মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব

জনসাধারণের প্রতি লাঞ্চনাকর আচরন এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব:

সম্প্রতি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সাবেক  সহকারী ভূমি কমিশনার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে জারি করা অবরোধ পরিস্থিতি তদারকি করতে গিয়ে কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তিকে কানে ধরে শাস্তি দেন এবং সেই ছবি তোলেন। খুব অল্প সময়ে সে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে, উঠে সমালোচনার ঝড়। জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করেন।

এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যকে জনসম্মুখে পিটিয়ে জখম করার অভিযোগ উঠেছে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) বিরুদ্ধে। গত শুক্রবার সন্ধায় উপজেলার কালুপীর বাজারে এ ঘটনা ঘটে।

এর আগে কুড়িগ্রামে স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোছা. সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।

এই ঘটনাগুলো নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার অপব্যবহারের যেমন স্পষ্ট প্রকাশ তেমনি আমাদের সাংবিধানিক চেতনারও লংঘন। আমরা যদি আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় দিকে নজর দেই দেখবো, জনগণের পরম অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরুপ এই সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। জনগণের মর্যাদা,অধিকার রক্ষা করাই মূলত সংবিধানের উদ্দেশ্য।

আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগন এবং জনগনের  অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরুপে এই সংবিধান প্রয়োগ করা হবে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে দেশের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের প্রয়োগব্যতিত কারো বিরুদ্ধে এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না  যাতে ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। এর সাথে আমরা সংবিধানের ৩৫ (৫)  অনুচ্ছেদের দিকে দৃষ্টি দিতে চাই, বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।”

সংবিধান থেকে এটা স্পষ্ট যে, দেশের জনগনের জন্যই সংবিধান প্রণীত হয়েছে, এবং তাদের মর্যাদা,অধিকার এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ধনী-গরীব অথবা কর্মকর্তা-শ্রমজীবী নয় বরং সকল নাগরিক সমান, তাদের মর্যাদা নষ্ট করার বা অমানবিক লাঞ্চনাকর কোন কাজ কখনই কেউ করতে পারে না। যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে সরাসরি তা সংবিধানের লংঘন। প্রজাতন্ত্রে যারা কাজ করেন অবশ্যই তারা জনগণের সেবক। জনগণের প্রতি অমানবিক কোন কাজ যেমন তারা করতে পারে না তেমনি তাদের কাছ থেকে খারাপ আচরন আশা করা যায় না।

পাশাপাশি মাজদার হোসেন মামলার ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরনের যে আদেশ হয়েছে, অর্থাৎ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদেরও লংঘন সহজেই অনুমেয় হচ্ছে।

যদিও ভ্রাম্যমান আদালতের বিচার সংক্রান্ত মামলাটি স্টে হয়ে আছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় ক্ষমতার ব্যবহার উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন আপিল বিভাগ। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের শুনানিকালে এ পর্যবেক্ষণ দেন আপিল বিভাগ। গত ২০১৮ সালের ১১ মে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) পরিচালনার ধারাসহ ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ১১টি ধারা ও উপধারাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। পরে রাষ্ট্রপক্ষের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ বছরের ১৪ মে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের এই রায় ১৮ মে পর্যন্ত স্থগিত করে দেন।

বাংলাদেশ United Nations Convention against Torture (UNCAT)) স্বাক্ষর করার পর “নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩” প্রণয়ন করে। এতে সব ধরনের অমানবিক,লাঞ্চনাকর বা নির্যাতনমূলক কাজকে আইনের লংঘন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। BLAST vs Bangladesh মামলায় মহামান্য আদালত যেসকল নির্দেশনা প্রদান করেছেন সেখানেও সকল প্রকার নির্যাতনকে আইনের লংঘন বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।

অবশ্যই ভ্রাম্যমান আদালত অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছেন এবং করেও যাচ্ছেন এটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির লাগাম আটকাতে বা অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম সংকট তৈরী ঠেকাতে, ভেজাল বা নিন্মমানের ভোগ্যপণ্য এবং প্রসাধনীর বিরুদ্ধে, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের বিরুদ্ধে, নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে, গণপরিবহনের অরাজকতা ঠেকাতে, মাদক সেবন পরিবহন এবং সংরক্ষণের বিস্তার রোধে, ইভটিজিং ও বাল্যবিবাহ রোধ সহ বিভিন্ন সংকটে এবং সুযোগ সন্ধানী মানুষের বিরুদ্ধে তারা খুব সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার জন্য তারা বাহবা পাবেই, তবে কিছু কিছু ব্যাপার সত্যি দুঃখজনক। “Injustice anywhere is a threat to justice everywhere.”

সবখানে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হোক, সরকারী কর্মকর্তাগণ দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে জনবহুল এই দেশে দায়িত্ব পালন করে চলেছে, দুই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ত তাদের কাজকে ছোট করবে না। পাশাপাশি সহনশীলতা এবং মানবতাবোধ সবখানে উজ্জল হয়ে উঠবে আমরা তেমনটাই আশা করি। সাথে সাথে জনগনও তাদের দায়িত্ব পালন ও আইনের প্রতিশ্রদ্ধাশীল হবেন।

লেখক- শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট। ghalibhit@gmail.com