মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব

সংবিধানে গুরুত্ব জানুক সবাই

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব খান:
বিভিন্ন আলোচনা এবং আলাপচারিতায় আমরা মৌলিক অধিকার বিষয়ে নানা রকম কথা বলতে শুনি। আমাদের সংবিধান এই আলোচনার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত করে দিয়েছে। কেননা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে উচ্চ আদালতে মামলা করার সুযোগ আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনে যেসব সুক্ষ্ম ঘটনা ঘটে তা হয়ত আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, সাধারণ জনগণ বুঝতেও পারেন না নিভৃতে তাঁর মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আরও বেশি। সাধারণ জনগণ এ বিষয়ে কতটা সচেতন সে প্রশ্ন তোলাই যায়। শুধু মৌলিক অধিকার নয় বরং সংবিধান, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ খুবই সীমিত জানেন।
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে,  রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ জনগণের অভিপ্রায়ের চরম অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধান প্রণীত হয়েছে। তবে বিশেষ কোন কারনে সংবিধান সম্পর্কে  আমাদের জানার আগ্রহ যেমন কম; তেমনি সাধারণ মানুষের কাছে ইহার গুরুত্ব কম।
সংবিধান রক্ষানাবেক্ষনের  দায়িত্ব রয়েছে বিচার বিভাগের হাতে। হয়ত আইন, আদালত, সংবিধান শব্দগুলো শুনলেই আমাদের মনে অন্য রকম এক ধরণের ভয়ের চিত্র ভেসে ওঠে। মানুষের মাঝে আদালত মানেই চোর, ডাকাত, খুন, ধর্ষনের মত অপরাধের কথা নাড়া দেয়। অথচ আদালত যে শুধু এসব অপরাধের বিচার করে না, বরং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ  বিষয়ে কাজ করে সে ব্যাপারে  জনগণ খুব বেশি ওয়াকিবহাল নয়।
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. ইকরামুল হক স্যার তাই বলেছিলেন, “গোল্ডলিফ সিগারেট চেনো, প্রফেসর নুরুল ইসলামকে চেনো না!” অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে আনীত রীট মামলায় (Professor Nurul Islam v Bangladesh (2000) 52 DLR (HCD) 413) “রাইট টু লাইফ” বা বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার  লঙ্ঘনের বিষয়ে মহামান্য আদালত কত জরুরী এবং তাৎপর্যপূর্ণ পর্যালোচনা দিয়েছিলেন তা হয়ত অনেকেরই অজানা। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন সিগারেট হরহামেশাই মানুষ যেখানে সেখানে খাচ্ছে, সবাই তা দাঁড়িয়ে দেখছে, বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া ভেসে বেরাচ্ছে, আর মানুষ তার নিজে এবং অপরের বেঁচে থাকার অধিকার  চরম ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে সে বিষয়ে কি সচেতন!
জনগন কেন সংবিধান, আইন, আদালত কে কঠিন ভেবে বসলো। গল্প-উপন্যাস যদি মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়তে পারে, মামলার ফ্যাক্ট তো তার থেকেও বড় গল্প-উপন্যাস বটে। কেননা সেখানে মানুষের জীবনের বাস্তব ঘটনার উল্লেখ থাকে, থাকে সমাজের প্রকৃতচিত্র, থাকেনা কোন কাল্পনিক চিন্তা।
আমরা বলতে পারি, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা গুলো না জানার প্রতি জনগণকে এক তরফা ভাবে দায়ী করা যায় না। হয়ত আমরা সেভাবে বিষয়টাকে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছি। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন গুরুত্বপূর্ণ; মৌলিক অধিকার কী ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ নয়? তাহলে কেন শুধু বিচারক, আইনজীবী কিংবা আইনের শিক্ষকগণের মধ্যেই এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সীমাবদ্ধ রইল?
আমাদের দেশে সাংবিধানিক আইনের উপর সব থেকে ভাল বই ধরা হয় মাহমুদুল ইসলাম স্যারের “Constitutional  Law of Bangladesh” বইটি। দেশ বরেন্য এই আইনবিদের নিকট আমরা সত্যি ভিষন কৃতজ্ঞ। তাঁর প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধা যে আমাদের মত অল্প বিদ্যা জানা আইন পড়ুয়াদের তিনি সংবিধান বিষয়ে দু চারটি লাইন পড়ার মত ব্যবস্থা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি গর্ববোধ করি কারণ মাহমুদুল ইসলাম স্যার ; আমরা একই উপজেলার মানুষ। বাংলাদেশের আইন শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কি আমরা কেউ অগ্রাহ্য করতে পারবো?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অনেকেই বলতে পারেন, বই পড়ে তো সবাই সংবিধান বুঝতে পারে না, সংবিধানের ব্যাখ্যা তো আর আমজনতা করতে পারেন না, এটা তো আদালতের এখতিয়ার এবং মানুষ এ নিয়ে আলোচনা করে আদালত অবমাননা করার মত বিপদে পরতেই পারে।
এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলতে চাই, সংবিধান ব্যাখ্যা বা আদালতের রায় তরজমা করার দরকার নেই, সংবিধান বলে যে একটি জিনিস রয়েছে, যেটা দেশের সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি গুলো সেখানে রয়েছে, সাধারণ মানুষের জীবন ধারনের মৌলিক বিষয় গুলো সন্নিবেশিত রয়েছে, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আদালত, বাজেট, নিয়োগ, নিবার্চন ইত্যাদি বিষয় রয়েছে সেগুলা অবশ্যই জানাতে হবে। সংবিধান কেন এবং এর গুরুত্ব বা কী সে বিষয়ে জানা কি প্রতিটি নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় হবার কথা নয়?
মানুষ জানলে তবেই তো আমরা আইন মানার প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারবো, নাগরিকের মৌলিক অধিকার গুলো সম্পর্কে সচেতন করতে পারবো, নাগরিক দায়িত্ব গুলো মেনে চলতে পারবো, রাষ্ট্রযন্ত্র ইচ্ছেমত তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেনা, মানুষ ন্যায় বিচার পাবে, নির্বিঘ্নে তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে, নিজেকে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং উন্নয়নে অংশগ্রহণ করাতে পারবে।
আর এর মাধ্যমেই শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা হবে, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। প্রতিফলিত হবে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যাক্তি। তার জন্য সব থেকে অগ্রণী ভুমিকা রাখতে পারেন দেশের আইনজীবীগণ।
লেখক- শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।