অ্যাডভোকেট মুনতাসীর মাহমুদ রহমান

ই-জুডিসিয়ারি মানে হোক সিস্টেমের সহজীকরণ

মুনতাসীর মাহমুদ রহমান: প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব হলো একটি স্বচ্ছ ও দক্ষ পদ্ধতি গড়ে তোলা যা নিজে নিজে কাজ করতে পারে। অর্থাত স্থায়ী একটি কর্মপদ্ধতি দাঁড় করানো যাতে মানুষের কষ্ট কমে এবং কাজে স্বচ্ছতা আসে।

শুভ সংবাদ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, মাননীয় আইন মন্ত্রীর নেত্বিত্বে ই-জুডিসিয়ারি বাস্তবায়নের জন্য ২৮০০ কোটি টাকার বাজেটের ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে।

আইন পরিবারের একজন ক্ষুদ্র স্টেকহোল্ডার হিসেবে আমার বিনীত অভিমত হলো, এই বিশাল বাজেট যেন সঠিক কাজে লাগে। এই বাজেট যেন স্থায়ী একটি ই-জুডিসিয়ারির ভিত্তি স্থাপন করতে পারে যাতে বিচার প্রার্থী, আইনজীবী এবং আদালতের কষ্ট লাঘব হয় এবং বিচার কাজে স্বচ্ছতা আসে। ই-জুডিসিয়ারি যেন নিছক দামী ব্র্যান্ড এর কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা প্রিন্টার কেনার মত জিনিসে আটকে না যায় বা বাইরের কোন প্রতিষ্ঠানের হাতে সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট এর নামে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলে না যায়।

আমি মনে করি, ই-জুডিসিয়ারি এর বাজেট কাজে লাগানো উচিত সুপ্রিম কোর্ট এর মামলা ফাইলিং, এফিডেভিট সেকশন অনুলিপি বিভাগ, রেকর্ড সংরক্ষণ বিভাগ ইত্যাদির ডিজিটাইলেশন এবং মামলার ডিজিটাল এন্ট্রি ও কজ লিস্টসহ সুপ্রিম কোর্ট এর নিরিাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রবেশদ্বারের ডিজিটালাইজেশনে।

বিদ্যমান কোভিড সংক্রমণের বাস্তবতায়, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ’ভার্চুয়াল কোর্ট’ চালুকরণ ছিল সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আবার, এই ’ভার্চুয়াল কোর্ট’ আমাদের উচ্চ আদালতের অনেক পদ্ধতির অপর্যাপ্ততাও আমাদেরকে নতুন করে দেখিয়েছে। ই-জুডিসিয়ারি এর বাজেট এই ’ভার্চুয়াল কোর্ট’ এর জন্য অ্যাড-হক কোন পদ্ধতি গড়ে না তুলে সুপ্রিম কোর্ট এর সেকশন, ফাইলিং- ইত্যাদি স্থায়ীভাবে ডিজিটালাইজেশন এর জন্য বরাদ্দ করা উচিত।

’ভার্চুয়াল কোর্ট’ বর্তমান কোভিড সংক্রমণের বাস্তবতায় অস্থায়ী সঠিক পদক্ষেপ হলেও এটা কোন ভাবেই ’প্রকৃত আদালত’ (actual court with physical presence) এর বিকল্প হতে পারে না। কারণ সুপ্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি আদালত বা বিচার পদ্ধতির একটি অন্যতম প্রধান দিক হলো – প্রকাশ্য শুনানি (Public Hearing)। অর্থাৎ বিচার হতে হবে সবার সামনে, বিচার সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট উন্মুক্ত। কেবল উন্মুক্ত বিচার পদ্ধতিতেই স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব। আর উন্মুক্ত বিচারের মাধ্যমেই শতাব্দী থেকে শতাব্দী সিনিয়র আইনজীবীদের কাছ থেকে আইনি জ্ঞান, কলাকৌশল প্রবাহিত হয় জুনিয়র আইনজীবীদের কাছে। আবার বর্তমানের ভার্চুয়াল কোর্টে শুনানি ছাড়া আসলে সব কিছুই করতে হচ্ছে শারীরিকভাবে গিয়ে এবং পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে বারবার।

এ অবস্থায়, ই-জুডিসিয়ারি এর বাজেট কাজে লাগানো যায়

  • নতুন মামলা (মোশন) এর এফিডেভিট এর সিরিয়ালের জন্য রিয়েল টাইম (real time) এফিডেভিটের এন্ট্রির জন্য সফটওয়ার (বর্তমানের টেন্ডার সিস্টেম এর মাধ্যমে আমরা ইতোমধ্যে এগিয়ে আছি)। এন্ট্রি এর সিরিয়াল অনুযায়ী মামলা কোর্টে লিস্টেড হবে। সকল এফিডেভিট কমিশনার একই সফটওয়্যারে সংযুক্ত থাকবেন।
  • কোর্টে চলমান মামলা গুলোর রিয়েল টাইম ডিসপ্লে (real time display) থাকবে কোর্ট ও বার ভবনের প্রত্যেক ফ্লোরে। অর্থাৎ রানিং আইটেমগুলো ডিসপ্লে থাকবে কোন কোর্টে কত নম্বর আইটেম চলছে। এটা করাও খুব সহজ। পৃথিবীর প্রত্যেক আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে এরকম ডিসপ্লে বোর্ড আছে। খুব বেশি ফাস্ট মোশন কোর্টে হয়তো পুরোপুরি সম্ভব না। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরপর তো আপডেট দেয়াই যায়!
  • কোর্টে এবং সেকশনে অননুমোদিত ব্যক্তিদের প্রবেশ রোধে ডিজিটাল প্রবেশদ্বার করা। বিজ্ঞ আইনজীবী, কার্ক, কোর্ট কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) হতে পারে সেই এন্ট্রির পাসকার্ড। আর বিচার প্রার্থী বা সাংবাদিকদের জন্য ই-পাস এর ব্যবস্থা করা যায়। ভারতের রাজ্য পর্যায়ের হাইকোর্টেই এই ই-পাস ব্যবস্থা আছে। এবং অননুমোদিত কোন ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। কোর্টে অযাচিত ব্যক্তিদের প্রবেশ রোধ করা খুব দরকার।
  • লং কজ লিস্ট থাকবে ওয়েবসাইটে, অর্ধেক মামলা বা সম্ভাব্য যতটুকু করা যাবে ঐ রকম মামলা প্রিন্ট করা। প্রিন্টেড কজলিস্ট ছাড়া একটা কোর্টের কার্যক্রম ফলো করা যায় না। কিন্তু ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত লং কজ লিস্ট এর সিরিয়াল যেন ঠিক থাকে।

বারের নেত্বৃবৃন্দ এবং বিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেটদের মতামত নিয়ে এরকম আরও অনেক কিছু করা যায়। সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রিতে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ অত্যন্ত দক্ষ এবং চৌকস। কিন্তু স্বল্প সময়ের জন্য পোস্টিং হওয়ায় এবং কোর্ট এর ব্যবহারিক কাজে জড়িত না থাকায়, প্রকৃত সমস্যা সম্পর্কেই অবগত না থাকায়, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও হয়তো মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে সঠিক সমাধানের প্রস্তাব দিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে বারের বিজ্ঞ সিনিয়রদের যুক্ত করলে অনেক ভাল ফলাফল আসার সম্ভাবনা থাকে।

ই-জুডিসিয়ারির বাজেট নিছক দামী গ্যাজেট বা ল্যাপটপ উপহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে কাজে লাগুক, প্রকৃত অর্থেই ডিজিটাল সিস্টেম গড়ে তুলতে যেখানে কাজে আসবে গতি ও স্বচ্ছতা। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য হয়ে উঠুক রোল মডেল, পথ প্রদর্শক।

মুনতাসীর মাহমুদ রহমান: অ্যাডভোকেট; বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।