বেল্লাল হোসাইন

অপরাধবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সমাজে অপরাধী থাকা ভাল!

অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইনঃ

শিরোনামে অবাক হচ্ছেন? চলুন জেনে আসি কেন এমন বলা হলো। এমিল দুর্খেইম নামের একজন ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী/অপরাধবিজ্ঞানী সমাজে সীমিত মাত্রায় অপরাধ ও অপরাধী থাকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে মত দিয়েছিলেন। যার মূলকথাটা এমন যে, “সমাজে কিছু চোর- বাটপার-ছেচরা ঘৃন্য লোক থাকা ভালো। কারণ তাদেরকে লোকে অপছন্দ আর তিরস্কার করে বলে সমাজের অন্য লোকেরা বা সম্ভাব্য বদমাইশেরা এই ঘৃণাবোধের শিকার যাতে না হতে হয় সেই জন্য ভালোর চর্চাটা করে।”

তাই সুস্থ ধারার সমাজ বিনির্মাণে খারাপ লোকেদের ভূমিকাও কম নয়।

সমাজের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই স্পিলিট পার্সোনালিটি থাকে। যেমন কেউ রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া কম দেয় কিন্তু সে ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়। আবার অনেকে ঘরের লোকের সাথে তিক্ত ব্যবহার করে কিন্তু বাহিরের লোকের সাথে এমন আচরণ করে যেন লোকে তাকে ফেরেশতা মনে করে। আমাদের দেশের কিছু মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীদের একই অবস্থা। তারা সিলেক্টেড কিছু ইস্যু ছাড়া সহজে কথা বলে না। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। যেমন কিংবদন্তি বোলার শেন ওয়ার্ন শিশু উন্নয়নে অনেক দাতব্য কাজ করেছে। অথচ তার বিরুদ্ধে শিশু যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। এভাবে দেখা যায় চেম্বারে গলায় ফাঁস দিয়ে ফিস নেয়া অনেক ডাক্তাররা মাঝে মাঝে ফ্রী মেডিকেল ক্যাম্প করে বিনামূল্যে ঔষধসহ সেবা দিচ্ছে।

মাথা ঠান্ডা করে ভাবলে দেখা যাবে আমাদের মধ্যেও এমন কম বেশি স্ববিরোধিতা আছে। এটা আসলে মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাই আপনি যদি কারো বাজে স্বভাবের সমালোচনা করেন, তাহলে তার ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করার দায়টাও আপনার ঘাড়ে বর্তায়। কিন্তু আমরা সব কিছু জেনারেলাইজড করে ফেলি। ভালো আর মন্দকে যে নিগুঢ়ভাবে আলাদা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেয়া না এটা মনে রাখতে হবে। ভালো এবং মন্দ বাস্তবে এতটাই কাছাকাছি পাশাপাশি হাঁটে যে তাদের দূরত্ব হয় উনিশ- বিশ! বেশিরভাগ সময় উনিশ হলে খারাপ মনে হয়, বিশ হলে ভালো মনে হয়। চরম দুষ্কৃতির ব্যাখ্যা যদিও ভিন্নতর।

আমরা যে ভুলটা করি সেটা হলো সবকিছু একই ছাচে ফেলে ক্লাসিফাইড করে ফেলি। যাকে মন্দ জানি তার ভালোটা আর দেখি না। আবার যাকে ভালো ভাবি তার খারাপটা চোঁখে পড়ে না।

প্র্যাক্টিক্যালি চিন্তা করলে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে নিজের সার্কেলে কিছু লোক আছে যারা প্রশংসা পছন্দ করে এবং তাদের প্রশংসা পাওয়া অব্যাহত রাখতে প্রশংসামূলক কাজগুলো দ্বিগুণ উৎসাহে করতে থাকে। আবার উল্টোদিকে যেসব মানুষকে কখনোই তাঁর ভালো কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয় না সে ধীরে ধীরে ভালো কাজের প্রতি আরো নিরুৎসাহিত বোধ করতে শুরু করে। সে যখন সমাজের প্রতি নিজের দায় অনুভব করে না তখন সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ছোট ছোট অপরাধ আর পাপবোধহীনতা মানুষকে নৈতিক স্খলনের দিকে ধাবিত করে। তাই আদরে বুঝিয়ে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে ছোট অপরাধীদের শোধরানোর চেষ্টা করলে টপ টেরর তৈরি হওয়া থামানো যেতে পারে। মানুষের সুকুমার গুণের প্রশংসা করলে সামাজিক সম্প্রীতি ও দায়বদ্ধতা অনেক বেড়ে যাবে। আশা করি দিনে দিনে এমিল দুর্খেইমের তত্ত্বটি ভুল প্রমাণিত হয়ে যাবে। এমন একদিন আসবে যখন লোকে ভালো দেখে হিংসায় আরো বেশি বেশি ভালোটাই করবে। যেদিন মানুষের সব কাজটুকু মূল্যায়িত হবে সেদিন আর কাউকে ঘৃণা করার সুযোগই থাকবে না। কারন তারও অবশ্যই ভালো গুণ আছে। তাই প্রত্যাশা এখন থেকে সব কিছু হোক ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি। ভালোবাসায় বাঁচুক সবাই।

লেখক : আইনজীবী ও সমাজকর্মী। ই-মেইলঃ bellal.sincere@gmail.com