সিজেএম আদালত ভবনের স্থান নিয়ে বিতর্ক

সিজেএম আদালত ভবনের স্থান নিয়ে বিতর্ক

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী: কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের নতুন ভবনের স্থান নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক গত প্রায় ১৫ বছর ধরে চলছে। “বাংলাদেশের ৬৪ জেলা সদরে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ” শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প ২০০৯ সালের জুন মাসে সরকার হাতে নিয়েছিলো। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের অন্যান্য জেলা সদরের মতো কক্সবাজারেও নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে, বহুমুখী সুবিধা সম্বলিত ১৩ তলা বিশিষ্ট সুপরিসর ভবন নির্মাণ হওয়ার কথা। এ ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে স্থান নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে দফায় দফায় উচ্চ পর্যায়ের টিম কক্সবাজার এসেছে।

টিমগুলো কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে উত্তর-পশ্চিম পাশের খালি জায়গা, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নতুন এনেক্স ভবনের জমি, বর্তমান চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের জমি, কক্সবাজার আইন কলেজের দক্ষিণ পাশে ব্যবহার অযোগ্য পরিত্যক্ত পুকুরটি সহ আরো কিছু জমি নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য জমি হিসাবে পরিদর্শন করেছিলেন। কিন্তু একটি জায়গাও ভবন নির্মাণের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ প্রাথমিকভাবে পরিদর্শন করা প্রতিটি জায়গায় কোন না কোনভাবে জটিলতা থাকে। এভাবে কেটে যায় বছরের পর পর।

অপরদিকে, দিন দিন মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে ১৯৫২ সালে নির্মিত পরিত্যক্ত ঘোষিত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বর্তমান জরাজীর্ণ পুরাতন ভবনটি। তাছাড়া, প্রায় অর্ধলক্ষ মামলার ভারে জর্জরিত কক্সবাজার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর কার্যক্রম প্রয়োজনীয় স্থানের অভাবে ব্যাহত হতে থাকে প্রতিনিয়ত। চরম ঝুঁকি ও উৎকন্ঠা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, বিজ্ঞ বিচারক, স্টাফ, আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী, বিচারপ্রার্থী সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে।

এজলাসের অভাবে একটি এজলাস থেকে একজন বিচারক বিচারকার্য পরিচালনা করে নেমে যাওয়ার পর, আরেকজন বিচারক সেই একই এজলাসে পালাক্রমে উঠে বিচারকার্য পরিচালনা করেন। এরকম করুণ ও ভয়াবহ চিত্র বর্তমান সিজেএম আদালত ও একই আদালতের আওতাধীন অন্যান্য কোর্ট গুলোর।

“বাংলাদেশের ৬৪ জেলা সদরে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ” শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০০৯ সালের জুন মাসে শুরু হয়ে ২০১৪ সালের ৩০ জুনে শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পটি ২ হাজার ২ শত ৬০ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা চুড়ান্ত ব্যয় ধরে ২ দফায় সংশোধিত হয়ে ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। প্রকল্পের শেষদিকে এসে ২ শত ৩৭ কোটি টাকা দিয়ে কক্সবাজার শহরের পশ্চিম বাহারছরার হিলডাউন সার্কিট হাউস এর উত্তর পাশে নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণের জন্য গণপূর্ত বিভাগ থেকে এক একর ৭৩ শতক জমি ক্রয় করা হয়েছে।

জমিটি সার্ভে করে কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর বরাবরে দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ জুন কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ ও স্টাফগণ জমিটার দখল বুঝে নিয়ে সীমানা পিলার পুঁতে দিয়েছেন। জমিটা কক্সবাজারের অভিজাত এলাকায়, আকর্ষনীয় লোকেশনে, অত্যন্ত মূল্যবান এবং জেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। জমিটা নিঃসন্দেহে কক্সবাজার বিচার বিভাগ ও কক্সবাজারবাসীর জন্য বিশাল সম্পদ।

কক্সবাজারের গোড়াপত্তন থেকে যখন বিচার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা শুরু হয়েছে, তখন প্রথমদিকে রামু’র ফতেখাঁরকুলের অফিসের চরে বৃটিশ ক্যাপ্টেন মি: হিরাম কক্স সাহেবের অফিস স্থাপনের কারণে সেখানেই কিছুদিন সাময়িকভাবে কক্সবাজারের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলেছিল। এরপর কক্সবাজার শহরের কাচারি পাহাড় (কোর্ট হিল) এলাকাতেই স্থায়ীভাবে কক্সবাজারের সমস্ত প্রশাসনিক, বিচারিক সহ অন্যান্য সকল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের স্থাপনা গড়ে উঠে এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এই এলাকাটি। যেকারণে এলাকাটির নাম হয়ে যায়, “কাচারী পাহাড়” অর্থাৎ “কোর্ট হিল” বাংলায় “আদালত পাহাড়” এলাকা।

একইভাবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভবন (যেখানে রয়েছে রাষ্ট্রের আরো অনেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান), জেলা জজ আদালত ভবন, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন, জেলা কোষাগার, কক্সবাজার পৌরসভা কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, কক্সবাজার জেলা পরিষদ, জেলা আইনজীবী সমিতির ভবন, আইনজীবী সমিতির নিজস্ব কার্যালয়, জেলা ফিন্যান্স এন্ড একাউন্টস অফিসারের কার্যালয়, কাস্টমস ও ভ্যাট অফিসের বিভাগীয় কার্যালয়, জেলা ও সদর উপজেলা নির্বাচন অফিস, সোনালী ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক এর প্রতিনিধি) এর শাখা, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ, কক্সবাজার প্রেসক্লাব, কেন্দ্রীয় ঈদগাঁহ ময়দান সহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনা গুলো এ এলাকায় রয়েছে। এছাড়া, বর্তমান আদালত কম্পাউন্ডে আইনজীবী সমিতির একাধিক ভবন, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ শপিং কমপ্লেক্স ভবন সহ অন্যান্য ভবনে ন্যুনপক্ষে ৮ শত আইনজীবীর স্থায়ী চেম্বার রয়েছে।

সাধারণ নাগরিকদের কক্সবাজার জেলা জজশীপের আওতাধীন আদালত এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর আওতাধীন আদালতগুলোতে নিয়মিত বিচারিক কর্মের সেবা নেওয়া ছাড়াও আরো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক কাজে আসা যাওয়া করতে হয়। অনুরূপভাবে বিচার বিভাগীয় আদালত গুলো ছাড়াও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, কক্সবাজার পৌরসভা কার্যালয় সহ সরকারি, সায়ত্তশাসিত আরো কিছু প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রের কিছু বিধিবদ্ধ বিচার কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালিত হয়। যেগুলোর সাথে আমজনতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আবার সেবাধর্মী একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সাথে অপরাপর প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সরাসরি সম্পৃক্ততাও রয়েছে।

এ অবস্থায় রাষ্ট্রের সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান গুলো কাছাকাছি একই এলাকায় থাকলে একজন নাগরিক একইসাথে, একইসময়ে, একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে তুলনামূলক সহজে ও কমসময়ে কাংখিত নাগরিক সেবা, বিচারিক সেবা সহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সব সেবা সহজে নিতে পারেন। যেসব রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়া একজন নাগরিকের জন্মগত অধিকার। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান গুলো কাছাকাছি একই এলাকায় থাকার কারণে নাগরিকদের অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনার শিকার এবং খুব একটা দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়না। এতে প্রায় সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠান গুলোর নাগরিক সেবা প্রায় নিশ্চিত ও সহজলভ্য হয়।

আবার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান গুলো বিশেষ করে বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান গুলো অপেক্ষাকৃত কম দুরত্বের মধ্যে একই এলাকায় গড়ে উঠলে আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী, ভেন্ডার, কম্পিউটারম্যান, টাইপিস্ট, বাণিজ্যিক ব্যাংক, নোটারী পাবলিক, ডাকঘর, আইসিটি সুবিধা, ষ্টেশনারী, ফটোস্ট্যাট সুবিধা সহ আদালতের কার্যক্রমের সাথে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে জড়িত সকলেই সহজে ও সুলভে নাগরিকদের সেবা দিতে পারেন।

ফলে এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কম দুরত্বের কারণে নাগরিকদের জন্য কাংখিত সেবা অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য ও নির্ঝঞ্জাট হয়। আর জনস্বার্থে রাষ্ট্রীয় সেবাধর্মী স্থাপনা গুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও তুলনামূলকভাবে সহজ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমান কাচারী পাহাড় (কোর্ট হিল) এরিয়াটাতে এরকম বহুমুখী যোগাযোগ সুবিধা রয়েছে। এছাড়া সম্ভব হলে “ওয়ানস্টপ” নাগরিক সেবা দেওয়া এবং নাগরিক সেবা জনগণের দ্বোরগোড়ায় সহজে পৌঁছে দেওয়া সরকারের নীতির অন্যতম অংশ।

নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণের জন্য গণপূর্ত বিভাগ থেকে ২ শত ৩৭ কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করা এক একর ৭৩ শতক জমির অবস্থানটা বর্তমান জেলা জজ আদালত ভবন থেকে অর্ধ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত। ক্রয়কৃত জমিতে নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ করা হলেও জেলা জজ আদালত ভবন বর্তমান জায়গাতেই রয়ে যাবে। যদি ক্রয়কৃত জমিতে নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়, তাহলে সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের জেলা জজ আদালত ভবনের কাজ সেরে একইসময়ে প্রস্তাবিত সিজেএম আদালত ভবনে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে যাওয়া অনেকটা কঠিন ও দুরূহ হয়ে উঠবে।

একইভাবে প্রস্তাবিত নতুন সিজেএম আদালত ভবন থেকে কাজ সেরে, আবার জেলা জজ আদালত ভবনে কাজ সারতে আসাটাও খুব একটা সহজ হবেনা। এতে সেবাপ্রার্থীরা কাংখিত সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন এবং বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগের শিকার হওয়ার আশংকা রয়েছে বেশি। আর ক্রয়কৃত জমির সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও একমুখী এবং সড়কটি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। এজন্য সেখানে সার্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং যানজট হওয়ার আশংকা রয়েছে বেশি।

জেলা বিচার বিভাগের শীর্ষ স্থাপনা জেলা জজ আদালতের সকল কোর্ট থাকবে কাচারীপাহাড় (কোর্ট হিল) এলাকায়, আর নতুন সিজেএম আদালত ভবন হবে তার থেকে আধা কিলোমিটারেরও বেশি দুরে হিলডাউন সার্কিট হাউস এলাকায়। এ অবস্থায় বিচার সংশ্লিষ্ট সেবাপ্রার্থীদের সেবা নেওয়াটা অনেকটা ব্যয়বহুল ও কষ্টকর হয়ে উঠবে। বিজ্ঞ আইনজীবীরা সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে বিচারপ্রার্থীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হবে, সার্বক্ষনিক দৌড় ও উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হবে সকলকে।

বিশেষ করে প্রবীণ আইনজীবীদের পক্ষে উভয় আদালত ভবনে দুরত্বের কারণে একই সময়ে ছুটাছুটি করে গিয়ে মক্কেলদের চাহিদা মতো সেবা দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। সেবাপ্রার্থীদের এসব কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় এনে নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণের জন্য ক্রয় করা এক একর ৭৩ শতক জমির অবস্থানগত দুরত্বের কথা চিন্তা করে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সামনে সমাবেশ করেছিলেন। যার প্রতি সাধারণ নাগরিক সহ সংশ্লিষ্ট সকলের জোরালো সমর্থন ছিলো বলে মনে হয়েছে। আর আইনজীবীরা যেহেতু “সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার” নামে সবার কাছে পরিচিত। সেজন্য সমাজের বাস্তবতা ও আমজনতার শিরা উপশিরা, রক্ত প্রবাহ বুঝে সার্বিক জনকল্যাণেই যেকোন পদক্ষেপ তাঁদের নিতে হয়।

সংকট নিরসনে যা করা যেতে পারে

কক্সবাজারে অবস্থিত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান গুলোর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান প্রধানগণের বাসভবন তাঁদের অফিসের সাথে লাগোয়া নয়। যেমন-কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের বাসভবন একসময় তাঁর অফিসের সাথে লাগোয়া থাকলেও দীর্ঘদিন আগে সেটা সরিয়ে অফিস থেকে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার দূরে হিলটপ সার্কিট হাউসের দক্ষিণে নেওয়া হয়েছে। একইভাবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার, কক্সবাজারের সিভিল সার্জন, কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী’র বাসভবন তাঁদের কার্যালয়ের সাথে করা হয়নি।

কক্সবাজার শহরের বাহারছরায় জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই ৩ শীর্ষ কর্মকর্তার সরকারি বাসভবন গড়ে তোলা হয়েছে। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। এটা সার্বিক নিরাপত্তা, কোলাহল ও দূষণমুক্ত নির্ঝঞ্জাট পরিবেশ, আবাসিক পরিবেশবান্ধব এলাকা সহ আরো বহু কারণ বিবেচনায় এনে অফিসের সাথে অফিস প্রধানগণের বাসভবন রাখা হয়নি বলে নগরায়ণ বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

