চন্দন কান্তি নাথ: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।

অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচারের স্থান- আইন যা বলে

চন্দন কান্তি নাথ:

প্রত্যেক ব্যক্তি দণ্ডবিধির বিধানাবলীর পরিপন্থী কাজ করা বা না করার কারণে দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তি পাবেন। (ধারা ২ দন্ডবিধি, ১৮৬০) কোন থানায় কোন আমলযোগ্য অপরাধ হলে তা উক্ত থানার অফিসার ইনচার্জ রেকর্ড করেন।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় আছে, ”কোন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট কোন আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটন সম্পর্কে মৌখিকভাবে দেওয়া প্রত্যেকটি সংবাদ তিনি লিখে নেবেন অথবা তার নির্দেশক্রমে তা লিখিত হবে এবং সংবাদদাতাকে তা পড়ে শুনাতে হবে এবং লিখিতভাবে প্রদত্ত বা উপযুক্ত মতে লিখিত প্রত্যেকটি সংবাদ প্রদানকারী ব্যক্তি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হবে এবং তার সারমর্ম উক্ত অফিসার কর্তৃক এই এতদুদ্দেশ্যে সরকারের নির্ধারিত আকারে রক্ষিত একটি বইতে লিপিবদ্ধ করতে হবে। ” কিন্তু ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৫ ধারায় আছে, ” কোন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের নিকট উক্ত থানার মধ্যে কোন আমল অযোগ্য মামলার অপরাধ সংগঠন সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া হলে তিনি এর সারমর্ম উপযুক্তভাবে রক্ষিত বইতে লিপিবদ্ধ করবেন এবং সংবাদদাতাকে ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট প্রেরণ করবেন। ” উভয় ধারা পাঠ করার পর বুঝা যায়, আমলযোগ্য অপরাধ স্থানীয় থানার সীমার মধ্যে রেকর্ড না হলেও হবে কিন্তু অআমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে স্থানীয় থানার সীমার মধ্যে কথা উল্লেখ করা হয় এবং তা স্থানীয় থানার সীমার মধ্যে রেকর্ড হতে হবে।

আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ থানায় যাওয়ার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট থানা তা রেকর্ড করতে বাধ্য। কিন্তু অপরাধ সংঘটন সম্পর্কে কোনো আমলযোগ্য অপরাধ থানায় রেকর্ড হওয়ার পর তদন্ত হয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৬(১) ধারা অনুসারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৫৬(১) এ উল্লেখ করা হয়েছে কোন থানার সীমার মধ্যেই স্থানীয় এলাকার এক্তিয়ারে কোন আদালত তদন্ত বা বিচার সম্পর্কিত পঞ্চদশ অধ্যায় ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৭৭ থেকে ১৮৯ এর বিধান অনুসারে এই রকম ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত করতে পারবেন।

ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৭৭ এ আছে, ”প্রত্যেকটি অপরাধ যে আদালতের একটি এক্তিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে সংঘটিত হয় সাধারণত সেই আদালত কর্তৃক তার অনুসন্ধান ও বিচার হবে।”

উক্ত পঞ্চদশ অধ্যায়ের বিধান অনুসারে সরকার চাইলেই যে কোন জেলায় বিচারের জন্যে কোন দায়রায় কোন মামলা পাঠাতে পারবেন। যে কাজ করা হয়েছে বা তার ফলাফল দেখা দিয়েছে তার ভিত্তিতে কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হলে এই রূপ অপরাধের অনুসন্ধান বা বিচার যে আদালতের এক্তিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে উক্ত কাজ করা হয়েছে সে আদালতে অথবা যে আদালতের স্থানীয় সীমার মধ্যে তার ফলাফল দেখা দিয়েছে সে আদালতে হতে পারবে। যেমন করিম চট্রগ্রাম আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে আহত হলেন।

