মো. জিয়াউর রহমান, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট

শাস্তির পরিমান ও প্রতীক্ষিত নীতিমালা

মো. জিয়াউর রহমান :

খুনের (Murder) শাস্তি মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। খুন প্রমাণ হলে এই দুই অপসনের মধ্যে বিচারক যে কোন একটি বেছে নিবেন। মৃত্যুদন্ড নাকি যাবজ্জীবন – এর মধ্য কোনটা হবে তা দন্ড প্রদানকারী বিচারকের Discretion. শাস্তি বিষয়ে আমাদের দেশে কোন নীতিমালা (sentencing policy) নেই। এ প্রসঙ্গে মাননীয় হাইকোর্ট একটি মামলায় বলছেন, বিচারে sentencing discretion প্রয়োগ সবচেয়ে কঠিন এবং এক্ষেত্রে সোজা সাপ্টা ফরমুলা তৈরী সম্ভব নয়। আমাদের আইনগুলো শুধু শাস্তির নির্ধারিত (সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন) সীমা দিয়ে দিয়েছে, এই সীমার মধ্যে দোষী সাব্যস্তকে (convicted) কতটুকু শাস্তি আরোপ করবে তা বিচারকের স্বেচ্ছাধীন বিষয়। এমনকি এ বিষয়ে কোর্টকে ভিকটিম, রাষ্ট্র বা আসামী- সংশ্লিষ্ট কোন পক্ষের বক্তব্য শোনার প্রয়োজন নেই, সুযোগও নেই।

আমাদের প্রতিবেশী ভারতের আইন ব্যবস্থার সাথে আমাদের আইন ব্যবস্থা বেশীরভাগই Identical. সেই ভারতে অবশ্য Sentencing Hearing এর সুযোগ রয়েছে। ভারতে সাক্ষ্য প্রমানে দোষী সাব্যস্ত হলে (convicted) সাথে সাথে আমাদের মত রায়ে শাস্তি আরোপ না করে কতটুকু শাস্তি হবে সে বিষয়ে পৃথক দিনে সংশ্লিষ্ট পক্ষের বক্তব্য কোর্ট শুনবে এবং তারপর শাস্তি আরোপ করবে। এই শুনানীর সুযোগ সেখানে পক্ষদের আইনগত অধিকার। আমাদের দেশেও এই বিধান একসময় ছিল, পরে ১৯৮৩ সনে বাতিল করা হয়েছে। আমাদের এখানে sentencing hearing এর সুযোগই নেই। সুযোগ না থাকায় শাস্তি আরোপের সময় বিচারক বিস্তর Discretion ভোগ করে এবং কোন সুনির্দিষ্ট নীতি না থাকায় একই ধরনের অপরাধে একেক আদালতে একেক শাস্তি আরোপের সুযোগ থাকছে। শাস্তি প্রদানে কোন Uniformity থাকছে না।

ঐশীর কথা মনে আছে? বয়সে নিতান্ত তরুণী ঐশী তার বাবা মাকে হত্যা করে, বিচারিক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড দেয়। আপীলে মাননীয় হাইকোর্ট তার শাস্তি মৃত্যুদন্ডের স্থলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে। ঐশীর এ মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট শাস্তি আরোপে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। মাননীয় হাইকোর্ট বলছেন, “in order to impose the sentence upon a perpetrator, if proved, there must be a guideline or rules as to how it can be imposed.” এমন অনেক উদাহরণ আছে, শাস্তি হিসেবে বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন দিয়েছেন, আপীলে অপর্যাপ্ত বিবেচনায় মৃত্যুদন্ড হয়েছে। যাবজ্জীবন এর স্থলে মৃত্যুদন্ড অথবা মৃত্যুদন্ডের স্থলে যাবজ্জীবন দেয়ার জন্য উচ্চতর আদালত কিছু ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনাও করেছেন। একটি মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট বলছেন, “A judge is sitting for doing justice. A judge is not a butcher sit only to hang the accused.”

এখন প্রশ্ন হলো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন না থাকলে কোথায় মৃত্যুদন্ড হবে আর কোথায় যাবজ্জীবন হবে তা নির্ধারণ করা নিঃসন্দেহে জটিল বিষয়। বিচারিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি সহ নানান বিষয় এখানে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। ধরুন ব্যক্তিগত ভাবে একজন মৃত্যুদন্ডের বিরোধী। এমন বিচারক তার ব্যক্তিগত মতাদর্শের কারণে হয়তো যাবজ্জীবন শাস্তি ব্যতীত কখনো মৃত্যুদন্ড দিবেন না। এটা বিরল নয়। এমন একজনের কথা মনে পড়ছে, তিনি ক্যারিয়ার জাজ ছিলেন, রিয়াটারমেন্ট এর আগে গল্পে গল্পে বললেন, তিনি কখনো মৃত্যুদন্ড দেননি। শাস্তি প্রদানে judge centric এই স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অযৌক্তিক ব্যবহার একজন দোষী সাব্যস্ত মানুষের জীবন ও মৃত্যুর মাঝে রেখা টেনে পারে। তাই শাস্তি হতে হবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী। আর শাস্তির যথাযোগ্য প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন একটা পূর্ণাঙ্গ Sentencing Policy বা গাইড লাইন, হতে পারে তা সরকার কর্তৃক আইন বা বিধি বা নীতিমালা তৈরী করে অথবা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তার কোন রায়ে বা সার্কুলার ইস্যু করে।

আমাদের বিদ্যমান আইনে বিক্ষিপ্ত ভাবে শাস্তির প্রয়োগ বিষয়ে বলা আছে। কোন বিচারক কতটুকু শাস্তি আরোপে সক্ষম তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করে সীমা নির্ধারণ করা আছে। আইনে নির্ধারিত সীমার মধ্যে কতটুকো শাস্তি হবে তা জাজ এর নিজস্ব এখতিয়ার। এক্ষেত্রেও জাজ wide discretion ভোগ করে। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। Special Power Act এর 25B(1)(a) ধারামতে এ স্মাগ্লিং বা চোরাচালান এর শাস্তি মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ২ হতে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। ধরুন, একজন ২৫ বোতল ফেন্সিডিল ভারত হতে এনেছে। বিচারক হিসাবে আপনি তাকে কতটুকো শাস্তি দিবেন? আপনি এমন অপরাধের দোষী সাব্যস্তকে সর্বনিন্ম ২ বছর জেল হতে ১৪ বছর পর্যন্ত জেল দিতে পারেন, অথবা যাবজ্জীবন এমনকি মৃত্যুদন্ডও দিতে পারেন। যে মনে করবে, মাদক নির্মূলে কঠিন শাস্তি আরোপ করা দরকার, সে হয়তো যাবজ্জীবন শাস্তি দিলো। কেউ মনে করলো, মাত্র ২৫ বোতল, পরিমানে কম, সে হয়তো সর্বনিন্ম ২ বছর শাস্তি দিলো। ২৫ বোতল ফেনসিডিল আনার জন্য মৃত্যুদন্ড দিলেও কোন বাধা নেই, আইনই এমন ক্ষমতা দিয়েছে। এই যে মনে করা, এটা একেকজন একেকভাবে মনে করতে পারে এবং তার ফলে একই ধরনের অপরাধে ভিন্ন ভিন্ন আদালত ভিন্নরকম শাস্তি দিতে পারে। আমাদের আইনে আরও কিছু নীতি বিক্ষিপ্তভাবে বলা আছে। যেমন কোন মহিলা গর্ভবতী থাকলে সেসময়কালে তার মৃত্যুদন্ড স্থগিত থাকবে। জরিমানা অনাদায়ের জন্য মূল শাস্তির ৪ ভাগের একভাগ পর্যন্ত শাস্তি দেয়া যাবে। জরিমানা অনাদায়ে আরোপিত শাস্তি অবশ্যই বিনাশ্রম হবে এবং তা অত্যাধিক হবে না। মামলার শুরু হতে রায়ের আগ পর্যন্ত হাজতবাস মূল কারাদন্ড হতে সবসময়ই বাদ যাবে। শিশুর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে দশ বছর পর্যন্ত, আর তা সে খুন করলেও। এ বিধানগুলো হতে একজন বিচারক কোন অপরাধে কি পরিস্থিতিতে কত শাস্তি আরোপ যুক্তিযুক্ত তা জানতে পারছেন না।

সুনির্দিষ্টরুপে Statutory Principle না থাকলেও এ বিষয়ে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট এর হাইকোর্ট ও আপীল বিভাগের অনেক নজীর (precedent) রয়েছে। এই নজীরগুলো সংবিধানের ১১১ ধারা অনুযায়ী অধস্তন আদালতগুলোর জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক। একেক মামলার একেক কাহিনী ও পরিস্থিতি হওয়ায় এবং কিছু কিছু নজীর একটার সাথে অন্যটা বিরোধপূর্ণ (conflicting) হওয়ায় তা (precedent) বিচারিক আদালতকে শাস্তি আরোপে পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা দিতে সক্ষম হচ্ছে না।

শাস্তি আরোপে উচ্চ আদালত কিছু Mitigating Factors এবং Aggravating Factors এর কথা বলছে। Mitigating Factors জাজকে তুলনামূলক সফট শাস্তি ও Aggravating Factors কঠিন শাস্তি প্রদানে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। মাননীয় হাইকোর্ট আকবর আলী লালু বনাম রাষ্ট্র মামলায় বলছেন, “The Judges who bear sword of justice should not hesitate to use that sword with utmost severity, to the full and in the end to the end, if the gravity of the offences so demand.”

স্টেট বনাম রোকেয়া বেগম মামলায় মানীয় হাইকোর্ট বলছেন, অপরাধী যদি নৃশংসভাবে ভাবে অপরাধ করে আর তা সুশৃঙ্খল সাক্ষ্য দ্বারা প্রমান হয়, তবে চূড়ান্ত শাস্তি না দেয়া বিচারের সাথে উপহাস। বলছেন, “Sympathy to impose inadequate sentence would do more harm to justice system to undermine public confidence in the efficacy of law.”