কক্সবাজারের বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মহোদয় এর কাচারীপাহাড় (কোর্ট হিল) এলাকায় বর্তমানে অবস্থিত বাসভবনটি অনেক আগে নির্মিত। বাসভবনটি জরাজীর্ণ ও অনেকটা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যেখানে আধুনিক সুযোগ সুবিধাও অপ্রতুল। বাসভবনটি যদি নিরাপদ, কোলাহলমুক্ত, আরো আকর্ষনীয় ও উন্নত আবাসিক পরিবেশ বান্ধব এলাকায় করা যায়, তাহলে অনেক ভালো হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাসভবন পাবলিক স্পেসে হওয়ার চেয়ে নিরাপদ ও আবাসিক পরিবেশ বান্ধব স্থানে হওয়া অনেক শ্রেয়। সেক্ষেত্রে জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়ের বাসভবনটি অপেক্ষাকৃত আরো উত্তম ও পরিচ্ছন্ন জায়গায় নির্মাণ করার পর বর্তমান জেলা ও দায়রা জজ মহোদয় এর বাসভবনের বর্তমান জায়গায় নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে পরিকল্পিতভাবে সুপরিসর বহুতল নতুন সিজেএম আদালত ভবন সহজেই নির্মাণ করা যাবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আগে থেকে তৈরি করা কমন টাইপ প্ল্যান-ডিজাইন বাদ দিয়ে জমির অবস্থান, পরিমাপ মতে এবং স্থানীয় গুরুত্ব বিবেচনায় পরিকল্পিতভাবে কক্সবাজারের জন্য পৃথক ডিজাইন, প্ল্যান তৈরি করে সে অনুযায়ী নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ করা যাবে।

আগামী ৫০ বছরের মধ্যে কক্সবাজারে হয়তো ৫০/৬০ জন কিংবা আরো বেশি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি হবে। এছাড়া, কক্সবাজার প্রশাসনিক ভাবে প্রথম শ্রেণির জেলা হলেও কক্সবাজার জুডিসিয়ারি এখনো “দ্বিতীয় শ্রেণি” তে রয়ে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে কক্সবাজার জুডিসিয়ারি “প্রথম শ্রেণি” তে উন্নীত হলে ক্যাটাগরি অনুযায়ী কক্সবাজার বিচার বিভাগে আপনাআপনি অনেক বিচারকের পদ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে কক্সবাজার বিচার বিভাগে জেলা সদরে সম্ভবত ২৮ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার পদ থাকলেও শুধুমাত্র জেলা ও দায়রা জজ ছাড়া আরো কারো জন্য সরকারি কোন বাসভবন নেই।

কক্সবাজার একটি বিখ্যাত পর্যটন এলাকা হিসাবে কক্সবাজারে প্রায় প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের পৃথক আধুনিক রেস্ট হাউস রয়েছে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি মৌলিক ও অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কক্সবাজার বিচার বিভাগের নিজস্ব পৃথক কোন রেস্ট হাউস নেই। অথচ কক্সবাজারের ভৌগোলিক অবস্থান ও অন্যান্য গুরুত্ব বিবেচনায় কক্সবাজার বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ও আধুনিক রেস্ট হাউস থাকা প্রয়োজন ছিলো। যেহেতু নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণের জন্য ক্রয়কৃত জমিটি কক্সবাজার বিচার বিভাগের জমি। সেজন্য, সেই জমিটাতেও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে বিজ্ঞ বিচারকদের জন্য মাল্টিপারপাস বাসভবন, আধুনিক রেস্ট হাউস, রিজিওনাল জুডিসিয়াল লার্নিং সেন্টার, নিরাপত্তাকর্মীদের ডিউটি অফিস সহ প্রয়োজনীয় সকল স্থাপনা সহজে করা যাবে।

“মানুষের কল্যানের জন্য আইন, আইনের কল্যানের জন্য মানুষ নয়।” সে ধারণা থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে কক্সবাজার আইন কলেজের দক্ষিণ পাশে এবং কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের উত্তর পাশে পরিত্যক্ত, সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী পুকুরটি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বর্তমান সিজেএম আদালত ভবন এর পশ্চিমে আমগাছতলা থেকে পরিত্যক্ত পুকুরটির পূর্ব পাড় পর্যন্ত পুরো জমিতে নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ করা যাবে।

জনস্বার্থে ও জেলা সদরের আদালত কম্পাউন্ডকে সমৃদ্ধ করার প্রয়োজনে এ উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিবেশ অধিদপ্তর নিশ্চয়ই ইতিবাচক চিন্তা করবেন বলে দৃঢ় বিশ্বাস। কক্সবাজারে রাষ্ট্র ও জনসাধারণের বৃহত্তর স্বার্থে নিকট অতীতে অনেকক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর এরকম অনেক ছাড় দিয়েছেন। যার সুফল ভোগ করছে, কক্সবাজার জেলাবাসী। আবার জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়ের বর্তমান বাসভবনের জায়গায় নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ করা গেলে, বর্তমান পুরাতন সিজেএম আদালত ভবনের জায়গায় জেলা জজ আদালতের অধীনে পৃথক আরেকটি আদালত ভবন নির্মাণ করা যাবে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সৌন্দর্য রক্ষা এবং ভবিষ্যতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধি করার কথা মাথায় রেখে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের উত্তর-পশ্চিম পাশের খালি জমিটা নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্মত নাহলেও কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারকদের নতুন এজলাসের জন্য জলা জজ আদালতের উত্তর পশ্চিম পাশে জেলা প্রশাসকের পুরাতন বাসভবনটির জায়টিতেও জেলা জজশীপ এর অধীনে নতুন আদালত ভবন নির্মাণ করা যাবে।

এছাড়াও প্রস্তাবিত সিজেএম আদালত ভবনটি জেলা জজ আদালতের কাম্পাউন্ডের মধ্যে রাখতে আরো অনেক বিকল্প, সুবিধাজনক ও যৌক্তিক পথ খোলা রয়েছে। “বাংলাদেশের ৬৪ জেলা সদরে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ” শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হলেও দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪২টি জেলায় নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মিত হয়েছে। বাকী ২২টি জেলায় কক্সবাজারের মতো ভবন নির্মাণের জন্য জমি ক্রয় করা হয়েছে মাত্র। কিন্তু সেগুলোতে এখনো নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়নি। তাই আমজনতার সুযোগ সুবিধার কথা সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শিরা, উপশিরা, মানসিকতা, রাষ্ট্রীয় সেবাকে সহজলভ্য করার অধিকার ইত্যাদি বিবেচনায় আনতে হবে গুরুত্ব সহকারে।

কিন্তু এসব কিছু বিনা তদবিরে, বিনা চেষ্টায়, উদ্যোগবিহীন কখনো সম্ভব নয়। এগুলো কখনো অলৌকিকভাবে বাস্তবায়ন হবেনা। প্রথমেই আমাদের প্রত্যেক পক্ষকে বৃহত্তর কক্সবাজার ও কক্সবাজারবাসীর কথা চিন্তা করে বিষয়টা নিয়ে নিজ নিজ হার্ডলাইন থেকে সরে আসতে হবে। কক্সবাজারের সার্বিক কল্যান নিয়ে, নতুন প্রজন্মের বিষয়টি মাথায় রেখে যৌক্তিক, গঠনমূলক, ইতিবাচক ও দূরদর্শী চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কক্সবাজারের একজন মাননীয় হুইপ সহ ৪ জন মান্যবর সংসদ সদস্য রয়েছেন।

কক্সবাজারের কৃতি ও মেধাবী সন্তানেরা এখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-বেসামরিক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। কক্সবাজারের বিজ্ঞ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনরত বিজ্ঞ বিচারকগণ, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত কার্যকরী পরিষদ, অন্যান্য আইনজীবী নেতৃবৃন্দ, কক্সবাজার জেলার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত কক্সবাজারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও রয়েছেন। এঁদের অনেকেই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

তাঁরা প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে একই গন্তব্যকে টার্গেট করে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালান, তাহলে এ কঠিন কাজটি সহজে সমাধান করা সম্ভব। তাঁরা যদি বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় প্রধান বিচারপতি, মাননীয় আইনমন্ত্রী, মাননীয় আইন সচিব সহ সরকারের উর্ধ্বতন সংশ্লিষ্ট সকলকে বুঝাতে সক্ষম হন, তবেই দুরত্ববিহীন যৌক্তিক স্থানে বর্তমান আদালত পাড়ায় সহসায় একটি নতুন সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ করা যাবে। যেটা কক্সবাজারবাসী ও জেলা বিচার বিভাগের জন্য খুবই জরুরী ও অত্যাবশ্যক। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সময় থাকতেই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। এ উদ্যোগ নিতে হবে কোন ধরনের কালবিলম্ব নাকরেই।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ প্রবন্ধটি একান্তই নিজস্ব মতামত। নিজস্ব চিন্তা থেকেই এ উপলব্ধি। একজন আইনজীবী হিসাবেও এ প্রবন্ধটি লিখিনি। কিংবা আইনজীবীদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে এ প্রবন্ধ লেখা হয়নি। আশা করছি, সকল পক্ষ প্রবন্ধটির উপজীব্যকে গুরুত্ব দিয়ে স্বাভাবিকভাবে নেবেন।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, সদস্য-কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, কলামিস্ট এবং সাংবাদিক।