অ্যাডভোকেট তানভীর আহমেদ

ওয়েব সিরিজ বিতর্ক ও বাংলাদেশের আইন

মো: তানভীর আহমেদ:

বিভিন্ন ধরনের ওয়েব প্ল্যাটফর্মে দেখানোর জন্য বাংলাদেশের যারা ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করছেন তাদের মধ্যে অনেকেই দাবি করা শুরু করেছেন কোন ধরনের নীতিমালা তারা চান না, তারা খোলা জায়গায় (Open space) তাদের শিল্পকর্ম নির্মাণ করতে চান, তাতে নাকি স্বাধীনভাবে শিল্পকর্ম নির্মাণ করা যায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, এবং প্রধান বিচারপতি কিভাবে হবে সেটার জন্য যেমন আইন আছে, তেমনি প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান বা সেক্টরের জন্য আইন বা নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সেই প্রতিষ্ঠান বা সেক্টরের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য। ওয়েবপোর্টালে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের নীতিমালা এখন সময়ের দাবি, তার অনেকগুলি কারণের মধ্যে দুটি বিশেষ কারণ:- প্রথমত: দেশীয় সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতির হাত থেকে রক্ষা করা এবং দ্বিতীয়ত: সরকার এই প্রতিষ্ঠান বা সেক্টর থেকে অনেক রাজস্ব হারাচ্ছে, যেটা সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে সরকারের একটি আয়ের উৎস হতে পারে। এই প্রতিষ্ঠান বা সেক্টরের মধ্যে নেটফ্লিক্স অন্যতম যেটা একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জরিপ মতে, এটির গ্রাহকসংখ্যা দুই লক্ষাধিক এবং কোনধরনের সরকারি রাজস্ব না দিয়ে এটির মত আরো অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান আছে যারা আমাদের দেশ থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের দ্য সান পত্রিকায় প্রতি রবিবারে একজন নগ্ন নারী মডেলের ছবি পূর্ণাঙ্গ পৃষ্ঠা জুড়ে তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছাপানো হয় এবং সেটা যুক্তরাজ্যের কোনো ধরনের আইনের লংঘন নয়। ধরা যাক সকাল বেলা উঠে আমরা যদি দেখি আমাদের কোন জাতীয় পত্রিকায় এমনটি ছাপানো হয়েছে, তাহলে আমাদের অনুভূতি কেমন হবে? আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে এটির গ্রহণযোগ্যতা কতখানি? বিশ্বের সাথে আমাদের তাল মিলিয়ে চলার মানেটা এই নয় যে, অশ্লীলতা-নগ্নতা তাদের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে এসে আবার তাদের সামনে উপস্থাপন করা, বরং প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা উচিত।

আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম তারা কি সাহিত্য চর্চা করেন নাই? তাদের সমসাময়িক সময়ে তারা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে সবথেকে বেশি খ্যাতিমান ছিলেন। বিশিষ্ট নির্মাতা সত্যজিৎ রায় এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ স্যার তারা কি সিনেমা, নাটক নির্মাণ করেন নাই? অবশ্যই করেছেন, যেগুলি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিভাবে খ্যাতি পেয়েছে। তাদের মধ্যে কি কেউ অশ্লীলতা-নগ্নতাকে শিল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন? অবশ্যই নেন নাই। তাহলে কেন এগুলো নিয়ে এখন প্রশ্ন করা যাবে না?

সম্প্রতি আমাদের দেশে কয়েকটি ওয়েব সিরিজ আলোচনায় এসেছে, আমার একটি আইনি নোটিশ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পাঠানোর পর প্রায় সবগুলি জাতীয় পত্রিকায় নোটিশটি সম্পর্কে লেখা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অজস্র মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বেশিরভাগই বাংলাদেশের ওয়েব সিরিজকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যছিল।

আইনি নোটিশের কারণ ছিল, সিরিজগুলির অশ্লীল এবং নোংরা কিছু দৃশ্য, যেটা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। অতীতে বাংলাদেশের কোন নাটকের এমন দৃশ্য হয়েছে বলে আমার জানা নাই, বিষয়টি আমার নজরে আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলের রিপোর্ট দেখার পরে।

এই বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন সমূহ:

অশ্লীল অনুষ্ঠান কোনটি সংজ্ঞায়িত করা কঠিন কারণ এটা সময় বা স্থানভেদে পরিবর্তন হতে পারে, যেমন পাশ্চাত্য দেশে অনেক নগ্নতাকে অশ্লীলতা হিসেবে দেখা হয় না, কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেগুলি আবার অশ্লীলতা হতে পারে।

কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬ ধারা: ২ উপ-ধারা (২) অশ্লীল অনুষ্ঠান বলতে বোঝানো হয়েছে, এই আইনের ধারা ১৯ (সম্প্রচার সঞ্চালনের ক্ষেত্রে বাধা নিষেধ) এর উপ-ধারা (৯) এ নগ্নতা, নগ্ন ছায়াছবি, বস্ত্র উম্মোচন দৃশ্য, দেহ প্রদর্শন, অশোভন অংগভঙ্গী, যৌন ক্রিয়ার ইঙ্গিত সূচক বা প্রতীকী নাচ অথবা অশোভন দৃশ্যাবলী সম্বলিত এমন কোন অশ্লীল অনুষ্ঠান।

কেউ যদি চুরি করে সেটি আমাদের দেশীয় আইনে যেমন ফৌজদারি অপরাধ, তেমনি কেউ যদি পর্নোগ্রাফি তৈরি করে সেটিও দেশীয় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২, এ একটি ফৌজদারি অপরাধ। এই আইনে পর্নোগ্রাফি অর্থ ধারা: ২ (গ) (১) যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নিত্য যাহা চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্র, অডিও ভিজ্যুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, গ্রাফিক্স বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত বা প্রদর্শনযোগ্য এবং যাহার কোন শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই। এই আইনের ধারা: ৮ এ কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ৭ (সাত) বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ (দুই) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১, ধারা: ৬৯- অশ্লীল অশোভন ইত্যাদি বার্তা প্রেরণের দণ্ড
যদি-

(ক) কোন ব্যক্তি টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি বা কোন বেতার যন্ত্রপাতির সাহায্য কোন অশ্লীল ভীতি প্রদর্শনমূলক বা গুরুতরভাবে অপমানকর কোন বার্তা প্রেরণের উদ্দেশ্য উক্ত যন্ত্রপাতি পরিচালনার নিয়োজিত ব্যক্তির নিকট প্রস্তাব করেন বা

(খ) উক্ত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি সজ্ঞানে বা ইচ্ছাকৃতভাবে উক্ত বার্তা প্রেরণ করেন।
দোষী সাব্যস্ত হলে উভয়ের অনধিক ৬ (ছয়) মাসের কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় হতে পারে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ উপরোক্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে কেউ যদি এই আইনের অধীনে সংক্ষুব্ধ হন, তাহলে তিনি এই আইনের ধারা: ২৫, ২৮ এবং ২৯ অধীনে মামলা করতে পারবেন।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১ (সংশোধিত-২০১০) এর অধীনে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং ধারা: ১১ এ কমিশনকে টেলিযোগাযোগ সেবার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে (আইন, ২০০১ এর ধারা:৩১ প্রতিস্থাপন)। ধারা: ১২ সরকার চাইলে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার যেকোনো বিষয়ে নির্দেশনা জারি করতে পারে যেটা আইন সংশোধনের পূর্বে কমিশনের অধীনে ছিল।

এখানে একটি কথা বলা বাঞ্ছনীয় যে, ওয়েব সিরিজ যারা নির্মাণ করছেন তারা বিভিন্ন বয়সসীমার কথা উল্লেখ করছেন। আমার জানামতে আমাদের দেশে প্যারেন্টিং গাইডলাইন (বাবা-মায়ের নির্দেশনাবলী) বা সার্টিফিকেশন (প্রমাণপত্র দান) বা বয়সসীমার ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা এখনো হয় নাই বা বয়স সীমার জন্য সচেতনমূলক কার্যক্রমও নাই। তাহলে যারা বয়সসীমা বেঁধে দিচ্ছেন কার জন্য? বয়সসীমা নীতিমালা যদি তৈরি করাও হয়, যে ধরনের অশ্লীল ওয়েব সিরিজ তৈরি করা হয়েছে, সেটা কি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্করা সবাই মিলে দেখতে পারবো?

একজন আইনজীবী হিসেবে নয় একজন দর্শক হিসেবে সকল নির্মাতার প্রতি আমার আকুল আবেদন এই যে, আপনারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত মেধাবী এবং সৃজনশীল। প্রতিনিয়ত আপনাদের নির্মিত সিনেমা-নাটক আমাদেরকে উপকৃত করেছে, করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে, তাই কিছু স্বার্থন্বেষী নির্মাতার জন্য আপনাদের মেধা এবং সৃজনশীলতার উপর কারোর প্রশ্ন করার সুযোগ দিবেন না। আপনারাই আমাদের সমাজ সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং সম্মানের সাথে বিশ্বের সামনে তুলে ধরবেন অতীতের মতো।

লেখক: আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট