'যৌতুক প্রথা নয় সামাজিক ব্যাধি' -আইনী পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান
অ্যাডভোকেট মনজিলা সুলতানা

‘যৌতুক প্রথা নয় সামাজিক ব্যাধি’ -আইনী পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান

মনজিলা সুলতানা ঝুমা : আমাদের পারিবারিক ও সমাজ জীবনে, এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনেও ভয়াবহ এক অভিশাপ হিসেবে বিরাজ করছে যৌতুক প্রথা। আজকাল পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে চোখে পরে তা হলো যৌতুক প্রথার বলি নারী। যৌতুক প্রথা বাংলাদেশে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক অমানবিক ও বেদনাদায়ক সমস্যা।

আমাদের দেশে যৌতুক হল এমন একটি সামাজিক কু-প্রথা যাতে কন্যা পাত্রস্থ করার সময় কনে ও বরপক্ষের মধ্যে দরকষাকষির মাধ্যমে বরপক্ষকে নগদ অর্থ, দ্রব্যসামগ্রী বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা দানে কন্যাপক্ষকে বাধ্য করা হয়। যৌতুকের দাবীকে কেন্দ্র করে বিয়ের পর দাম্পত্য কলহ, স্ত্রী-নির্যাতন, স্ত্রী-হত্যা, বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। কন্যাদায়গ্রত দরিদ্র পিতামাতা যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে সর্বস্ব বিক্রি করে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এক সময় এটা একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল৷ কিন্তু এখন এটা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সবার মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে৷

যৌতুক কি এবং বিভিন্ন আইনে এর সংজ্ঞায়ন

যৌতুক একটি বাংলা শব্দ, এর প্রতিশব্দ পণ। এই শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। যার বাংলা অর্থ বিবাহকালে বর বা কন্যাকে প্রদত্ত ধনসামগ্রী। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে- বিবাহের চুক্তি অনুসারে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বা বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে যে সম্পত্তি বা অর্থ দেয় তাকে যৌতুক বা পণ বলে।

যৌতুক আইনে যৌতুকের সংজ্ঞা

যৌতুক নিরোধ আইন,২০১৮ এর ধারা ২(খ) মতে ‘‘যৌতুক’’ অর্থ বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসাবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহের পণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বা বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষেকে প্রদত্ত বা প্রদানের জন্য সম্মত কোনো অর্থ-সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ।

তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ্) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন, ২০০৩ (সংশোধিত) এর ধারা ২ অনুযায়ী

যৌতুকের অর্থ- (অ) কোন বিবাহে বর বা বরের পিতামাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসেবে বিবাহের অন্য পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রি বা অন্যবিধ সম্পদ। অথবা (আ) কোন বিবাহের কনেপক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সাথে জড়িত বরপক্ষের অন্য কোন ব্যক্তিকে উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপরে বা বৈবাহিক সর্ম্পক বিদ্যমান থাকাকালে বিবাহ স্থির থাকার শর্তে বিবাহের পণ হিসাবে প্রদত্ত বা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ।

যৌতুক প্রথা নয় বরং সামাজিক ব্যাধি

প্রথা হলো যা যুগে যুগে কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর রেওয়াজ অনুযায়ী চলে আসছে কিন্তু যৌতুক তা নয়। বরং এটি অবশ্যই সামাজিক ব্যাধি৷ আমাদের সমাজে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গি তো বদলায়নি৷ বিয়েতে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত আছে৷ বাংলাদেশে কিন্তু যৌতুকবিরোধী আইন আছে৷ অথচ যারা যৌতুক দিচ্ছে এবং নিচ্ছে তারা কিন্তু এই আইনের তোয়াক্কা করছে না৷ তবে আইনের ফাঁক-ফোকর রয়েছে৷

উচ্চবিত্ত পরিবারেও নানা কৌশলে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া হচ্ছে৷ শিক্ষিত সচেতন নাগরিকরাও তো যৌতুক দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন৷ যৌতুক দেয়া বেয়ার ধরণ বদলালেও এর প্রভাব সমাজে কমেনি বরং দিন দিন এর ভয়াবহ প্রভাব বেড়েই চলেছে৷ যদি বলা হয় যৌতুকের কারণ কি তবে বলা যায় মানুষের প্রচণ্ড অর্থ লালসা থেকেই যৌতুক প্রথার সৃষ্টি। দারিদ্র্য ও স্বল্প সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার কামনাও যৌতুক প্রথা বৃদ্ধি হওয়ার কারণগুলোর একটি অন্যতম বড় কারণ। বেকারত্ব, হতাশা এবং সঠিক নৈতিক শিক্ষার সঙ্কটেও যৌতুকের প্রসার এতটা ভয়াবহতায় পৌঁছাচ্ছে। এ ছাড়া কুসংস্কারে আচ্ছন্নতা ও উচ্চভিলাষী মনমানসিকতাও এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

