অ্যাডভোকেট কুমার দেবুল দে

১৪৪ ধারা নাকি বিকল্প আইনে চলছে সমাবেশ স্থলে নিষেধাজ্ঞা?

কুমার দেবুল দে

“১৪৪ ধারা” শব্দদ্বয় সম্পর্কে বাঙ্গালীর জানাশুনা এবং অভিজ্ঞতা অনেক পুরনো। বাংলা সিনেমার বদৌলতে দন্ডবিধির ৩০২ ধারা সম্পর্কে আমজনতা জানলেও আজকের আলোচ্য ধারাটি বাঙালি জাতির গোচরীভূত হয় স্বাধিকার আন্দোলনের সময় থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ৭টি ধাপেও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল এই ধারা, এই ধারা ভেঙ্গেই অর্জিত হয়েছে মাতৃভাষা বাংলা, এবং স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এই ধারা লঙ্ঘন করে রাজপথে রক্তও কম দেয়নি এ জাতি। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার পরেও বিভিন্ন সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ করার রাজনৈতিক অধিকার হরণ করার জন্য এই ধারাটিকে এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে। ইদানিং রাজনীতিতে ১৪৪ ধারার ব্যবহার আর তেমন একটা শোনা না যাওয়ার কারণ কি হতে পারে? দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি তবে আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে? নাকি ১৪৪ ধারার আদলে অন্যকোন আইনের অন্যকোন ধারা এর স্থান দখল করে নিয়েছে সবার অজান্তেই? তার উত্তর খুঁজবো এই লেখাতে।

এতক্ষনে নিশ্চয়ই পাঠক বুঝে গেছেন এই ধারার ক্ষমতা কত! কি আছে এই ধারাতে? কেন বিরোধী দলগুলোও এই ধারাকে এত ভয় পায়? এই দুইটা প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে বলে রাখা ভাল, ১৪৪ ধারা ১৮৯৮ সাল থেকেই এই দেশে বলবৎ আছে, যদিও বৃটিশরাই এই ধারার জনক, কিন্তু বৃটিশরা ধারাটিকে খুব বেশী ব্যবহার করেন নি, এই ধারার রেকর্ড সংখ্যক ব্যবহার হয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ আমলে। এবার যাওয়া যাক কেন বিরোধী দলগুলো এ ধারাকে এত ভয় পায়! কারণ হল, এই ধারা যদি ভঙ্গ করা হয় তবে সরকার বা রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি তার সুশিক্ষিত পেটোয়া বাহিনি দিয়ে আইনগত ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, পাখির মত গুলি করে মানুষ মারতে পারে, একেবারেই বৈধ ভাবে। আর যারা মারা যাবে তারা শুধুই আইন ভঙ্গকারী হিসেবে মারা যাবে এবং যারা মারা গেলে রাষ্ট্রকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যূনতম দায়ও নিতে হয় না!

চলুন দেখে নিই কি আছে এই ধারাতে? এই ধারায় মোট ৭ টা উপধারা রয়েছে, একসাথে পড়লে যা দাঁড়াবে তা হল : এই ধারাটির দুইটা রূপ আছে: ১. আদালতগত রূপ ২. অফিসগত রূপ। প্রথমটা আদালতে হয় যাতে আইনজীবীরা উপস্থিত থাকেন তাদের উপস্থিতিতেই আদেশ দেয়া হয়। অপরটা উনারা নিজেরা নিজেরাই সারেন। আদালতের বিষয়টি মোটামুটি সকলেই জানেন তাই আজকের লেখা ১৪৪ ধারার অফিসিয়াল দিকটি নিয়ে।

১৪৪ ধারা মানে আসলে কি?
এটা প্রশাসনের একটা বিশেষ ক্ষমতা যা দিয়ে শান্তি শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা বা গণউৎপাতের দোহাই দিয়ে যেকোন জায়গায়, যেকোন কিছু করতে, যে কাউকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষমতা, এক কথায় বললে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ক্ষমতা (সর্বোচ্চ দুই মাস পর্যন্ত)।

এ আদেশটা কে দিতে পারে?
যেকোন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা সরকার কতৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত যেকোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ( ধারা -১৪৪)(১)/ ৩৬/৩৭ ততসহ তফসীল ৩ ও ৪ ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮)। কোন ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে যেকোন ব্যাক্তির আবেদনের ভিত্তিতে অথবা স্যু মটো বা স্বঃপ্রণোদিত হয়ে এই নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিতে পারে। দুইপক্ষকে শুনে অথবা একতরফাও এই আদেশ দেয়া যায়। সাধারণত আদালতে এই বিষয়টি দেখাশুনা করার জন্য যেই ম্যাজিস্ট্রেটটি বসেন উনি কিন্তু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নয় কিংবা সাধারণ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও (সরকার কতৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত) নন, উনাকে বলা হয় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা এডিএম কিন্তু কথা হল আইনেতো এই বিষয়টা দেখার ক্ষমতা উনাকে দেয়া হয় নাই তাইলে তিনি বসেন কিভাবে? উনি বসেন ডিসি সাহেবের নির্দেশে, এখন জানা যাক ডিসি সাহেব এইক্ষমতা কাউকে হস্তান্তর করতে পারেন কি না?

