বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এর প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন এম.পি, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী এবং বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল (পুরুষ) এর অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এর পদত্যাগ চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে। তাদেরকে আইসিসি পুরুষ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩ এ ব্যর্থতার দ্বায়ভার কাঁধে নিয়ে সমগ্র জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বলা হয়েছে নোটিশে।
আজ রোববার (১২ নভেম্বর) রেজিস্ট্রি ডাকযোগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর ঠিকানায় এ নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার।
নোটিশে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ কোচিং স্টাফ ও নির্বাচক কমিটি বাতিল, আইসিসি পুরুষ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩ এ ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন, উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নিজস্ব কোচ তৈরি, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলো যে ধরনের উইকেটে হয় তার অন্তত কাছাকাছি মানের উইকেটে ঘরোয়া লিগ আয়োজন, স্কুল ও বয়সভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ও প্রশিক্ষণ এর আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও বলে হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়, ক্রিকেট এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু আইসিসি পুরুষ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩ ছিল বাংলাদেশের জন্য ব্যর্থ মিশন। আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগে তৃতীয় স্থানে থেকে বিশ্বকাপে পা রাখে বাংলাদেশ। শুরুর আগেও শুরু থাকে। সেই মতো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশনের শুরু অভিজ্ঞ ওপেনার তামিম ইকবালকে বাদ দিয়ে। অবশ্য বাদ দেওয়া হয়েছিল, না তিনিই সরে গিয়েছিলেন, সেই বিতর্ক পাশে সরিয়ে রেখেও এ কথা বলতে হবে মহাবিতর্কে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল। তখন দলের প্রত্যাশা ছিল একটাই সেমিফাইনাল খেলা। এরপর প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল শুভসূচনা করে। ধর্মশালায় সেই ম্যাচ শেষ হওয়ার পরও কেউ ধারণা করতে পারেনি এমন বাজেভাবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন শেষ হবে। ধর্মশালায় ইংল্যান্ডের কাছে পরের ম্যাচে হারার পর থেকে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল একটি বাদে বাকি সব ম্যাচগুলোতে হেরেছে। সেই হারগুলোতে এমন আত্মসমর্পণের ভঙ্গি ছিল যে, দেখে মনে হয়েছে খেলার আগেই ফল জানা ছিল। যা সমগ্র বাংলাদেশের জনগণকে ব্যথিত করেছে।
এছাড়া ১৯৯৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৭টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল। প্রথম বিশ্বকাপে ২ জয় পেলেও পরের বিশ্বকাপে জয়ের খাতা ছিল শুন্য। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের জাত চেনাতে সক্ষম হলেও ২০১১ সালে ঘরের মাঠে সুপার সিক্স খেলা হয়নি বাংলাদেশের। সেই আসরে ইংল্যান্ডের মত দলকে হারানোর স্বাদ পেলেও ৫৮ ও ৭৮ রানে অলআউট হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতাও ছিল বাংলাদেশের। পরের আসরে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ খেলে কোয়ার্টারফাইনাল। যা এখন পর্যন্ত দলটির সর্বোচ্চ সাফল্য। ২০১৯ সালে ৯ ম্যাচের ৩টি জিতলেও ৭ নম্বরে থেকে আসর শেষ করে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল। কিন্তু কোনবারই সেমিফাইনাল খেলার প্রত্যাশা ছিল না। এবার ছিল বলেই ব্যর্থতাকে এত বড় মনে হচ্ছে। ইডেনে নামার আগে সেটি স্বীকার করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।
সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন এটিই বাংলাদেশের স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ কি না? উত্তরে সাকিব আল হাসান বলেছেন, ‘এটা আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, আমি দ্বিমত পোষণ করব না। এটা বাংলাদেশের স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ’। ২৪ বছরে সেমিফাইনাল খেলতে না পারা প্রসঙ্গেও বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বলা মুশকিল। ভুল মানুষকে জিজ্ঞেস করছেন। এখন এগুলা বলার সময় না। ২৪ বছরে সেমিফাইনাল খেলতে পারিনি, এটা হতাশাজনক। আমাদের এর থেকে অনেক ভালো করা উচিত ছিল।’
অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান নিজ দলের বাজে পারফরমেন্স অকপটে স্বীকার করেছেন। যা অধিনায়ক হিসাবে তার ব্যর্থতাকে সুস্পষ্ট করেছে। এছাড়াও মাঠের খেলার বাইরে এবারের বিশ্বকাপে তিনি টুর্নামেন্টের মাঝে দলকে ফেলে দেশে এসেছিলেন অনুশীলন করতে! ইতিপূর্বেও তিনি বিভিন্ন সময়ে খেলা চলাকালীন সময়ে বিজ্ঞাপন এর শ্যুটিং করে সমালোচিত হয়েছিলেন। যা আপনার কাছে কাম্য নয়। আপনার মতো একজন উঁচু মাপের খেলোয়াড়ের কাছে সমগ্র জাতি আরও পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়েছে, বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বে এমন কোন ক্রিকেট বোর্ড সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপ দল গড়েছিল তাদেরই দেশসেরা ওপেনারকে দলের বাইরে রেখে। যেই ওপেনারকে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ডেকে নিয়ে অবসর থেকে খেলায় ফিরিয়েছিলেন। বিশ্বকাপ শুরুর দুই মাস আগে নিয়মিত অধিনায়ক তামিম ইকবাল দলের দায়িত্ব ছাড়েন। সেই ঘটনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন এম.পি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ দলের বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্বকাপের কথা চিন্তা করে সময়োপযোগী কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। আবার ওপেনার লিটন দাসও ব্যক্তিগত কারণে (পুত্রসন্তানের জন্ম) দুইবার খেলা চলাকালীন সময়ে দেশে এসেছেন। পেশাদার দলে মানবিক কারণে একবার আসা মেনে নেওয়া যায়। তাই বলে একাধিকবার! ম্যাচ গুরুত্বহীন হলেও পেশাদার টিমে এমনটা চলতে পারে না। ম্যানেজমেন্টের এমন শিথিল মানসিকতা চূড়ান্ত পেশাদার সময়ে আরও বেমানান। অথচ এই ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন এম.পি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই।
সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান বলেছেন, ‘হ্যাঁ আমরা অনেক আন্ডার প্রিপেয়ার্ড ছিলাম। এখন এসব অভিযোগ দিয়ে আসলে লাভ হবে না। তবে অবশ্যই প্রস্তুতি কম ছিল।’ তাহলে আইসিসি পুরুষ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩ এ সাফল্য পেতে জাতীয় দলে প্রধান কোচ, কোচিং স্টাফ, টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক কমিটি এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কেন প্রস্তুতি সঠিকভাবে নিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি? ফলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন এম.পি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী আইসিসি পুরুষ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২৩ এ বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের ব্যর্থতার দায়ভার কোনভাবেই এড়াতে পারেন না।
লিগ্যাল নোটিশে আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার আরও বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার জন্য যে মান ও দক্ষতার প্রয়োজন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটার সেই জায়গাটায় পিছিয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো এখনো পড়ে আছে প্রাচীন যুগে। স্কুলভিত্তিক, বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট ও প্রশিক্ষণ ঠিকমতো না হওয়ায় নতুন মেধাবী ক্রিকেটার তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশে খেলা হয় ধীরগতির মন্থর উইকেটে। আধুনিক কৌশল এবং প্রযুক্তির চর্চা নেই। বেশিরভাগ ক্রিকেটারই জাতীয় দলে এসে শিখেন, যেটা আদতেই শেখার নয়; বরং পরীক্ষা দেওয়ার জায়গা। ক্রিকেট দলীয় খেলা হলেও দল গড়তে, একাদশ সাজাতে বাংলাদেশে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার চড়া মূল্যই দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলকে।
মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার সময়ে তিনি অধিনায়ক হিসেবে সফল হলেও ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে বোলার হিসেবে দলের অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছিলেন। এছাড়া কোন ক্রিকেটার অবসর নেবার সময়ও তাকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে বিদায় দেবার কোন পদক্ষেপও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নেয় না। যা খুবই দুঃখজনক। বাংলাদেশের ক্রিকেট চলে এখনো পুরনো পন্থায়।
দেশের অনেক কিছু স্মার্ট এবং ডিজিটাল হলেও ক্রিকেট পড়ে আছে অ্যানালগ যুগে। ক্রিকেট খেলা বেশিরভাগ দেশই উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব কোচ তৈরি করলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আজ পর্যন্ত সেই উদ্যেগ গ্রহন না করে বরং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশী কোচিং স্টাফ আনতেই বেশি আগ্রহী। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন লম্বা সময় ধরে চেয়ারে, হাবিবুল বাশারেরও হয়ে গেছে লম্বা সময়, অথচ তারা আজও বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা সম্পন্ন বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল গঠন করতে পারেননি। এছাড়া দীর্ঘ ৬ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামটি পানির নিচে তলিয়ে আছে। আউটার স্টেডিয়ামের অবস্থাও একই। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় এটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ব্যবহার না হওয়ায় আযত্ন আর অবহেলায় স্টেডিয়ামের মূল গ্রাউন্ড, গ্যালারিসহ সবকিছু ধ্বংসপ্রায়।
অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এসব ব্যাপারে কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। আবার জাতীয় দলের শীর্ষ খেলোয়াড়রা অতিরিক্ত অর্থের আশায় বিদেশী লীগ খেলতে এবং বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশ নিতে বেশি আগ্রহী। ফলে জাতীয় দলের প্রতি তাদের যথাযথ পারফরমেন্স ও কমিটমেন্টের অভাব পরিলক্ষিত হয়। অথচ এই ব্যাপারেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বরাবরই নীরব ভূমিকা পালন করেছে। যার দায়ভার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন এম.পি ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী কোনভাবেই এড়াতেই পারেন না বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।