অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং ড. কামাল হোসেন

ড. কামাল সংবিধান রচয়িতা নন: বিচারপতি মানিক

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেছেন, অনেকেই বলেন ড. কামাল হোসেন সংবিধান রচয়িতা, কিন্তু কথাটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত সম্পূর্ণ মিথ্যা। ড. কামাল সংবিধান রচয়িতা নন।

রাজধানীর ধানমন্ডি আহসানিয়া মিশন মিলনায়তনে মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) সাউথ এশিয়ান ল’ইয়ার্স ফোরামের (এসএএলএফ) উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৭০ বছর উদযাপনে ‘মানব অধিকারের জন্য সোচ্চার হোন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন।

বিচারপতি মানিক বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে প্রথমেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন সংবিধান রচনায়। তিনি ৩৪ জন গণপরিষদের সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। কামাল হোসেন তখন আইনমন্ত্রী থাকায় পদাধিকারবলে তিনি এই কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ড. কামাল হোসেনের চেয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি।

সংবিধান রচনায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধান রচনায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। সংবিধান রচনায় গঠিত কমিশনের ৩৪ জন সদস্যকে বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধান সংগ্রহ করে সরবরাহ করেছিলেন।

বিচারপতি মানিক বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে কোন কোন বিষয়গুলো থাকবে, সেগুলোও বঙ্গবন্ধু চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু এই ৩৪ জনকে স্পষ্টভাবে একটি বিষয়ে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের সবকটিই আমাদের সংবিধানে থাকতে হবে। সে কারণে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের সবকটি বিষয়ই আমাদের সংবিধানে রয়েছে।’

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে এক নম্বর থেকে ৩০টি অধ্যায়ে মানবাধিকার প্রসঙ্গে বলা আছে। সেখানে উল্লেখ আছে প্রতিটি মানুষ মুক্ত এবং সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। প্রতিটি মানুষ ন্যায় বিচার পাবে। কাউকে বিনা বিচারে আটকে রাখা যাবে না। আইনের দৃষ্টিতে সবাইকে সমান চোখে দেখতে হবে। কোন মানুষকে মানবাধিকারবিরোধী ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করা যাবে না।

তিনি বলেন, দেশের মধ্যে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে কোনো ভেদাভেদ রাখা যাবে না। কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে সে যেন আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ পায়। প্রতিটা মানুষ শিক্ষা চিকিৎসা এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার পাবে। কোনো ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। একই কাজে বেতন বৈষম্য করা যাবে না। কোন ব্যক্তির সাজা প্রমাণের আগে তাকে নির্দোষ হিসেবে দেখতে হবে। আমাদের সংবিধান লক্ষ্য করলেও এসব বিষয় দেখা যাবে।

বাংলাদেশের সংবিধানের কথা উল্লেখ করে বিচারপতি মানিক বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানকে বিশ্বের অন্য দেশের সংবিধানের চেয়ে শীর্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আমাদের সংবিধানে এমন অনেক কিছু রয়েছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সংবিধানে নেই। এমনকি ভারতের সংবিধানও আমাদের মতো এত সমৃদ্ধ এবং পরিপক্ব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানও সেই অর্থে অপ্রতুল। পাকিস্তানের তো সংবিধানই নেই। সেখানে দেশ চালায় সেনাবাহিনী।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সংবিধানে সব মানুষের সমান অধিকার প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে। কিন্তু জিয়াউর রহমান এসে অন্যায়ভাবে আমাদের সংবিধান ওলটপালট করে তছনছ করে দেন। কিন্তু এখন জিয়াউর রহমানের দিন নেই। খালেদা জিয়ার দিনও চলে গেছে। সুতরাং আমরা যতটা সম্ভব ৭২ এর সংবিধানের কাছাকাছি চলে গিয়েছি।

আপিল বিভাগে খালেদার জামিনকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেদিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিএনপি যে মাস্তানি করেছে, তা স্পষ্টভাবে চরম মানবাধিকার লঙ্গন। এটা করে তারা বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। তারা আইনের শাসনের কথা বলতে বলতে‌ মুখে ফেনা তুলে ফেলে। অথচ সেদিন কালো কোট পরিয়ে কিছু লোককে আপিল বিভাগে ঢুকিয়ে দিলো। তারা তিনটি ঘণ্টা আপিল বিভাগ দখল করে রেখেছিল। কোনো মামলার কার্যক্রম চলতে দেয়নি। তাদের কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রপতিও মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি এ ঘটনায় আমাদের প্রধান বিচারপতিও বলতে বাধ্য হয়েছেন, সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিত।

গোলটেবিল বৈঠকে মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন সাউথ এশিয়ান ল’ইয়ার্স ফোরামের সভাপতি শেখ সালাউদ্দিন আহমেদ।

শুরুতেই কি-নোট উপস্থাপন করেন এসএএলএফ-এর রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট তানজিনা হোসেন চৈতি। গোলটেবিল বৈঠকে আরও আলোচনা করেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. বশির আহমেদ, ড. মোমতাজ উদ্দীন আহমেদ মেহেদী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান মো. রবিউল ইসলাম প্রমুখ।