যৌতুক দাবী, গ্রহণসহ বিভিন্ন আইনে যৌতুক সংক্রান্ত শাস্তি

২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায়। এখানে বলা হয়েছে, যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, সেটা হবে এ আইনের অধীনে অপরাধ। যৌতুক দাবি করিবার দণ্ড -অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ, ইত্যাদির দণ্ড

২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ, ইত্যাদির দণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া উভয়ই অপরাধ। যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করেন অথবা যৌতুক প্রদান বা গ্রহণে সহায়তা করেন বা যৌতুক প্রদান বা গ্রহণের উদ্দেশ্যে চুক্তি করেন, তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো, ইত্যাদির শাস্তি

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩ (সংশোধিত) ধারা ১১ অনুযায়ী কিছু অপরাধের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। যদি কোন নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি যৌতুকের জন্য উক্ত নারীর (ক) মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন কিংবা উক্ত নারীকে মারাত্মক জখম (grievous hurt) করেন বা সাধারণ জখম (simple hurt) করেন তাহা হইলে উক্ত স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি-

(ক) মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন;

(খ) মারাত্মক জখম (grievous hurt) করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অনধিক বার বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন;

(গ) সাধারণ জখম (simple hurt) করার জন্য অনধিক তিন বৎসর কিন্তু অন্যূন এক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।

মিথ্যা মামলা দায়ের, ইত্যাদির দণ্ড

যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারায় বলা আছে- যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা বা অভিযোগ করিবার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জানিয়াও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।

যৌতুক সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন এবং উত্তর

যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশে যৌতুক প্রথার এই পরিমাণ কি আগের চেয়ে বেড়েছে না কমছে? না কমেনি বরং বেড়েছে। যৌতুক প্রথা এখনো চলছে সেই আগের মতোই৷ অর্থাৎ কমেনি তো বটেই উলটে যৌতুক প্রথাটা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে৷ একটা সময় এটা একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল৷ কিন্তু এখন এটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে৷ তাছাড়া সকল ধর্ম-বর্ণের মধ্যে এই যৌতুক প্রথা এখন আসন গেড়ে বসেছে৷ একজন আইনজীবী হিসেবে আমার প্রায়ই যৌতুক সম্পর্কে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাই তুলে ধরলাম।

যৌতুক আইনে মামলা করতে হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকতে হবে?

এ আইনে মামলা করতে হলে অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় যে, দাম্পত্য কলহে স্ত্রী বাবার বাড়িতে চলে গেছে। স্বামী বার বার আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর স্বামী তালাক দিয়েছে। স্ত্রী তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর থানা কিংবা আদালতে গিয়ে মিথ্যা যৌতুকের মামলা করেছে। এক্ষেত্রে আসামী গ্রেফতার হলে কিংবা সমন প্রাপ্তির পর আসামীপক্ষ বিজ্ঞ আদালতে নিবেদন করেন যে, বাদিনী তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর আসামীর প্রতি রাগান্বিত ও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন।

এ বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞ আদালতের সামনে ফিরিস্তি আকারে তালাক প্রদানের নোটিশ, ডাক রশিদ, প্রাপ্তি স্বীকারসহ উপযুক্ত প্রমান পেশ করতে পারলে মাননীয় আদালত সার্বিক দিক বিবেচনা করে এবং তালাকের পর মামলা সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আসামীকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়ে থাকেন।

এই সংক্রান্ত দুটি বিখ্যাত মামলা হচ্ছে রওশন আরা বেগম বনাম মোঃ মিজানুর রহমান ও অন্যান্য, হাইকোর্ট বিভাগ, ১২ এডিসি, পৃষ্ঠা-৯৬ এবং রাষ্ট্র বনাম মোঃ রফিজুল হক, ৬ এএলআর (এডি), ভলিউম-২, পৃষ্ঠা-৯০)। সুতরাং এই কথা বলা যায় যে তালাকের পর স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও যৌতুকের মামলা করলে সেই মামলায় জামিন ও খালাস পেতে পাওয়া সম্ভব।

মুসলিম বিবাহের দেনমোহর কি যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত হবে? যৌতুক সংক্রান্ত চুক্তির কি বৈধতা আছে?

না, যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ২ এর (খ) অনুযায়ী মুসলিম বিবাহের দেনমোহর যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত নয়। শরীয়ত মোতাবেক প্রদেয় দেনমোহর, বা মোহরানা ইহার অন্তর্ভুক্ত নহে। যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে যৌতুক সংক্রান্ত চুক্তি ফলবিহীন। এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ফলবিহীন (void) হইবে। যার আইনত কোন ভিত্তি নাই।

অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিনঅযোগ্যতা, ইত্যাদি

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৭ অনুযায়ী এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য তবে আদালত চাইলে জামিন দিতে পারবে।

যৌতুকের নৃশংসতা এবং এর পরিণতি

যৌতুকের লোভে বাংলাদেশে প্রায়ই অসামঞ্জস্য বিয়ে সংঘটিত হয়ে থাকে এবং আত্মহত্যার পেছনে যৌতুক প্রথা অনেকাংশে দায়ী। বর্তমান সমাজে যৌতুক হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়াও টিভি, ফ্রিজ, ঘরের দামি আসবাবপত্র ইত্যাদিসহ ফ্ল্যাট বাড়ি বা উচ্চমানের গাড়ি দাবি করা হয়। ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর খরচ বা চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়ার চুক্তিও করা হয় যৌতুক হিসেবে। এত কিছুর পরও কন্যার বাবা দায়মুক্ত হতে পারেন না। পুনঃপুনঃ নানামুখী চাপ আসতে থাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে।

যদি মেয়ের অভিভাবক চাহিদা পূরণে পাস মার্ক পায় তাহলে বউ-মা লক্ষ্মীমা। আর যদি মেয়ের অভিভাবক অক্ষম হয় তখনই শুরু হয় নির্যাতন-নিপীড়ন ও অমানবিক অত্যাচার। বউয়ের কথাবার্তা আর যাবতীয় কার্যক্রম যেন তেতো ফলের মতো অস্পৃশ্য। শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনসহ হত্যার চক্রান্ত, কখনো অসহায় মেয়েটিকে নির্মমভাবে হত্যার শিকারও হতে হয়। হত্যার পর লাশ সিলিংফ্যানে ঝুলিয়ে রাখা হয় আত্মহত্যা প্রমাণে অথবা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় কিংবা রাতের অন্ধকারে মাটির নিচে পুঁতে দেয়া হয়; যেন লাশ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়, কাকপক্ষিও টের না পায়। এই হলো যৌতুক প্রথার বিষময় পরিণতি।

যদি প্রশ্ন করা হয় যৌতুক প্রথা শহরে না গ্রামে বেশি? এর উত্তর হবে গ্রামে বা শহরে সব জায়গাতেই এটা চলছে৷ গ্রামেরটা দৃশ্যমান৷ সেখানে বলাই হয় যে, যৌতুক না দিলে মেয়ের বিয়ে হবে না৷ বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হবে৷ কিন্তু শহরে নানান রীতিনীতিতে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া হচ্ছে৷ এখানে উচ্চবিত্তরা চাকরি, গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক নানা কায়দায় এটা চালাচ্ছে৷ যারা দিচ্ছে এবং নিচ্ছে তাদের আমরা সামাজিকভাবে বয়কট করতে পারছি না৷ আমরা যদি তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে না পারি তাহলে যৌতুক প্রথা বন্ধ করতে পারব না৷

যৌতুক প্রথা রোধে করণীয়

কোনো নারীকে যেন গৃহহীন হতে না হয়, কোনো মা-বাবা যেন মেয়ে হারানোর শোকে পাথর না হয়ে যায় এটা নিশ্চিত করতে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা বিলুপ্ত করা প্রয়োজন। সরকার ও জনসাধারণ উভয়েরই এগিয়ে আসতে হবে, নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। আইনের কঠোরতার পাশাপাশি তার বাস্তবায়নও জরুরি। সর্বস্তরে শপথ গ্রহণ করতে হবে কেউ যৌতুক নেবে না, কাউকে যৌতুক দেবেও না।

দেশে প্রচলিত যৌতুকবিরোধী আইনও যথেষ্ট কঠিন ও ফলপ্রসূ। বাংলাদেশ থেকে যৌতুক প্রথার ন্যায় অমানবিক অভিশপ্ত প্রথা উচ্ছেদের লক্ষ্যে কিছু ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সংবিধানে নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য পারিবারিক আইন, উত্তরাধিকার আইন, যৌতুক-বিরোধী আইন, নারী-নির্যাতন আইন প্রণয়ন ও সেগুলোর বাস্তবায়নের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।

যৌতুক লেনদেন একটি অভিশপ্ত প্রচলন এবং ঘৃণাজনক প্রথা। এর বিরুদ্ধে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। এ প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা জনমত গড়ে তুলতে হবে যাতে জনগণ এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।

লেখক : আইনজীবী; জেলা ও দায়রা আদালত ঢাকা এবং খাগড়াছড়ি।