পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে মাস খানেক আগেই বিচ্ছেদ হয়েছে এক দম্পতির। এরপর স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে যৌতুক মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। ওই মামলার শুনানিতে আদালতে ঘটল অন্য ঘটনা। মলিন মুখে আদালতে আসা দম্পতি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে একে অন্যের হয়ে বাড়ি ফিরলেন। রাজি হলেন আবার সংসার করতে। প্রত্যাহার করলেন তালাক। ঘটনার আকস্মিকতায় কাঁদলেন বিচারকও। পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) মতিউর রহমানের আদালতে গত ৫ জানুয়ারি এমন ঘটনা ঘটে।
আদালতে এই নজির স্থাপন করা বিচারক মতিউর রহমান শেয়ার করেছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। তার রায়ে কেঁদেছে হাজারো মানুষ। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া পোস্টে আবেগাপ্লুত হয়ে কমেন্টে বিচারককে সাধুবাদ জানিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেছে সব পাঠক। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য বিচারক মতিউর রহমানের ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হল –
মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছে বাদিনী মনিরা বেগম।
জবানবন্দি দিতে আদালতের কর্মচারীর সহায়তায় হলফ পড়ছে “যাহা বলিব সত্য বলিব সত্য ব্যতিত মিথ্যা বলিব না, কোন কথা গোপন করিব না।”
স্যার আমি মামলাটি প্রত্যাহার চাই।
– মামলা চালাবেন না আর?
প্রশ্ন করি আমি।
উনার সাথে আমার মিটমাট হয়ে গেছে উত্তর দেয় বাদীনি।
-কিভাবে মিটমাট হলো,
সংসার করছেন?
-না স্যার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
কতদিন হল ছাড়াছাড়ি হওয়ার?
-প্রায় এক মাস।
বাদিনীর সাথে কথা বলার সাথে সাথে আরজির পাতায় পাতায় চোখ চলছে নির্নিমেষ গতিতে। তৃতীয় পাতায় মনিরার তিন বছরের শিশু সন্তানের জায়গায় এসে চোখ আটকে যায় আমার।
-বাচ্চাটি কোথায়?
-ওরা নিয়ে নিয়েছে।
-আপনি নিলেন না কেন?
-আমাকে দেয়নি।
মুহূর্তেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মনিরার সদ্য সাবেক স্বামীর দিকে চোখ তুলে দেখি তার কোলেও বাচ্চা নেই।
স্বামীকে জিজ্ঞেস করি আলভী কোথায়?
– বাইরে আমার মায়ের কোলে; আসামির সাহসিকতাপূর্ণ উত্তর।
‘আদালত বাচ্চাটিকে দেখতে চায় ভিতরে আনা হোক’ বলে খুব আদেশ দিতে ইচ্ছে করে আমার।
কিছুক্ষণ পরে আলভী তার দাদির কোলে চড়ে আদালতে প্রবেশ করে।
প্রচণ্ড ঠান্ডায় আর কনকনে শীতে আলভীর মুখ কালো হয়ে গেছে।
একবার আলভীর দিকে আর একবার তার বাবা-মার দিকে পুনঃ পুনঃ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি।
কাউকে কিছু বলতে পারি না আর।
আলভীর মাকে জিজ্ঞেস করি- সংসারটা হলো না কেন?
– স্যার ওরা খালি যৌতুক চায় আর মারে।
একই কথা বলি আলভীর বাবাকে সে বলে আমি যৌতুক চাই নি স্যার। সে খালি কারণে-অকারণে বাপের বাড়ি চলে যায়, কথা শুনতে চায় না।
এবার উভয়কেই জিজ্ঞেস করি- আলভীর কি দোষ?
কেউ কোনো জবাব দিতে পারে না। আদালতে তখন পিনপতন নীরবতা। আলভীর দাদিকে বলি আলভীকে তার মায়ের কোলে দিতে।
মাকে দেখতে পেয়ে দুই হাত প্রসারিত করে আলভী। কোলে চড়ে মায়ের গাল নাড়তে থাকে, বুকে মাথা রাখে আর একটু করে হাসে। তৃপ্তির হাসি। মনে হয় পানি থেকে ডাঙ্গায় থেকে তুলে আনা মাছ আবার লাফিয়ে পানিতে চলে গেল। আমার চোখ আর কিছুতেই বাধা মানে না। লোকভর্তি আদালতে বেশ কয়েকবার কেঁদেছি আমি। কিন্তু সেটা নিরবে। চোখের পানি অনেকবার আড়াল করার চেষ্টা করেও আর পারা গেল না। আদালতের মাইক্রোফোনের সুইচ অফ করে মাথা নিচু করে চুপচাপ থাকলাম কিছুক্ষণ।
আলভী তার মায়ের কোলে খেলা করছে। ওর বাবা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট পাঁচেক পরে আলভীর বাবা-মাকে বিনয়ের সুরে বলি- সংসারে সামান্য ছোটখাটো ঝগড়ার কারণে আলভী খুব কষ্ট পাচ্ছে। আপনারা আলভীকে কষ্ট দেবেন না।
কান্না সংক্রামক। আলভীর বাবা- মাও কাঁদতে থাকে।
মুখ তুলে আকাশের পানে চেয়ে বলি হে প্রভু আমাকে সাহায্য করো আর সাহায্য করো এই ছোট আলভীকে।
অবশেষে তাঁরা আবার সংসার করতে রাজি হয়।কয়েকজন আইনজীবী এগিয়ে আসে, আমাকে সহায়তা করে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তালাক দেয়া আলভীর বাবা এসে হাত ধরে মনিরার। আমার সাথে সাথে বলে- “আমি তালাক প্রত্যাহার করলাম তোমাকে ফিরিয়ে নিলাম।”
খুশিতে আলভী বাবা-মা দুজনের গলা জড়িয়ে ধরে।
মামলা নয়, তালাক প্রত্যাহার হল।
অন্যান্য মামলার শুনানি শেষে প্রায় দুই ঘন্টা পরে আদালত থেকে নেমে কোর্টের নাজিরকে সাথে নিয়ে সোজা চলে যাই বাজারে। আলভীর জন্য একটা সোয়েটার কিনি। ফিরে এসে দেখি আলভী ওর মা বাবার সাথে চলে গেছে…
আলভীকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ খারাপ লাগে আমার। আলভী মনে হয় এখন খেলা করছে ওর বাবা-মার সাথে। আলভীকে দেখতে পেতে আমাকে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে, মামলার পরবর্তী তারিখ না আসা পর্যন্ত….
এ বিষয়ে বিচারক মতিউর রহমান বলেন, সত্যি বলতে কি, আমরা যারা বিচারকের দায়িত্ব পালন করি তাঁরাও কারো না কারো বাবা। আমাদেরও সন্তান আছে, পরিবার আছে। দিন শেষে আমরা ফিরে যাই আমাদের আলভীর কাছে। প্রত্যেকের আদরের টুকরা মায়াময় আলভিরা সবসময় ভালো থাকুক মহান আল্লাহর কাছে এই দোয়া করি।