আমরা দেখি, মাননীয় Appellate Division পূর্ব পরিকল্পিত, ঠান্ডা মাথায় করা ইচ্ছকৃত নৃশংস খুনের অপরাধীকে সমাজ হতে নির্মূলের কথা বলছেন এভাবে, “…as such their elimination from the society is the only solution to preserve and protect the existing norms and thus only proper sentence to be passed against them is one of death.”

সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে দায়ের রাষ্ট্র বনাম মোসলেম মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট বলছেন, “Society’s cry for justice becomes louder and the court must hear the loud cry for justice by the society, more particularly, in a case of heinous crime and court should impose proper punishment befitting the crime so that court reflects public abhorrence of crime.”

জাতির পিতার হত্যা মামলায় মাননীয় আপীল বিভাগ বলছেন, “The manner in which they were so brutally and mercilessly murdered ripples any consideration of reduction of sentence. As such, none of the accused deserves any leniency in matter of sentence.”

আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় মৃত্যুদন্ড রাখার সপক্ষে মাননীয় আপীল বিভাগ বলছেন, Our social conditions, social and cultural values are completely different from those of western countries. The European Union has abolished death penalty in the context of their social conditions and values, but we cannot totally abolish a sentence of death in our country because the killing of woman for dowry, abduction of woman for prostitution, the abduction of Children for trafficking are so rampant which are totally foreign to those developed countries.” 68 DLR [2016] (AD)1.

উচ্চ আদালত অনেক মামলায় অপরাধীর কম বয়স, হঠাৎ করে উত্তেজনার বসে করা অপরাধ, স্বীকারোক্তি, দীর্ঘদিন কনডেম সেলে থাকা, ন্যায়বিচার এমন সব কারণকে Mitigating Circumstances বিবেচনা করেছে। সাজাহান মানিক বনাম রাষ্ট্র মামলায় অপরাধীর শিশু সন্তান আছে ও কনফেসন দিয়েছে বিবেচনায় মৃত্যুদন্ড হতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। রাষ্ট্র বনাম জাকারিয়া কবিরাজ মামলায় বর্ররতা বিবেচনায় বিচার আদালতে মৃত্যুদন্ড সঠিক ছিল বললেও ৩ বছর জেল খাটছে উল্লেখে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র বনাম সুরেন দাস মামলায় অভিযুক্তের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় হত্যাকান্ড ঘটানোয় মানসিক অবস্থা বিবেচনায় সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্র বনাম দীপক কুমার মামলায় মাননীয় আপীল বিভাগ দাম্পত্য কলহের একপর্যায়ে হত্যাকান্ড হওয়ায় শাস্তি প্রদানে মানসিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়। রাষ্ট্র বনাম আজিজ মিনা মামলায় ঝগড়া ও উত্তেজনা বিবেচনায় নিয়ে মৃত্যুদন্ড Commute করা হয়। মেজর বজলুল হুদা বনাম রাষ্ট্র মামলায় মাননীয় আপীল বিভাগ কয়েকটি Mitigating Circumstance উল্লেখ করে- খারাপ intention এর অনুপস্থিতি, প্ররোচনা, নিজেকে রক্ষা করা, নিকটজন কে রক্ষা করা, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এর বাইরে গিয়ে কৃত অপরাধ, ভয় বা কর্তৃপক্ষের আদেশে কোন কাজ, মাতাল থাকা এবং কম বয়স।

এই Mitigating ও Aggravating ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় নিয়ে যৌক্তিক শাস্তি আরোপ কাম্য। তবে uniform, justified ও proportionate শাস্তি আরোপ করতে হলে মামলার সংশিষ্টপক্ষদের শুনতে হবে এবং সমস্ত কিছু বিবেচনায় নিয়ে শাস্তির পরিমান নির্ধারণ করতে হবে, যাতে করে সংশিষ্ট পক্ষ, সমাজ ও রাষ্ট্র অপরাধীকে প্রদত্ত শাস্তিতে তৃপ্তবোধ করে। আর এটা নিশ্চিত করতেই Sentencing Policy এর কোন বিকল্প নেই।

মো. জিয়াউর রহমান : চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মাগুরা

Bibliographical Index:

Statutes:

  1. Penal Code 1860 (Bangladesh),
  2. Indian Penal Code 1860
  3. Special Power Act 1974
  4. The Code of Criminal Procedure- 1898 (Bangladesh),
  5. The Code of Criminal Procedure- 1973 (India)

Book:
1. Trial of Civil Suits and Criminal Cases, Justice Hamidul Haque

Articles:
1. An Appraisal of Sentencing in Bangladesh: Between Conviction and Punishment (2014). Hussain Mohammad Fazlul Bari;

  1. Section 302: Matter of death and life on the sentences preference, Sadiya S. Silvee;
  2. Need for sentencing policy in India: critical study on ‘discipline of justice’, Karan Gehlot and Prem Dhurvey

Online Items

  1. https://www.dhakatribune.com/bangladesh/court/2017/10/23/hc-bangladesh-needs-guideline-death-sentencing
  2. https://www.observerbd.com/details.php?id=121113