মুজিবুর রহমান: বিচারক; বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম

মুজিবুর রহমান:
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সবচেয়ে গভীরতম উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বানের স্রোতের মতো বাংলাদেশে এসেছে। আশির দশক থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সম্মুখীন। ২০১৭ সালের পর সেটি প্রকট ও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ পরিষদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে এক দশমিক এক মিলিয়ন (১১ লাখ) রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটি বিশ্ব দরবারে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের জনস্রোত বৃদ্ধির সাথে সাথে, টেকনাফ-উখিয়া উপজেলাসহ কক্সবাজার জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। অপরাধ সংঘটনের ধরণ ও মাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
রোহিঙ্গাদের বিশাল জনগোষ্ঠী এবং বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতা, পারস্পরিক অসন্তোষ, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। উক্ত ঝুকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সাথে সাথে উক্ত ঝুকি মোকাবেলায় অপরাধের বিচার নিশ্চিতের জন্য পদক্ষেপ নেওয়াও অতীব জরুরি।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ডেইলি স্টারের রিপোর্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়- ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের প্রবেশের পর ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। যার মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী সংক্রান্ত মামলা ৩১ টি। এসব মামলায় আসামি ১০৮৮ রোহিঙ্গা।
২০২০ সালের  ২১ নভেম্ভর যুগান্তর পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়- প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৩৪টি আশ্রয় শিবির নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তত ৩২টি সন্ত্রাসী দল ও উপদল। ২০১৮ সালে ২০৮টি মামলায় আসামি করা হয় ৪১৪ জনকে। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ২৬৩ আর আসামি ৬৪৯ জন। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০০ মামলা হয়েছে; যেসব মামলায় আসামির সংখ্যা অন্তত ৫০০।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তাসহ বেশকিছু বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ক্যাম্পের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ, গত দুই অর্থবছরে (২০১৯-২০ ও ২০২০-২১) ২৬৫ কোটি টাকা ছাড়করণ, প্রয়োজনীয়সংখ্যক ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, সিসি ক্যামেরা স্থাপন, বেষ্টনীর চারপাশে টহলে রাস্তা নির্মাণ করা হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশেপাশের এলাকায় অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যাপক অবনতি হওয়ায় পুলিশ ক্যম্প সহ বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, অপরাধের বিচার করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি বা বিচার নিশ্চিতের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যায়নি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করার সাথে সাথে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, নিরাপত্তা কার্যক্রম ফলপ্রসূ হতে ব্যর্থ হতে পারে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে, সেটি মূলত ক্যাম্প-ইন-চার্জ(সিইসি) বা ক্যাম্পে নিয়োজিত বিভিন্ন আইনি সহায়তা প্রদানকারী এনজিও-এর মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সাধারণ ও ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে সিইসি বা এনজিও প্রতিনিধিরা আপোষ মীমাংসার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে থাকেন। আর গুরুতর অপরাধ যেমন- হত্যা, ধর্ষণ, গুরুতর জখম বা হত্যাচেষ্টা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ক্যাম্প-ইন-চার্জ(সিইসি) বা এনজিওদের নজরে আসলে, সেটা তারা পুলিশকে অবহিত করেন। পুলিশ পরবর্তীতে প্রচলিত আইনি পদ্ধতিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। এনজিও গুলো মূলত ভিকটিমদের বা মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সহায়তা যেমন- যাতায়াত, মামলার করার পদ্ধতি, মামলার তারিখ জানানো এসব বিষয়ে সহায়তা করে থাকে। এর বাইরে সহায়তা করার মতো তাদের সুযোগ কম থাকে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহের অস্থিরতা প্রশমন করতঃ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে, সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সংঘটিত অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা অতীব জরুরি। এছাড়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের আইন সম্পর্কে জ্ঞাত নয় এবং ভিকটিমদের সুরক্ষাও সুনিশ্চিত নয়। ফলে, অর্থনৈতিক অস্থিরতার সাথে সাথে বিচার না পাওয়ার ক্ষোভ ও ক্রোধ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ক্যাম্প-ইন-চার্জ(সিইসি) বা এনজিও কর্মীরা অপ্রচলিত পদ্ধতিতে আপদকালীন আপোষ-মীমাংসা বা এডিআর করলেও, তারা আপোষ-মীমাংসা বা এডিআর করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত নয়। ফলে এক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইনগত সহায়তা প্রদানকল্পে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ ও আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা,২০১৪ প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা’র অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার কার্যক্রম হচ্ছে বিনামূল্যে সরকারিভাবে আইনি সেবা প্রদান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুপরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসাররা বাংলাদেশের অসচ্ছল-অসহায় বিচার প্রার্থীদের যে আইনি সহায়তা প্রদান করছে সেটি ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। একইভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহে উক্ত বিনামূল্যে আইনি সহায়তা কার্যক্রম অসহায় ও অসচ্ছল রোহিঙ্গাদের জন্য অন্ধকারের মাঝে আলোর দিশারির মত কাজ করবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থানকালীন সময়ের জন্য বিচারপ্রাপ্তির পথ সহজীকরণ ও অস্থিরতা প্রশমনের মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা সুনিশ্চিতকরণে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০-এর অধীনে প্রতিটি ক্যাম্পে একজন করে লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ প্রদান করা গেলে সেটি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। লিগ্যাল এইড অফিসার-রা আপোষ-মীমাংসা বা এডিআর সম্পাদনের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। আবার লিগ্যাল এইড অফিসাররা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্য তথা বিচারক হওয়ায় এরা বিচারিক আদালতের খুটিনাটি প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ফলে, তারা একদিকে মামলা সমূহের আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে মামলাজট কমাতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি ভিকটিম বা শরণার্থী বিচারপ্রার্থীদের আইনি সহায়তা প্রাপ্তির পথ সুগমে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে পারবে। এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিভিন্ন দেওয়ানী বিষয় সমূহ একধরণের উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। শরণার্থীদের দেওয়ানী বিষয় ও অধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রেও লিগ্যাল এইড অফিসাররা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা রাখতে পারে।
এক্ষেত্রে একজন জেলা জজকে কমিশনার করে তার নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লিগ্যাল এইড অফিসার পদায়ন করলে, এটি আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। তাছাড়া আইনি সহায়তা প্রদানকারী এনজিও কর্তৃক বিচারপ্রার্থীদের আইনি পরামর্শ ও আইনগত সহায়তা প্রদানের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উক্ত লিগ্যাল এইড অফিসাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কক্সবাজার জেলার বিচারিক আদালতসমূহ এমনিতেই মামলার ভারে ন্যুজ্ব। সেখানে ১১ লক্ষাধিক নতুন শরণার্থীদের মাধ্যমে উদ্ভূত মামলা সমূহের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা একটি দুঃসাধ্য বিষয়। এছাড়া কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী বৃদ্ধির সাথে সাথে মাদক বিশেষ করে ইয়াবা সংক্রান্ত অপরাধের সংখ্যা অত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিকসময়ে, বাংলাদেশ বিশ্বে বার বার শিরোনাম হয়েছে মানবপাচারের জন্য। প্রচুর পরিমাণ রোহিঙ্গা শরনার্থী বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর পাড়ি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা মানবপাচারের অপরাধ বৃদ্ধি চরম আকার ধারন করেছে।
শরণার্থীদের বিশাল সংখ্যা ও অপরাধের হারের কয়েকশ গুণ বৃদ্ধি হলেও,  কক্সবাজার জেলা জজ আদালত বা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অধীনে কোনো নতুন কোর্টও সৃজন করা হয়নি। ফলে, মামলার সংখ্যা একদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে চলমান মামলার গতি শ্লথ হয়ে পড়ছে। মামলার চাপে বিচারিক আদালত ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টসমূহের অবস্থা খুবই নাজুক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহের শরণার্থীর সংখ্যা ও ক্যাম্প সংখ্যার উপর ভিত্তি করে নতুন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও বিচারিক আদালত সৃজন অতীব জরুরি।
একটি সমাজ বা গোষ্ঠীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা ও শান্তি নিশ্চিত করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হচ্ছে বিচার নিশ্চিতের মাধ্যমে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন। ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধানতম মানবাধিকার। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পসমূহে নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনয়নসহ ভিকটিমদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং উদ্ভূত মামলা সমূহের আপোষ নিষ্পত্তিসহ বিচারপ্রার্থীদের প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিটি ক্যাম্পে লিগ্যাল এইড অফিসার নিয়োগ করা হলে ন্যায়বিচার প্রার্থীদের শঙ্কা ও অস্থিরতা প্রশমিত হবে এবং শরণার্থীদের মধ্যকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। তাই, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা প্রদানের এই অসাধারণ উদ্যোগ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পেও সুনিশ্চিত করা হোক। এর মধ্য দিয়ে বিনামূল্যে সরকারি আইনি সহায়তা প্রদানের এই অসাধারণ কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়বে।
লেখক- বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস।