নির্বাচনি দায়িত্বপালনকালে কুষ্টিয়ার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে পুলিশ সুপারের (এসপি) ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণের একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষীকে নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আজ বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদেশে পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) প্রিজাইডিং অফিসার ও তার পরিবারের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দেন।
পুলিশ সুপার ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে সংগঠিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনের সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার নিরপাত্তা চেয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালত এ আদেশ দেন।
ওই প্রিজাইডিং অফিসার হলেন, স্থানীয় উপজেলার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন। অন্যদিকে প্রিজাইডিং অফিসার মো. শাহজাহান আলীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘ভার্চুয়াল কোর্টে সংযুক্ত হয়ে তিনি (মো. শাহজাহান আলী) অভিযোগ করেছেন, গতকাল কিছু লোকজন এসে তাকে নিয়ে গিয়ে কিছু কাগজপত্রে সই নিয়েছেন।’
আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রিজাইডিং অফিসার নিরাপত্তা চেয়েছেন। আদালত আগামী ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত অফিসার ও তার পরিবারের নিরাপত্তা বিধানের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচন চলাকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসানের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের ঘটনায় বুধবার (২০ জানুয়ারি) বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম তানভীর আরাফাতকে তলব করেন।
আগামী ২৫ জানুয়ারি তাকে হাইকোর্টে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন। তার একদিন পর আজ বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা চেয়ে আদালতে যুক্ত হন ওই প্রিজাইডিং অফিসার।
উল্লেখ্য, গত ১৬ জানুয়ারি কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসানের সঙ্গে পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাতের দুর্ব্যবহারের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেন।
বিষয়টি অবগত করার জন্যে ওই আবেদনের কপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওই একই অনুলিপি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজির) দফতরেও পাঠানো হয়েছে।
আবেদনে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহসিন হাসান বলেছেন, ‘কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে ১৪ জানুয়ারি হতে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। এরপর ১৬ জানুয়ারি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সকাল ১০টায় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অবস্থানকালে এক ভোটারের অভিযোগের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করি। সেখানে কতিপয় ব্যক্তিকে ভোটকেন্দ্রের বুথের ভেতর লম্বা বেঞ্চে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে বসে থাকতে দেখি। তখন তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে বললে তারা পরিচয়পত্র না দেখিয়ে প্রিজাইডিং অফিসার স্বাক্ষরিত এ ফোর সাইজের কাগজ দেখান। আমি সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বুথের বাইরে ডাকি। কথা বলা শুরু করতেই ভোটকেন্দ্রে ৪০/৫০ জন ফোর্সসহ কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত প্রবেশ করেন।’
‘তিনি প্রবেশ করেই প্রিজাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ফোর্স প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সঙ্গে কথা বলতে না দিয়েই তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং তাদের চাপাচাপি করেন। তখন আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বলি প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে একটি বিষয়ে কথা বলছি। কথা শেষ হলে উনাকে নিয়ে যান।’
‘এরপরেও এএসপি মোস্তাফিজুর রহমান ধমক দিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত আমার দিকে অগ্রসর হন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করেন আপনি কে? কি করেন এখানে? আমি আমার পরিচয় দিলে তিনি আরও ক্ষিপ্তস্বরে বলেন, আপনি এখানে কি করেন? বেয়াদব, বের হয়ে যান এখান থেকে। আমি পুলিশ সুপার ও তার ফোর্সদের আক্রমণাত্মক, চরম অসৌজন্যমূলক ও মারমুখী আচরণে হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি।’
‘এরপর এসপিসহ তার সঙ্গীয় ফোর্স আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে উদ্দেশ্যে করে একাধিকবার বলেন, এসব লোককে কে পাঠায়? বেয়াদব ছেলে। এখানে কাজ কি আপনার? বের হয়ে যান এখান থেকে। তারা কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়ার পর আমি বিষয়টি ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করি।’
আবেদনে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ সুপার ও তার সঙ্গীয় ফোর্সদের আচরণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ২০১০-এর ৬৯, ৭০, ৭৪, ৮০ ও ৮১ বিধির সরাসরি লঙ্ঘন। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রার্থনা করছি। এরপর ১৯ জানুয়ারি রাতে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।’
ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আসার পরে সেই এসপিকে তলব করেন হাইকোর্ট। ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিধিমালা ‘লঙ্ঘনের’ অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতকে।