বাংলাদেশের উচ্চ আদালত

ধর্ষণ মামলার বিচারে হাইকোর্টের ৭ নির্দেশনা বাস্তবায়নে রায় গেল ট্রাইব্যুনালে

উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণ মামলার বিচারে ৭ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের অনুলিপি সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মোঃ আলী আকবর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০১৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত ৭২৫২ এবং ৭৩৫৭ নং ফৌজদারি আপিল মামলায় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ কর্তৃক একই বছরের ১৮ জুলাই প্রদত্ত আদেশে দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসমূহে বিচারাধীন ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা সংক্রান্ত মামলাসমূহসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর অধীন অন্যান্য মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কতিপয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন। প্রদত্ত নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উক্ত আদেশের অনুলিপি প্রেরণ করা হয়।

এর আগে, ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলার বিচার করতে নিম্ন আদালতের বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর, সাক্ষী, পুলিশ, চিকিৎসক বা মামলার অন্যান্য বিশেষজ্ঞের প্রতি সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাত দফা নির্দেশনাসহ রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে প্রদত্ত সাত দফা নির্দেশনায় বলা হয়েছে—

১. দেশের সব নিম্ন আদালতকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইনের নির্ধারিত সময়সীমার (বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিন) মধ্যে দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।

২. ট্রাইব্যুনালগুলোকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-এর ধারা ২০-এর বিধান অনুসারে মামলার শুনানি শুরু হলে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে।

৩. ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবেন এবং কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিমাসে সুপ্রিম কোর্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে। যেসব জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, সেসব জেলায় সব ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটররা মনিটরিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং তাদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ, তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।

৪. ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সঙ্গত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটিকে জবাবদিহি করতে হবে।

৫. মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের নামে দ্রুততম সময়ে যাতে সমন জারি করা যায়, সে বিষয়েও মনিটরিং করবেন।

৬. নির্ধারিত তারিখে সমন পাওয়ার পরও অফিসিয়াল সাক্ষীরা, যেমন−ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, চিকিৎসক বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সন্তোষজনক কারণ ব্যতিরেকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য উপস্থিত না হলে, ট্রাইব্যুনাল ওই সাক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ এবং প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ দেওয়ার বিবেচনা করবেন।

৭. আদালতের (হাইকোর্টের) সুচিন্তিত মতামত এই যে, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে, সরকার অতি স্বল্প সময়ে উক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে।

উল্লিখিত নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এ আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া রায়ে আদালত মতামত ও প্রত্যাশা অংশে উল্লেখ করেন, ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলার আসামিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়া ও দুর্দান্ত প্রকৃতির। এরা ভিক্টিম ও তার পরিবারের উপর চাপ-প্রভাব বিস্তার করে আদালতে সাক্ষ্য প্রদানে ভয়-ভীতি, প্রলোভনসহ বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করে। ক্ষেত্রবিশেষে সালিশের নামে সামাজিক বিচার করে ভিকটিম ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য এবং আদালতে সাক্ষ্য প্রদানে বিরত থাকার জন্য চাপ প্রদান করে থাকে।

উপরোক্ত অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আদালতের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে যে, সরকার দ্রুততম সময়ের উক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে।

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর উক্ত বিভাগের (হাইকোর্ট) তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকবে বলে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ অনুসরণ করেই হাইকোর্ট এই সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।