কিন্তু কুমিল্লা আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হল। সেক্ষেত্রে করিমের প্রাণনাশ করিবার তদন্ত, অনুসন্ধান এবং বিচার চট্টগ্রাম বা কুমিল্লা আদালতে হতে পারবে। আবার করিম চট্রগ্রাম এর একটি স্থানীয় সীমার মধ্যে আহত হল এবং কুমিল্লা আদালতের স্থানীয় সীমার মধ্যে ১০ দিন এবং ঢাকার স্থানীয় সীমার মধ্যে আরও দশ দিন যাবত তার দৈনন্দিন কাজ করতে পারলোনা। করিমকে গুরুতর আহত করার অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চট্টগ্রাম-কুমিল্লা ঢাকায় যেকোন স্থানে হতে পারবে। করিমকে চট্টগ্রাম আদালতের একটি স্থানীয় সীমার মধ্যে ভীতি প্রদর্শন করা হলো এবং কুমিল্লা আদালতের স্থানীয় সীমার মধ্যে ভীতি প্রদর্শনকারীর নিকট সম্পত্তি হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হল। করিমের নিকট হতে বলপূর্বক সম্পত্তি আদায় করার অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চট্টগ্রাম বা কুমিল্লা আদালতে হতে পারবে। একইভাবে করিম ঢাকায় আহত হলো। কিন্তু এর ফলে চট্টগ্রামে মারা গেল। করিমের মৃত্যু ঘটার অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চট্টগ্রাম এ হতে পারবে। (ধারা-১৭৮,১৭৯)

আবার করিম রহিমকে চট্টগ্রামে প্ররোচনা অথবা অপরাধ করতে সহযোগিতা করেছে। রহিম ঢাকায় এসে অপরাধ করেছে। উক্ত অপরাধের বিচার, তদন্ত ঢাকায় অথবা চট্টগ্রামে হতে পারবে। করিম ঢাকায় একটি আলুর বস্তা চুরি করেছে। রহিম কুমিল্লাতে তা গ্রহণ করেছে। শাহিন চট্টগ্রামে তা রেখেছে।উক্ত অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চট্টগ্রাম-কুমিল্লা ঢাকায় যেকোন স্থানে হতে পারবে।

আবার করিমকে চট্টগ্রাম অপহরণ করা হয়েছে। কিন্তু তাকে রাখা হয়েছে কুমিল্লায়। উক্ত অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চট্টগ্রাম-কুমিল্লায় যেকোন স্থানে হতে পারবে।একই রূপে করিম ঠগ(thug) হল। ঠগ হয়ে খুন, ডাকাতি, খুন সহ ডাকাতি করল বা ডাকাত দলের সদস্য হল কিংবা হেফাজত হতে পালালো। সে যে আদালতের এক্তিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে রয়েছে, সে আদালতে তার তদন্ত, বিচার অনুসন্ধান হতে পারবে। আবার কোন ব্যক্তি অপরাধজনক তছরুপ (Criminal misappropriation) বা অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ (Criminal Breach of Trust) করল।সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধ এর সম্পত্তির কোন অংশ যেখানে গ্রহণ করেছে বা রেখেছে অথবা যেখানে অপরাধ সংঘটন করেছে,সেখানকার যেকোনো আদালতে উক্ত অপরাধের তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচার হতে পারবে। অনেক সময় চুরি,চুরি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন অপরাধ বা চোরাই মাল রাখার অপরাধ হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে যেখানে চুরি হয়েছে বা চোরাই মাল রাখা হয়েছে, সেখানে উক্ত অপরাধের তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচার হতে পারবে। অথবা কোন ব্যক্তি যেখানে তা গ্রহণ করেছে বা তার দখলে রেখেছে, সেখানকার আদালতে তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচার হতে পারবে। আবার ধরা যাক,করিমকে চট্রগ্রাম হতে অপহরণ (Kidnap) বা হরণ (Abduction) করা হয়েছে।কুমিল্লা তে প্রেরন করা হয়েছে বা গোপন রাখা হয়েছে বা আটক রাখা হয়েছে। উক্ত অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চট্টগ্রাম-কুমিল্লায় যেকোন স্থানে হতে পারবে।(ধারা-১৮০,১৮১)

আর যে ক্ষেত্রে কোনো অপরাধ আংশিকভাবে একটি স্থানীয় এলাকায় এবং আংশিকভাবে অন্য একটি স্থানীয় এলাকায় সংগঠিত হয় অথবা যে ক্ষেত্রে কোনো অপরাধ চলছে এমন হয় যা একাধিক স্থানীয় এলাকায় সংগঠিত হতে থাকে অথবা যে ক্ষেত্রে অপরাধটি বিভিন্ন এলাকায় করা কার্যের সমষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে এরূপ স্থানীয় এলাকার যেকোনো একটিতে উক্ত অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চলতে পারে। আবার যখন এটি অনিশ্চিত থাকে যে, কয়েকটি স্থানীয় এলাকার মধ্যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে,সেক্ষেত্রে ও এরূপ স্থানীয় এলাকার যেকোনো একটিতে উক্ত অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চলতে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রমাণ করতে হবে যে, অপরাধটি কোন এলাকায় সংঘটিত হয়েছে সে সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ভ্রমণকালে বা সমুদ্রযাত্রায় ও অনেক অপরাধ সংগঠিত হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে অপরাধের শিকার ব্যক্তি অথবা অপরাধী যাত্রা পথের সদস্য হয়।এমন কি বস্তু ও যাত্রা পথে পরিভ্রমণ করে।সে ক্ষেত্রে অপরাধী, অপরাধের শিকার ব্যাক্তি এবং বস্তু যে এলাকার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে,সে এলাকায় যেকোনো একটিতে উক্ত অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চলতে পারে। আবার কোথায় কোন অপরাধের অনুসন্ধান বা তদন্ত বা বিচার চলবে তা নিয়ে সন্দেহ বা প্রশ্ন দেখা দিলে মাননীয় হাইকোর্ট কর্তৃক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (ধারা-১৮২,১৮৩,১৮৪)

মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট তার স্থানীয় সীমার মধ্যে বসবাস করা কোন ব্যক্তি তার স্থানীয় সীমার বাইরে দেশে বা বিদেশে অপরাধ করেছেন মর্মে বিশ্বাস করতে পারেন। সে জন্য তার নিকট কারণ থাকলে তিনি অপরাধটি তার স্থানীয় সীমার মধ্যে হয়েছে ধরে নিয়ে উক্ত অপরাধী কে তার নিকট হাজির হতে বাধ্য করতে পারেন।অথবা এইরূপ অপরাধের অনুসন্ধান বা বিচারের জন্য এক্তিয়ারবান একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট তাকে প্রেরন করতে পারবেন। অথবা অপরাধটি জামিনযোগ্য হলে তাকে হাজির হবার জন্য জামিনদার সহ বা ব্যতীত মুচলেকা গ্রহণ করতে পারবেন।

যখন এরূপ এখতিয়ারবান ম্যাজিস্ট্রেট একাধিক থাকেন এবং ১৮৬ ধারা অনুসারে কার্যরত ম্যাজিস্ট্রেট স্থির করতে পারেন না যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কোন্ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করতে হবে বা হাজির হতে বাধ্য করা হবে,তখন তিনি আদেশের জন্য বিষয়টি হাইকোর্ট এ প্রেরন করবেন।আর এরূপ কোন আসামি গ্রেপ্তার হলে তাকে তার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট পাঠাতে পারেন অথবা পরোয়ানা প্রয়োগকারী পুলিশ অফিসারের নিকট অথবা পরোয়ানা প্রদানকারী ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট প্রেরণ করতে হয়।

বাংলাদেশের কোন নাগরিক বাংলাদেশের বাইরে কোন অপরাধ করলে বা কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে রেজিস্ট্রিকৃত কোন জাহাজ বা উড়োজাহাজে ( তা যেখানেই থাকুক না কেন) কোন অপরাধ সংঘটন করলে,তখন বাংলাদেশের যে স্থানেই তাকে পাওয়া যাবে, সে স্থানে অপরাধ সংঘটন করেছে বলে ধরে নিয়ে সে মোতাবেক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।

আর এক্ষেত্রে কোনো অপরাধের অনুসন্ধান বা বিচার যখন হয় তখন সরকার উপযুক্ত মনে করলে নির্দেশ দিতে পারবেন যে, যে স্থানে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, সে এলাকার বিচারবিভাগীয় কোন অফিসারের নিকট যে সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে বা প্রদর্শনী হাজির করা হয়েছে, তার নকল অনুসন্ধান বা বিচার অনুষ্ঠান কারী আদালত কর্তৃক সে সকল ক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হবে, যে সকল ক্ষেত্রে উক্ত আদালত উত্তর সাক্ষ্য বা প্রদর্শনী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য কমিশন প্রদান করতে পারতেন।

তবে শর্ত থাকে যে, সর্বক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি ব্যতীত দেশের বাইরের কোন অপরাধ সম্পর্কিত কোন অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত বাংলাদেশের ভিতরে হবে না।

আর উপরোক্ত নিয়মেই অপরাধের অনুসন্ধান বা বিচার বা তদন্ত এর স্থান নির্ধারণ হয়ে থাকে।

লেখক- সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।