ধারা- ৩৭ মতে, সরকার যদি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এই ক্ষমতাটুকু অন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে হস্তান্তর করার জন্য অথোরাইজেশন দিয়ে থাকে তখন পারবে, এবং এই ক্ষমতা দিয়েই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব অন্য আরেকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে এই ক্ষমতাটা অর্পন করতে পারেন।

এখন কথা হল, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এই ক্ষমতাটা সমগ্র বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে পারেন কিনা? উত্তর হল: না। ধারা- ১৪৪(৭) এ বলা হয়েছে, মেট্রোপলিটন এলাকায় এই ধারা প্রযোজ্য নয়। তাহলে মেট্রোপলিটন এলাকায়ই তো এই ধারার বেশী প্রয়োজন কারণ রাজনৈতিক দল বা যেকোন সংগঠনের আধিপত্য মেট্রোপলিটন এলাকাতেইতো সবচেয়ে বেশী। গ্রামগঞ্জে এদের তৎপরতা খুব বেশী দেখা যায়না। যদিও আমাদের দেশের সাংবাদিকেরা মেট্রোপলিটন এলাকায়ও ১৪৪ ধারা জারির খবর পরিবেশন করেন নিয়মিত, বিষয়টি আইন সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না রেখে আইন বিষয়ে সাংবাদিকতার ফলে হয়ে থাকে।

মেট্রোপলিটন এলাকা মানে কি?
সবাই স্বচক্ষে প্রতিদিন মেট্রোপলিটন এলাকা দেখে থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে মেট্রোপলিটন এলাকা সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণাও নাই। মেট্রোপলিটন এলাকা বলতে কি বুঝায় তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২ তে নাই, জেনারেল ক্লজেস এক্টে নাই এমনকি ফৌজদারী কার্যবিধিতেও নাই তাহলে জিনিসটা কি? অনেকে আবার সিটি কর্পোরেশন এর সাথে এইটাকে গুলিয়ে ফেলেন। সকলের জ্ঞাতার্থে জানাই বাংলাদেশে এই মুহুর্তে ১০টি সিটি কর্পোরেশন থাকলেও মেট্রোপলিটন এলাকা রয়েছে মাত্র ৬ টা, যথা- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট। ইতোমধ্যে আরো ৩টা মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনের মাধ্যমে নতুন ৩টি সিটি করপোরেশন যথা কুমিল্লা, গাজীপুর ও রংপুরকে মেট্রোপলিটন সিটিতে উন্নীত করা হচ্ছে এবং এইলক্ষ্যে কুমিল্লা, গাজীপুর ও রংপুরেও মহানগর পুলিশ দিতে ৩টি আইনের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘কুমিল্লা মহানগরী পুলিশ আইন-২০১৭’, ‘গাজীপুর মহানগরী পুলিশ আইন-২০১৭’ এবং ‘রংপুর মহানগরী পুলিশ আইন-২০১৭’র খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয় গত ১৯ নভেম্বর, ২০১৭। তাহলেতো বুঝতেই পারলেন, মেট্রোপলিটন এলাকা আর সিটি কর্পোরেশন এলাকা যে এক না! মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয় মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন দিয়ে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে Dhaka Metropolitan Police Ordinance, 1976 এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ২৯ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে Chittagong Metropolitan Police Ordinance, 1978 এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এও ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩০ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।

খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে Khulna Metropolitan Police Ordinance, 1985 এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩০ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে বরিশাল মহানগরী পুলিশ আইন, ২০০৯ এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩১ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।

সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে সিলেট মহানগরী পুলিশ আইন, ২০০৯ এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩১ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।

একই ভাবে রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকা তৈরী করা হয়েছে রাজশাহী মহানগরী পুলিশ আইন, ১৯৯২ এর তফসীল ১ দিয়ে, এই আইনের ধারা- ৪ এ ফৌজদারী কার্যবিধিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া সমস্ত ক্ষমতাকে বাতিল করা হল এবং ধারা- ৩১ এ পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেয়া হল এই এলাকার মধ্যে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার, সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য। অবশ্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়াতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (sanction) নেয়ার প্রয়োজন আছে।

প্রিয় পাঠক এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন ১৪৪ ধারা কি, মেট্রোপলিটন এলাকা কি এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় কিভাবে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়।

লেখক : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য।