ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জুলফিকার হায়াত সোমবার (১৩ মে) এ রায় দেন।
তবে এরই মধ্যে এ মামলায় আসামি ২১ মাস কারাভোগ করেছেন। রায়ে বিচারক উল্লেখ করেছেন, পাঁচ বছরের সাজা থেকে আসামির ২১ মাসের কারাভোগের সময় বাদ যাবে। অর্থাৎ এই ২১ মাস সময়কে পাঁচ বছরের সাজা আওতায় ধরা হবে।
এদিকে তিথি সরকারকে আট শর্তে এক বছরের জন্য প্রবেশনে রাখার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই এক বছরে যদি তিনি আচরণগত পরিবর্তনসহ শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে তাকে আর সাজা খাটতে হবে না। আর শর্ত ভঙ্গ হলে পূর্ণ সাজা ভোগ করতে হবে।
ওই ট্রাইব্যুনালের স্টেনোগ্রাফার মামুন শিকদার গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আসামি তিথি সরকার দোষ স্বীকার করে প্রবেশনে দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন। আদালত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে এক বছরের জন্য প্রবেশনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন।
তিথি সরকারকে প্রবেশনে দেওয়ার আদেশে বলা হয়েছে, আসামি এক বছর প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে থাকবেন। সামাজিক নিয়মকানুন, প্রথা ও রীতিনীতি মেনে চলবেন।
যেসব শর্তে প্রবেশন পেলেন তিথি
আসামি তিথি সরকারকে অপরাধী প্রবেশন অধ্যাদেশ, ১৯৬০ (১৯৬০ সালের ৪৫ নম্বর অধ্যাদেশ) এর ৫ ধারা মোতাবেক, আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়কালের জন্য প্রবেশন আদেশের নিম্নোক্ত শর্তাবলিযুক্ত মুচলেকা সই করার শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দেওয়ার আদেশ জারি করা হয়েছে। তিনি আট শর্তে মুচলেকায় সই করে মুক্তি পান।
শর্তসমূহ হলো-
(১) আসামি-প্রবেশনার আগামী এক বছর সময়ের জন্য প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে থাকবেন এবং ওই কর্মকর্তার নিদের্শনাসমূহ মেনে চলবেন।
(২) ওই সময়সহ আসামি-প্রবেশনার ভবিষ্যতেও আর কোনো অপরাধে জড়াবেন না, শান্তি বজায় রাখবেন ও সদাচরণ করবেন।
(৩) বয়োবৃদ্ধ বাবার নিয়মিত দেখভাল ও সেবাযত্ন করতে হবে।
(৪) আদালত, প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তলবমতে আসামি-প্রবেশনার যথাসময়ে হাজির হবেন।
(৫) শহর এলাকায় বসবাসের ক্ষেত্রে ট্রাফিক আইন মেনে চলাসহ আইনবহির্ভূতভাবে রাস্তা পারাপার করা যাবে না, সামাজিক নিয়ম-কানুন, প্রথা, রীতিনীতি প্রভৃতি মেনে চলবেন, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজ করবেন না; প্রবেশন কর্মকর্তার অনুমতি ব্যতীত নিজস্ব কর্মস্থল বা বাসস্থান ত্যাগ করবেন না; এবং প্রবেশন কর্মকর্তার যে কোনো সময় আসামির গৃহ পরিদর্শন করতে আসামি-প্রবেশনার বা তার পরিবারের সদস্যদের কোনো আপত্তি থাকবে না।
(৬) আসামি-প্রবেশনার অযথা রাতের বেলা ঘরের বাইরে অবস্থান করবেন না; মাদকদ্রব্য গ্রহণ, বিশেষত মাদকদ্রব্য বিক্রি ও সরবরাহ করা হয় এমন স্থানে যাতায়াত করবেন না; ধূমপান থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন; এবং জুয়া, অনলাইন জুয়া, তাস, ক্যাসিনো, বাজি ইত্যাদি থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন।
(৭) আসামি-প্রবেশনার প্রবেশনকালীন কোনো ধরনের স্মার্ট মোবাইল ফোন ব্যবহার করবেন না; প্রয়োজন হলে নন-স্মার্ট মোবাইল ফোন বা বাটন ফোন ব্যবহার করবেন। তবে শিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে স্মার্ট ফোন ব্যবহারের আবশ্যকতা দেখা দিলে আসামি-প্রবেশনার তার মা-বাবা অথবা অন্য কোনো প্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয়, অথবা ক্ষেত্রমতে শিক্ষকের উপস্থিতিতে শুধু স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারবেন।
(৮) উপর্যুক্ত যে কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আসামি-প্রবেশনার নিজেকে সংশোধন না করলে আসামির প্রবেশন আদেশ বাতিল হবে এবং প্রমাণিত অপরাধের দায়ে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৮(২) ধারায় পাঁচ বছর কারাভোগ করতে হবে।
রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য
এ বিষয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী তিথি সরকারের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
তিনি আরও বলেন, তিথির আইনজীবী প্রবেশন চেয়ে আবেদন করলে আদালত এক বছরের জন্য কিছু শর্তে তাকে প্রবেশনে মুক্তির আদেশ দেন। এই এক বছরে তাকে শর্তসমূহ মেনে চলতে হবে। শর্ত মানলে আদালত বিবেচনা করবেন তাকে আর সাজা খাটতে হবে কি না। আর শর্ত না মানলে তাকে সাজা খাটতে হবে।
তিথির আইনজীবী বাবুলুর রহমান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তিথি সরকার নিজের ভুল স্বীকার করে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য আদালতের কাছে সুযোগ চান। এর আগে তিনি ২১ মাস জেল খেটেছেন।
আইনজীবী বাবুলুর রহমান বলেন, সব কিছু বিবেচনা করে আদালত তাকে সংশোধনের জন্য এক বছরের প্রবেশন দেন। এই এক বছরে যদি তিনি আচরণগত পরিবর্তনসহ শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে তাকে আর সাজা খাটতে হবে না। আর শর্ত ভঙ্গ হলে পূর্ণ সাজা ভোগ করতে হবে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ অক্টোবর সিআইডির সাইবার মনিটরিং টিম দেখতে পায়, সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ের চারতলা থেকে তিথি সরকারকে ‘হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে’ বলে একটি মিথ্যা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হয়। যা তখন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে সিআইডিতে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এ ঘটনার তদন্তে নেমে গুজব রটনাকারী নিরঞ্জন বড়াল নামের একজনকে রামপুরার বনশ্রী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। নিরঞ্জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওই বছরের নভেম্বর মাসে পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়।
২০২১ সালের ১৯ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের উপ-পরিদর্শক মেহেদী হাসান তাদের দুজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। একই বছরের ৪ নভেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন তিথির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
অন্যদিকে তিথি সরকারের স্বামী শিপলু মল্লিককে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। বিচারকাজ চলাকালে এ মামলায় ছয়জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
প্রবেশন কি
কোনো অপরাধীকে প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে (স্থগিত রেখে), কারাবন্দী না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে ‘প্রবেশন’। এ ব্যবস্থায় আদালতের নির্দেশে প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে এবং শর্ত সাপেক্ষে পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান আবেদনকারী। প্রবেশন কর্মকর্তার পদটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন।
প্রবেশন আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, পুরুষ আসামিরা মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত না হলে প্রবেশন পেতে পারেন। আর নারী আসামিরা মৃত্যুদণ্ড বাদে যেকোনো দণ্ডের ক্ষেত্রে পেতে পারেন প্রবেশন।
প্রবেশন দেওয়ার শর্তের মধ্যে সাধারণত মুক্তিযুদ্ধের বই পড়া, বৃক্ষরোপণ, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, মাদকবিরোধী শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো আচরণ, বিনা মূল্যে গান শেখানো, এতিমদের খাবার সরবরাহ, সৎভাবে জীবনযাপন ও মা-বাবার সেবা করার মতো কাজ করতে বলা হয়ে থাকে।