তু ভিকটিম শিশু বিধায় অপরাধীর সাজা অত্যন্ত কম এবং ভিকটিম প্রাপ্ত বয়স্ক বিধায় অপরাধীর সাজা বেশি হওয়া ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতার বড় অভাব হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে শিশুর ন্যায়বিচার প্রাপ্তি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করি।

২.

শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশুর বিচার শিশু আদালত করলেও আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর প্রতি একই আইনের ৭০ থেকে ৮২ ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংগঠিত হলে সেসব অপরাধ একই আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বিচার্য।

কারণ হলো এই শিশু আইনে ৭০ থেকে ৮২ ধারার অপরাধের বিচার কোন আদালত করবে তা এই আইন আলাদাভাবে নির্ধারণ করেনি। তাই একই আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী ‘দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮’ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী বিচারকারী আদালত নির্ধারিত হবে।

শিশু আইন ২০১৩ এর ৭০ থেকে ৮২ ধারার বর্নিত অপরাধগুলোর সর্বোচ্চ কারাদণ্ড ১ বছর থেকে ৫ বছর এবং প্রত্যেকটি অপরাধের বিকল্প দণ্ড হিসেবে অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যেমন ৭০, ৭১, ৭৮ ধারার অপরাধে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড যা ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বিচার্য, ৭৩, ৭৪, ৭৯ ধারার অপরাধে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড যা ২য় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বিচার্য, ৭৫, ৭৭, ৮০ ধারার অপরাধে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড, ৭২, ৭৬, ৮১, ৮২ ধারার অপরাধে সর্বোচ্চ ১ বছর কারাদণ্ড যা ৩য় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বিচার্য।

সমস্যা হলো ৭০ থেকে ৮২ ধারার অপরাধে বিকল্প হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার থেকে ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড আরোপের বিধান আছে। ‘দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮’ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী বিচারকারী ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড আরোপের ক্ষমতা আছে যা ২য় ও ৩য় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে আরও কম যা এই আইনে বিকল্প হিসেবে অর্থদণ্ড আরোপের উদ্দেশ্যকে চিরতরে বাধাগ্রস্ত করেছে।

কিন্তু এই আইনে বিচারকারী আদালত নির্ধারিত করে দিলে আর এই ৩২ ধারার অর্থদন্ড আরোপের স্কেলে বাধা হয়ে পরতো না। অথবা এসব অপরাধে কারাদণ্ডের সাথে অর্থদন্ডের বিধান বিকল্প হিসেবে না রেখে কারাদণ্ড এবং অর্থদন্ডের বিধান রাখা হলে অপরাধগুলো অসীম আর্থিক এখতিয়ার সম্পন্ন দায়রা আদালত কর্তৃক বিচার্য হতো এবং সেক্ষেত্রেও সমস্যা কিছুটা দূর হতো বলে মনে করি।

৩.

একই আইনের ৮৩ ধারায় মিথ্যা তথ্য প্রদান করার অপরাধে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ এবং অনাদায়ে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এর বিধান থাকলেও ‘দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮’ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের অর্থদন্ড প্রদানের ক্ষমতা থাকলেও ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষমতা নেই।

তবে ‘দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮’ এর ৫৪৫ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে অর্থদন্ডের টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে অপরপক্ষকে প্রদান করতে পারেন।

উক্ত ৫৪৫ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা তাই ১ম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সেই ১০ হাজার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকলো। ফলে শিশু আইনের ৮৩ ধারায় প্রদত্ত ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষমতা সেই অধরাই থাকলো মনে করি।

৪.

শিশু আইন ২০১৩ এর ৪৪ (৪) ধারা অনুযায়ী শিশু বিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা তার কাছে আসা শিশুর বয়স নির্ধারণে প্রাসঙ্গিক দলিলাদি যাচাই বাছাই করে শিশুর বয়স লিপিবদ্ধ করতে পারেন কিন্তু থানা থেকে কোনো আসামীকে প্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করলে সেক্ষেত্রে যদি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উক্ত ব্যক্তিকে সুস্পষ্ট শিশু মনে হয় সেক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের করনীয় সম্পর্কে আইন নিশ্চুপ, যা শিশুর সর্বাধিক সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে একটি বড় বাধা বলে মনে করি।

৫.

শিশু আইনের ৫২ ধারা অনুযায়ী আইনের সাথে সংঘাতে শিশুকে শিশু বিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা বা শিশু আদালত জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। কিন্তু একই আইনের ১৫ক ধারা অনুযায়ী আমলী আদালত ম্যাজিস্ট্রেট আদালত হওয়ায় ৪২ ধারা অনুযায়ী শর্ত ভঙ্গে জামিন বাতিলের ক্ষমতা কিন্তু সেই ম্যাজিস্ট্রেটেরও রয়ে গেছে (বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগে পর্যন্ত)।

যে উদ্দেশ্যে জামিন প্রদানের ক্ষমতা শিশু আদালতকে দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা জামিন বাতিলের বিষয়টিও শুধু উক্ত অভিজ্ঞ আদালতেরই অধীন করা যেতো বলে মনে করি।

৬.

শিশু আইনের ৫২ (৪) ধারা অনুযায়ী আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশুকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে শিশু আদালতে উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যদিকে উক্ত শিশুর বাংলাদেশের সংবিধানের ৩য় ভাগে উল্লিখিত ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপিত হওয়ার মৌলিক অধিকার রয়েছে।

সংবিধানের উক্ত ৩য় ভাগের ২৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রনয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে’।

ফলে শিশুকে ধৃত করার পরে শিশু আদালতে উপস্থাপন করা সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। এত বড় আইনী জটিলতা দূর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মুন্সীগঞ্জ।