চেকের মামলা দেওয়ানী মোকদ্দমার মতো সংশোধনী ও প্রাসঙ্গিক আইন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

ফৌজদারী মামলায় অপরাধের আলামত উদ্ধারে আইন মানতে বাধা কোথায়?

সিরাজ প্রামাণিক: অপরাধ করেও দোষী ব্যক্তিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে- এরকম অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। খালাস কিংবা অব্যহতি প্রাপ্তির প্রধান কারণসমূহ নিয়ে আজকের নিবন্ধ।

ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্যমতে, অপরাধের আলামত উদ্ধারে যে কোন ধরণের তল্লাশিতে অবশ্যই প্রত্যক্ষদর্শী নিরপেক্ষ সাক্ষী থাকতে হবে। তল্লাশী কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং সাক্ষীদেরকে অবশ্যই উক্ত বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পুরো তল্লাশির প্রত্যক্ষদর্শী হতে হবে এবং প্রতিটি জিনিস কোথায় পাওয়া গেছে তা স্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম হতে হবে। (৪৭ ডিএলআর ৬০৩)

ফৌজদারী কার্যবিধির সপ্তম অধ্যায়ের অধীনে তল্লাশি বিষয়ে ১০৩ ধারা বলছে, তল্লাশকারী কর্মকর্তা কমপক্ষে দুজন সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন বাসিন্দার উপস্থিতিতে তল্লাশির জায়গা হতে জব্দকৃত সমস্ত কিছুর তালিকা তৈরি করবেন। এই ধারা তৈরীর উদ্দেশ্যে হলো তল্লাশকারী কর্মকর্তার সুষ্ঠু কর্মকান্ড নিশ্চিত করা এবং তল্লাশির বিষয়ে আদালতে দেওয়া সাক্ষ্য যেন শুধু তল্লাশকারী কর্মকর্তার উপর নির্ভরশীল না হয়। বরং স্থানীয় নিরপেক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করার মাধ্যমে তল্লাশির ক্ষেত্রে মিথ্যা জড়িত হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা কমানোই এর উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুনচেকের মামলা দেওয়ানী মোকদ্দমার মতো সংশোধনী ও প্রাসঙ্গিক আইন

আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনও জিনিস তল্লাশি ও জব্দ করার সময় হয়রানি, গল্প বানানো এবং হেরফের যেনো না ঘটে। জনগণের আস্থা ও সুরক্ষাবোধ নিশ্চিত করার জন্যও এই বিধান। কোনো সাধারণ সাক্ষী এই অভিযান প্রত্যক্ষ না করলে বা জিনিস উদ্ধারে প্রত্যক্ষদর্শী না থাকলে আইনী বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথাকথিত উদ্ধারের বিষয়টি ব্যবহার করা যাবে না। রাবেয়া খাতুন বনাম রাষ্ট্র মামলা, ২৬ বিএলডি ৪৭৩ পৃষ্ঠা)

আইন আরো বলছে, জব্দতালিকায় সাক্ষীদের স্বাক্ষর থাকতে হবে। স্বাক্ষর প্রমাণ হলেই তল্লাশি ও জব্দকরণ সঠিক বলে ধরে নেয়া হবে। তল্লাশীর ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বিধান মানা না হলে তল্লাশি এবং জব্দকরণ পুরোপুরি বেআইনী হবে। ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৩ ধারা এবং পুলিশ রেগুলেশন ১৯৪৩ এর ২৮০ প্রবিধান এমনটিই বলছে।

আরও পড়ুনবয়নামা দলিল কখন স্বত্বের দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়?

মনে রাখবেন সাক্ষীদের জেরার উদ্দেশ্য হচ্ছে জবানবন্দিতে দেওয়া বক্তব্যে বদলে দিয়ে মামলার আকাঙ্খিত তথ্য বের করে আনা এবং সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। জেরার আরেকটি উদ্দেশ্যে হলো প্রতিপক্ষের মামলা দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত বা নষ্ট করা এবং নিজ পক্ষের মামলা প্রতিষ্ঠা করা। এই চর্চাকে আইনবিদরা সত্য উদঘাটনের অন্যতম প্রধান ও সবচেয়ে কার্যকর পরীক্ষা হিসেবে যথার্থ বর্ণনা করেছেন।

একটি কেইস স্টাডি থেকে জানা যায়, গোপন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পিডব্লিউ-১ এবং তার দপ্তরের আরও কয়েকজন কর্মচারী আসামি ধারার জন্য ঝটিকা অভিযান চালায় এবং রাত ৮ ঘটিকায় আসামির দোকান তল্লাশি করেন। ফলে তল্লাশিটি ছিল পূর্বনির্ধারিত ও পূর্বপরিকল্পিত। কিন্তু এই তল্লাশি স্থানীয় দুইজন সম্মানি ব্যক্তির উপস্থিতিতে করা হয়নি, এমনকি প্রতিবেশী দোকানদারদের উপস্থিতিতেও নয়। কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই জব্দ তালিকার একজন সাক্ষীকে ডাকা হয়নি।

আরেকজন সাক্ষী পিডব্লিউ-২ তার উপস্থিতিতে তল্লাশি, উদ্ধার এবং জব্দকরণের বিষয়টি সমর্থন করেননি। ফলে এটি স্পষ্ট যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৩ ধারার বাধ্যতামূলক বিধান প্রতিপালন করে তল্লাশির যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে অনুযায়ী তল্লাশি করা হয়নি। [ আ. ওহাব ওরফে আব্দুল ওয়াহাব বনাম রাষ্ট্র, ৬০ ডিএল আর(২০০৮) ৪৮]

কাজেই নিয়ম লঙ্ঘন করে ক্রিমিনাল কেসে যা করা হয় বা হচ্ছে বা ভবিষ্যতে করা হবে তাতে মানুষ অপরাধ করেও সহজে পার পেয়ে যাবে।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com