গণপিটুনিতে প্রাণহানি (সূত্র- আসক)

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহত ৩৬

দেশে হঠাৎ করে গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে। গত চার দিনেই বিভিন্ন স্থানে সাতজনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) সারা দেশে ৩৬ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন।

গণপিটুনির শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারী, মানসিক রোগী, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধাসহ নিরীহ মানুষ গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গত শনিবার গণপিটুনির শিকার হয়ে জীবন দিতে হলো তাসলিমা বেগমকে। তাঁর এমন মৃত্যু মানুষকে নাড়া দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ওই দিন রাতে সাভারের অজ্ঞাত আরেক নারী গণপিটুনিতে নিহত হন। আর গতকাল রোববার নওগাঁর মান্দায় পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ছেলেধরার গুজব রটিয়ে ছয়জনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, নানা কারণে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। আবার অপরাধীদের বিচারও ঠিকঠাক হচ্ছে না। মূলত এ কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আসকের হিসাবে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৬ জন এবং গত চার দিনে ৭ জন মিলিয়ে ৪৩ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

সম্প্রতি গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সদর দপ্তর গত শনিবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে ও গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। দ্রুতই জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে।

বিচারে ধীরগতি
আট বছর আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকার সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে ‘ডাকাত সন্দেহে’ গণপিটুনিতে ছয় ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনা নিয়ে তখন সারা দেশে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার আট বছরেও বিচারকাজ শেষ হয়নি। এ ঘটনায় আসামি ৬০ জন, সবাই জামিনে আছেন।

ঢাকার একটি আদালতে এই মামলার বিচারকাজ চলছে। মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের একজন শাকিলা ইয়াসমিন গণমাধ্যমকে বলেন, এখন ওই মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তার জেরা চলছে। আগামীকাল ২৩ জুলাই পরবর্তী তারিখ রয়েছে। তাঁর জেরা শেষ হলে আরেকজন তদন্ত কর্মকর্তার জেরা বাকি থাকবে। তিনি আশা করেন, আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ হয়ে যাবে।

২০১১ সালের ২৭ জুলাই নোয়াখালীতে নিরীহ কিশোর মিলনকে ডাকাত সাজিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও সে সময় ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।

এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতে গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির কোনো বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি। এর মধ্যে আমিনবাজারের গণপিটুনিসহ বাংলাদেশের ঘটনা সাতটি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। কোনো বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করছে না। আরেকটি বিষয় হলো অপরাধ হচ্ছে, কিন্তু অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, শাস্তি হয় না—এমন একটি ধারণাও কিছু মানুষের মধ্যে ঢুকেছে। এসব কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে হচ্ছে।

এসব থেকে উত্তরণের উপায় কী? কাজী রিয়াজুল হক বলেন, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রথম আলো