যে দুটি বিষয়ের কারণে ৯ বছর ধরে শিক্ষা আইনের খসড়া ঘুরপাক খাচ্ছে, তার একটি হলো কোচিং সেন্টার। সারা দেশে কোচিং সেন্টারের বৈধতা দিয়ে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে দিনে নয়, সন্ধ্যার পর কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে। সেখানে শিক্ষকতাও করা যাবে। তবে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন না।
অবশ্য প্রস্তাবিত আইনে আরেক আলোচিত বিষয় নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধই রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ধরনের নোট বই বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। কেউ যদি তা করেন, তাহলে তাঁকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড কিনতে বা পাঠে বাধ্য করেন বা উৎসাহ দেন, তাহলে অসদাচরণের জন্য প্রশাসনিক শাস্তি ভোগ করতে হবে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, শিক্ষা আইনের খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা আশা করছেন শিগগির খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে, এরপর তা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। তবে শেষ মুহূর্তে খসড়ায় সামান্য এদিক-ওদিক হতে পারে।
কোচিং, প্রাইভেট এবং সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই শিক্ষা আইনের মাধ্যমে বন্ধ করা এবং জাতীয় শিক্ষানীতি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সাল থেকেই শিক্ষা আইন করার কাজ চলছে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হওয়ার পরের বছর শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়ন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমসাময়িক সময়ে একটি আইন করতে এত দীর্ঘ সময় লাগার উদাহরণ নেই। আইনটি না হওয়ায় জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নেও বাধ্যবাধকতা নেই।
অভিযোগ আছে, কোচিং, প্রাইভেট এবং নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বইয়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি পক্ষের নানামুখী তৎপরতায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একবার শিক্ষা আইনের ‘দুর্বল’ খসড়া করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে ‘ছায়া শিক্ষার’ নামে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনের বৈধতা দেওয়ার কথা ছিল। একই সঙ্গে সহায়ক বা অনুশীলন বই প্রকাশেরও সুযোগ রাখা হয়েছিল। তখন ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য ফেরত আনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় ১০ মাস পর্যালোচনা করে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে খসড়াটি চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৮০ সালে করা একটি আইনেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদে আবারও খসড়াটি পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য সাবেক সচিব হাবিউল আওয়ালকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, পর্যালোচনা করে খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে অভিভাবকদের লিখিত সম্মতি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত সময়ের পরে বা আগে নীতিমালা বা নির্বাহী আদেশ অনুসরণ করে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা যাবে। বর্তমানেও এই নিয়ম চালু আছে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করাতে পারবেন না। এটি করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।
কোচিং সেন্টারের বিষয়ে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের জন্য কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা নিষিদ্ধ গণ্য হবে না। তবে শর্ত হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালীন সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত দিনে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে না। তা করা হলে ওই কোচিং সেন্টারের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হবে। কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাতে পারবেন না।
অ্যাসোসিয়েশন অব শ্যাডো এডুকেশন বাংলাদেশের যুগ্ম–আহ্বায়ক মাহমুদুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোচিং সেন্টার সম্পর্কে এই প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানাই। সন্ধ্যার পর কোচিং সেন্টার চলবে কি না, এটা তাঁদের ভাবনার বিষয় নয়। গুরুত্ব ও চাহিদা থাকলে মা-বাবা সন্তানকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে আসবেন।’ তাঁর মতে, শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোচিং সেন্টারের গুরুত্ব থাকবে।
তবে সন্ধ্যায় কোচিং সেন্টার চালু রাখা হলে সমস্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকেরা। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির বলেন, সন্ধ্যার পর কোচিংয়ের সুযোগ রাখা হলে এগুলোতে পড়াশোনা তো হবেই না, বরং শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যায় পড়তে পারে, বিশেষ করে ছাত্রীদের বেশি সমস্যা হতে পারে। তাঁরা চান সব ধরনের কোচিং এবং নোট-গাইড বই নিষিদ্ধ করেই আইন করা হোক। না হলে শিক্ষা-বাণিজ্য বাড়বে।
শিক্ষকদের কেউ কেউ আবার মনে করেন, শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়া ঠিকমতো না হওয়ায় অভিভাবকেরা সন্তানকে কোচিং সেন্টারে পাঠান, নোট-গাইড বা অনুশীলন বই কিনে দেন। যদিও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, শিক্ষকদের অনেকেই শিক্ষার্থীদের কোচিং এবং নোট-গাইড পড়াতে বাধ্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথমত, কোচিং সেন্টার পরিচালনাকে কোনোভাবেই উৎসাহ দেওয়া যাবে না। কিন্তু মূল সমস্যা হলো বর্তমানে পরীক্ষানির্ভর যে মূল্যায়ন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সে কারণে কোচিং, নোট-গাইড ইত্যাদি পার্শ্ব বিষয় হিসেবে চলে আসছে। তাই শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষার মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে শিক্ষা-বাণিজ্যের অবসান ঘটাতে হবে।
আরও যা আছে প্রস্তাবিত আইনে
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দিতে পারবেন না। এ ছাড়া এমন আচরণ বা ভর্ৎসনা করবেন না, যা ওই শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। অবশ্য এ বিষয়ে শিক্ষকদের কিছুটা সুরক্ষাও দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়, শিক্ষার্থীর মঙ্গল বিবেচনায় শিক্ষার্থীকে নমনীয়ভাবে বা সহনীয়ভাবে শাসন করা যাবে। কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীর কল্যাণ বিবেচনা করে সরল বিশ্বাসে যৌক্তিকভাবে শাসন করলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী হবেন না।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সরকার সময়ে সময়ে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার স্তর নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ করতে পারবে। আর সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হবে এবং তা শিশুর মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য হবে। আর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করবে। আর পুনর্নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর বর্তমানের মতো ষষ্ঠ ও দশম শ্রেণি পর্যন্তই থাকবে। আর একাদশ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক স্তরই থাকছে। উল্লেখ, জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলা আছে।
বিদেশি পাঠ্যক্রমের আওতায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে সাধারণ ধারার সমপর্যায়ের বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ ও সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত বিষয়গুলো বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
উচ্চশিক্ষা স্তরের সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতনসহ অন্যান্য ফি সরকার বা সরকার-নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের (যেমন ইউজিসি) অনুমোদনে নির্ধারিত হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য গঠিত পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান নির্ধারিত এখতিয়ারের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন প্রশাসনে বা পাঠদানে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এটি করলে কমিটি বাতিল বা চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা যাবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, এই আইনে অধীন অপরাধগুলো আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হবে। প্রস্তাবিত আইনে অনেক বিষয় থাকলেও মূলত আলোচনায় রয়েছে নোট-গাইড ও কোচিং সেন্টার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, নোট-গাইড নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ ইতিবাচক। কিন্তু কোচিং-বাণিজ্য চালু রেখে নোট-গাইড নিষিদ্ধ করে লাভ হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনা প্রতিষ্ঠানেই হওয়া উচিত। যত দিন কোচিংয়ের ওপর নির্ভরতা থাকবে, তত দিন বিদ্যালয়ের পড়া বিদ্যালয়ে হবে না। তাই নোট-গাইড বন্ধের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারও বন্ধ করা উচিত। সূত্র: প্রথম আলো