রাজীব কুমার দেব, সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

মাদক আইন সংশোধনে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা

রাজীব কুমার দেব:

প্রত্যেক ব্যক্তির একটি সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হচ্ছে “অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না……”

মৌলিক অধিকারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত আইন মোতাবেক সংগঠিত অপরাধটি আইনানুগ অপরাধ গণ্য করে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে কিনা তা বিচারিক নজরে আনা অধঃস্তন আদালতের বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব। এটিকে বিচারিক চর্চ্চায় “Judicial Activism” বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। অবশ্য এ দায়িত্ব পালন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের বিচক্ষণতা, মননশীলতা, অভিজ্ঞতা ও অভিপ্রায়ের উপর নির্ভর করে। কেননা এই দায়িত্বের সাথে সমাজ সংস্কারের ধারণাটি ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত।

উল্লেখ্য ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচার বিভাগের একজন সদস্যকে যখন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয় তখন ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ পদটি সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ম্যাজিস্ট্রেটকেই বুঝাবে এবং এটি তার নিয়মিত পদ। এ উদ্দেশ্যেই এই লেখায় বিজ্ঞ বিচারককে ম্যাজিস্ট্রেট নামে অভিহিত করা হয়েছে।

সাংবিধানিক বিধি বিধান অনুসারে সংসদ আইন প্রণয়ন করে তবে “Delegated Power” অনুবলে নির্বাহী বিভাগও প্রণীত আইনে সংশোধনী আনতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। এক্ষেত্রে সংসদীয় কার্য পদ্ধতি থেকে নির্বাহী বিভাগের সংশোধনী তৈরির প্রক্রিয়া ভিন্ন। কারণ সম্পূর্ণ প্রশাসনিক চরিত্রে আইনের প্রায়োগিক প্রয়োজন এবং প্রশাসনিক স্বার্থ বিবেচনায় প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংশোধনী আনয়ন করার রীতি আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। আপাত দৃষ্টিতে এ কার্যাদিতে অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা থাকা বা রাখার সমূহ সম্ভাবনা নেই। অধিকন্তু সাংবিধানিক কাঠামো ও প্রণীত আইনের প্রায়োগিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আইনের কালো অক্ষর গুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে অধঃস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে আইন প্রণয়ণ বা সংশোধনী কার্যাদিতে ভূমিকা থাকা বা রাখাও অকল্পনীয়। তবে সাম্প্রতিক কালের নির্বাহী বিভাগের একটি প্রজ্ঞাপন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উক্ত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর “খ” শ্রেণীতে “টাপেন্টাডল” (Tapentadol) কে মাদকদ্রব্য হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।

জানা যাক “টাপেন্টাডল” (Tapentadol) কি? টাপেন্টাডল (Tapentadol) হচ্ছে একটি উপকরণ যা দিয়ে ঔষধ তৈরি করা হয়। গুগলে এটিকে বর্ণনা করা হয়েছে ” Tapentadol, brand names Nucynta among others, is a centrally acting opioid analgesic of the benzenoid class with a dual mode of action as an agonist of the μ-opioid receptor and as a norepinephrine reuptake inhibitor.”

এখানে আরো বলা হয়েছে “Tapentadol is used for the treatment of moderate to severe pain for both acute (following injury, surgery, etc.) and chronic musculoskeletal pain. It is also specifically indicated for controlling the pain of diabetic neuropathy when around-the-clock opioid medication is required.” আরো জানা যায় এটি ১৯৮০ সালের শেষের দিকে জার্মানীতে আবিষ্কৃত হয়।

আমাদের দেশে টাপেন্টাডল” (Tapentadol) দিয়ে SK+F কোম্পানির Tapenta, ACI কোম্পানির Lopenta ও Square Pharmaceuticals এর Pentadol নামের ঔষধ তৈরি করে থাকে। উল্লেখ্য এই ঔষধ আমাদের দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত। সে অনুযায়ী এটি বাজারে সহজলভ্য। তবে অভিযোগ উঠেছে এটি নেশা জাতীয় দ্রব্য এবং এটি সেবনে নেশার সৃষ্টি হয়। তাই যদি হয়; ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমতি দিবে কেন?

বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে এবং বিচারিক বাস্তবতায় অধঃস্তন আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা কঠিন কাজ। কিন্তু এ অসম্ভব কঠিন কাজটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে দৃষ্টান্তমূলক বিচারিক বিচক্ষণতা (Landmarking judicial activism) দেখিয়েছেন লালমনিরহাট জেলার সাবেক অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং বর্তমানে দিনাজপুর জেলার অতিরিক্ত জেলা জজ জনাব মেহেদী হাসান মন্ডল মহোদয় যার জ্ঞানগর্ভ বিচারিক আলোচনা অনেক অনুজ বিচারকদের প্রেরণা যোগায়।

সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞ বিচারকের আমলী এলাকায় Tapenta, Lopenta, Pentadol ইত্যাদি ঔষধ বিক্রির বা দখলে রাখার অভিযোগে বিক্রেতা বা ক্রেতার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) ধারায় সংযুক্ত টেবিলের ১০(ক) ক্রমিকে প্রায় ১৫টি মামলা দায়ের করা হয় এবং যথারীতি অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত প্রথাগত বিচারিক নিয়ম (Traditional Judicial System) প্রয়োগ না করে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণে উপনীত হন যে, যদি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কোন ঔষধকে বৈধ মর্মে ঘোষণা করে তবে সেই ঔষধ সেবন করে নেশা হলেও পুলিশ নেশাকারীকে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আটক করতঃ মামলা আনয়ন করতে পারে না। পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয় যে, যদি সেই ঔষধে নেশা হচ্ছে মর্মে পুলিশ মনে করে তবে তাদের উচিৎ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে জানানো। যদি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর টাপেন্টাডোলকে নিষিদ্ধ করে তবেই পুলিশ মামলা করতে পারবে মর্মে মতামত দিয়ে আদেশের কপি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সহ পুলিশের আইজিপি বরাবর প্রেরণ করা হয়।

বর্ণিত প্রজ্ঞাপনে সেই টাপেন্টাডোল (Tapentadol) এখন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর তফসিলে স্থান পেয়েছে। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় যে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রস্তাব মতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং ফার্মেসী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে উক্ত “টাপেন্টাডল” (Tapentadol) কে মাদকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ উক্ত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে “টাপেন্টাডল” (Tapentadol) কে মাদকদ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত করে এটির উৎপাদন, বহন, দখল সেবন ইত্যাদি কে অপরাধ গণ্য করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।

এ প্রজ্ঞাপন তৈরিতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের ভূমিকাও প্রশংসনীয়। অধঃস্তন আদালতের আদেশটি পেয়ে মাদক আইনে উপযুক্ত সংশোধনীর লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতঃ প্রশাসনিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক পর্যবেক্ষণকে আইনি ফলাফলে রূপান্তর করার লক্ষ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক শাখা সংশোধনী তৈরি করেন।

আমাদের সংবিধান ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং ক্ষমতার সুষম বণ্টনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের অধঃস্তন আদালত প্রণীত আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে সম্ভাব্য সাংবিধানিক ব্যত্যয়ের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ আকারে নির্বাহী বিভাগের নজরে আনার পর নির্বাহী বিভাগও বিচারিক পর্যবেক্ষণটি গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এটি ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং ক্ষমতার সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সংবিধানের মূলমন্ত্র সুসংহত রাখার একটি চমৎকার উদাহরণ।

অধঃস্তন আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা এবং বিচারিক চতুরতা প্রয়োগ করে মাদক আইনে স্বীকৃত নয় কিন্তু বিচারের আওতায় আনার মত বে-আইনি কাজকে থামিয়ে দিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রশাসনিক নজরে এনে বর্ণিত সংশোধনী তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। অধঃস্তন আদালতের বিচারিক সংস্কৃতিতে এটি নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। ২০১৮ সালের মাদক আইন যতদিন বলবত থাকবে বর্ণিত সংশোধনীর সাথে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের তথা অধঃস্তন আদালতের বিচারিক ভূমিকার ইতিহাস ততদিন বেঁচে থাকবে।

রাজীব কুমার দেব: সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার।