চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা!

যৌতুক মামলা জৌলুস হারিয়েছে!

সিরাজ প্রামাণিক: স্ত্রীরা কথায় কথায় স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করার ভয় দেখায়। স্ত্রীদের কাছে একটি সহজ হাতিয়ার হলো যৌতুকের মামলা। সোজা কোর্টে গিয়ে নালিশী আরজির মাধ্যমে জানান, ‘‘স্বামী আমার কাছে যৌতুক চেয়ে না পেয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে, মারধর করেছে, নির্যাতন করেছে ইত্যাদি’’। আবার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর স্ত্রী তালাকের নোটিশ পেয়ে কিংবা নোটিশ নোটিশ গ্রহণ না করে কিংবা তালাক সম্পর্কে জানতে পেরে স্বামীর বিরুদ্ধে টুকে দেয় যৌতুকের মামলা। কিন্তু এ জাতীয় যৌতুকের মামলা আর মানুষ আগের মতো বিশ্বাস করে না।

মনে রাখবেন, যৌতুকের মামলা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবাহ বলবৎ থাকতে হবে। তালাকের পর দেনমোহর মামলার ক্ষেত্রে আইনী বাঁধা নেই। তবে যৌতুকের মামলার জন্য বিবাহ বলবৎ থাকা জরুরি।

এ ব্যাপারে মোসাম্মৎ উম্মে কুলসুম জিনাল আরা বনাম শাহিদুল এবং অন্যান্য মামলা, যা ২ এলএনজে, ২০১৩, ২৩৫ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(খ) ধারার অধীনে করা হয়; অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করা হয়েছে বলে মামলাটি করা হয়। আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়, মামলাটি করার আগে পক্ষদ্বয়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে এবং বিচ্ছেদ—সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, বিচ্ছেদের পর যৌতুকের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

উচ্চ আদালতের আরও দুটি সিদ্ধান্ত যা রওশন আরা বেগম বনাম মো. মিজানুর রহমান ও অন্যান্য, হাইকোর্ট বিভাগ, ১২ এডিসি, পৃষ্ঠা—৯৬ এবং রাষ্ট্র বনাম মো. রফিজুল হক, ৬ এএলআর (এডি), ভলিউম—২, পৃষ্ঠা—৯০। হাইকোর্ট এ মামলায় পর্যবেক্ষণে বলছেন—বিবাহ বিচ্ছেদ আগেই হয়েছে। কাজেই কজ অব অ্যাকশনের দিনে ভিকটিমকে তার স্বামীর বাড়িতে থাকার কথা নয়; কিন্তু এ জাতীয় একটি মামলায় ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫(সি) ধারামতে অব্যাহতির আদেশ চেয়ে করা আবেদনটি খারিজ করে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে।

আরও পড়ুন: স্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা দায়ের করা যাবে?

আসামিপক্ষ উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন দাখিল করেন। হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে উক্ত অভিযোগ গঠন বাতিল করে আসামিকে অব্যাহতি দেন। এরপর বাদী (রাষ্ট্র) পক্ষ হাইকোর্টের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগ সাক্ষ্য ও তথ্য—উপাত্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেয় যে, অভিযুক্ত স্বামীকে খালাস দেয়ার হাইকোর্টের আদেশ সঠিক। কাজেই স্বামী—স্ত্রীর মধ্যে একেবারেই বনিবনা না হলে স্ত্রীকে সঠিক নিয়ম মেনে তালাক দেয়ার পর স্ত্রী কর্তৃক মিথ্যা যৌতুকের মামলার ফলাফল বাদীর পক্ষে প্রমাণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।

কাজেই আপনি যদি স্ত্রী কর্তৃক মিথ্যা মামলার শিকার হয়েই যান, তাহলে আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মামলাটি লড়ে যেতে হবে। এজাহারের কপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। যদি এমন হয় যে, আপনি জানতে পারলেন না আর হঠাৎ পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল, তাহলে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে।

তখন আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে। যদি দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিক থাকে, তাহলে মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই মিলবে। মামলা থেকে পালিয়ে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে আপনার অনুপস্থিতিতেই সাজা হয়ে যেতে পারে।

আরেকটি কেস স্টাডি থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সালমা সুলতানা নামের এক নারীর সঙ্গে শফিকুর রহমানের বিয়ে হয়। সালমা ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর স্বামীর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টে্রট আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় মামলা করেন। মামলায় বাদী পক্ষে উল্লেখ করেন, বিয়ের কিছুদিন পরই সালমা বুঝতে পারেন তার স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ ও হতাশাগ্রস্থ। তিনি (সালমা) শ্বশুর—শাশুড়িকে বিষয়টি জানান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেন।

কিন্তু শফিকুর জানান, তিনি অসুস্থ কিংবা হতাশাগ্রস্ত নন। সালমা মনে করেন, তার স্বামী পরধন লোভী। সে জন্যই ব্যবসার কথা বলে তার (সালমা) কাছে পাঁচ লাখ টাকা চান। বাবার বাড়ি থেকে ওই টাকা এনে দিতে অস্বীকার করায় তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে সালমা বাবার বাড়ি চলে যান। কিছুদিন পর তাকে ফিরিয়ে আনেন শফিকুর। কিন্তু তার (শফিকুর) স্বভাব পরিবর্তন হয় না। ২০০৯ সালের ২০ মে আবার পাঁচ লাখ টাকা এনে দিতে চাপ দেন। এবার শফিকুর বলেন, তিনি ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান।

আরও পড়ুন: ‘যৌতুক প্রথা নয় সামাজিক ব্যাধি’ -আইনী পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান

সালমা ফের টাকা এনে দিতে অস্বীকার করেন। এতে তাকে নির্যাতন করা হয়। সালমা স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে বাবার বাড়ি যেতে বাধ্য হন। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর সালমার বাবার বাড়ি গিয়ে একই পরিমাণ টাকা দাবি করেন শফিকুর। টাকা না দিলে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন। পরে বাধ্য হয়ে সালমা তার (শফিকুর) বিরুদ্ধে মামলা করেন।

নিম্নআদালত শফিকুরের বিরুদ্ধে মামলটি আমলে নেন। পরে মামলা বিচারের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্টে্রট—১৮—তে স্থানান্তর করলে বিচারক আসামি শফিকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। শফিকুর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা বেআইনি হয়েছে উল্লেখ করে মামলা কার্যক্রম বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে ফৌজদারি বিবিধ মামলা করেন। প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট কেন মামলার কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে রুল জারি করেন।

সেই রুলের শুনানি শেষে আদালত রায় দেয়।  আদালত রায়ে বলেছেন—আইনে স্পষ্ট রয়েছে, বিয়ের সময়কার শর্ত হিসেবে বিয়ের মজলিসে কিংবা বিয়ের আগে অথবা পরে কোনো সময় অর্থ—সম্পদ দাবি করা হলে তবে তা যৌতুক হিসেব গণ্য হবে। (এনএম শফিকুর রহমান বনাম রাষ্ট্র, ৭ এএলআর, পৃষ্ঠা ৩১৩)।

আরেকটি কথা মনে রাখবেন, যৌতুকের মামলা শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নয়। স্ত্রীও যদি বিয়ের শর্ত হিসেবে দেনমোহর ব্যতীত অন্যান্য অর্থসম্পদ দাবি করলেও সেটা যৌতুক এবং এর জন্য প্রচলিত আইনের অধীনে আদালতে মামলা করা যায়। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, যৌতুকের জন্য মিথ্যা অভিযোগ করলে সেই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আবার ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির অধীনেও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলা করলে তার জন্য শাস্তি হবে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে এ ধারার অধীনে মামলা করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারবেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।