সাঈদ আহসান খালিদ
সাঈদ আহসান খালিদ; সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

অগ্নি-মৃত্যুর আইনি দায় : দূর্ঘটনা না হত্যা?

সাঈদ আহসান খালিদ :

রূপগঞ্জে সেজান জুসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এখন অব্দি ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় কারখানার মালিক, সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান, মোহাম্মদ আবুল হাসেম বলেছেন, ‘কারখানায় আগুন লাগতেই পারে, আমি তো আর যেয়ে আগুন লাগিয়ে দেইনি, এর দায় কি আমার? এটা একটা দূর্ঘটনা’। (সূত্রঃ দ্য ডেইলি স্টার, ০৯ জুলাই ২০২১)

কারখানার অগ্নি-নিরাপত্তাঃ আইন ও বাস্তবতা

‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’ এর ৬২ ধারায় কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে মালিকের দায়িত্বের কথা বলা আছে। এই ধারানুসারেঃ

– কারখানা ভবনের প্রতি ফ্লোরের সাথে সংযোগসহ একটি বিকল্প সিঁড়ি ও বহির্গমনের উপায় রাখতে হবে;

– প্রত্যেক তলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের ব্যবস্থা রাখতে হবে;

– ভবনের কক্ষ হতে বহির্গমনের সিঁড়ি ও দরজা তালাবদ্ধ বা আটকে রাখা যাবে না।

একই আইনের ৭২ ধারানুসারে, শ্রমিকদের কারখানায় চলাচলের পথ ও সিঁড়ি অবাধ ও প্রশস্ত রাখতে হবে, এবং ৭৮ ধারানুযায়ী, কারখানায় বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ থাকলে বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে। শ্রম আইন ছাড়াও কারখানা পরিচালনায় প্রযোজ্য হয় পরিবেশ আইন, বিল্ডিং কোডসহ নানা কমপ্লায়েন্স রুলস।

অথচ, সেজান জুসের কারখানায় বাস্তবতা ছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত। ছয়তলা বিশাল কারখানা ভবন থেকে বের হওয়ার পথ (সিড়ি) মাত্র দুটি; সেটিও অপ্রশস্ত- মানা হয়নি বিল্ডিং কোড, ছিল না কোন জরুরি বিকল্প নির্গমন পথ, গেট ছিল বন্ধ, ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে- পাওয়া যায়নি কোন অগ্নিনির্বাপনব্যবস্থাও, শ্রম আইনের লঙ্ঘন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল শিশু-শ্রমিক যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পুড়ে মরেছে, এই কারখানায় মিলেছে প্রচুর দাহ্যপদার্থ ও রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি যা অগ্নিকাণ্ডের তীব্রতা ও স্থায়ীত্ব বাড়িয়েছে, অঙ্গার বানিয়েছে ৫২ টি মানবশরীর।

‘দূর্ঘটনা’ ও দায়মুক্তির আইন:

ফৌজদারি মামলায় দূর্ঘটনা (Accident) বা দৈবদুর্বিপাক (misfortune) একটি বৈধ ডিফেন্স। কারো এমন কাজ যার ফলে অন্যের জান-মালের ক্ষতি হয়েছে সেটি-কে ‘দূর্ঘটনা’ প্রমাণ করতে পারলে অভিযুক্ত আইনে দায়মুক্তি লাভ করতে পারে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৮০ ধারা অনুসারে, একজন অভিযুক্ত এই দায়মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু, এই ধারায় দায়মুক্তি পেতে নিম্নের শর্তপূরণ করা আবশ্যকঃ

ক) কাজটি আইনানুগ ছিল;

খ) কাজটি আইনগত পদ্ধতিতে করা হয়েছিল;

গ) কাজটি করার পেছনে কোন অপরাধমূলক মনোবৃত্তি ছিলো না;

ঘ) কাজটির ফলে ক্ষতি হতে পারে- এটি তিনি অবগত ছিলেন না; এবং,

ঙ) যথোপযুক্ত যত্ন ও সতর্কতার সাথে কাজটি করা হয়েছিল।

এবার, অভিযুক্ত হাসেম এর বক্তব্যে ফিরি। তাঁর সাফাই অনুসারে, ধরে নিলাম, এই ৫২ জনকে আগুনে পুড়িয়ে মেরা ফেলার অপরাধমূলক মনোবৃত্তি তাঁর ছিলো না। কিন্তু, তাতে তাঁর এতসব ‘নন-কমপ্লায়েন্স’ দণ্ডবিধির ৮০ ধারা অনুসারে ‘দূর্ঘটনা’ হয়ে যায় না, এবং দূর্ঘটনার ডিফেন্স এখানে প্রযোজ্য হবে না।

তাহলে, জুস কারখানা মালিক হাসেম কোন আইনে, কীভাবে দায়ী হবেন?

ফৌজদারি দায়-

১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় ‘নরহত্যা’র অভিযোগ আনা যায় যেটির শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অথবা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। এই ধারানুযায়ী, কোন কাজের ফলে কারো মৃত্যু সংঘটিত হতে পারে বলে যদি জানা থাকে (knowledge that is likely to cause death), তাহলে মৃত্যু সংঘটনের মনোবৃত্তি না থাকা সত্ত্বেও, সেই ব্যক্তিকে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে। ৩০৪ (ক) ধারায় বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত কাজের ফলে মৃত্যু ঘটানোর দায়েও অভিযুক্ত করা যাবে যেটির শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড, অথবা অর্থদণ্ড, বা উভয়দণ্ড।

দেওয়ানি দায় ও ক্ষতিপূরণ-

Scott v London & St Katherine Docks Co [1865,3 H&C 596] মামলার ঘটনাটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। এই মামলার বাদী বিবাদীর চিনির গোড়াউনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ ওপর থেকে একটি চিনির বস্তা বাদীর মাথায় এসে পড়ে এবং বাদী আহত হন। ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করলে, বিবাদী সেজান জুসের মালিক আবুল হাসেম এর মতোই যুক্তি দেয় এই বলে যে, বাদীর সাথে তাঁর কোন শত্রুতা ছিল না; সে তো যেয়ে বাদীর মাথায় চিনির বস্তা ফেলে নাই, চিনির বস্তা আপনা আপনি বাদীর মাথায় এসে পড়েছে বিধায় এতে তাঁর কোন দায় নাই। কিন্তু আদালত টর্ট আইনের বিখ্যাত ‘res ipsa loquitur (The fact speaks itself) নীতি অনুসরণ করে রায় দেন যে, আকাশ থেকে বৃষ্টি, কুয়াশা, তুষার পড়তে পারে কিন্তু চিনির বস্তা তো পড়তে পারে না। যেহেতু চিনির বস্তা পড়েছে, তাই সেই চিনির গোড়াউনের যিনি মালিক তিনিই এজন্য দায়ী।

বাংলাদেশ শ্রম আইনে দূর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ (compensation) বিস্ময়করভাবে কম- মাত্র ২ লাখ টাকা। [ ধারা-১৫১, পঞ্চম তফসিল, শ্রম আইন ২০০৬ দ্রষ্টব্য ]

অর্থাৎ, বাংলাদেশের আইনেই মাত্র ১ কোটি ৪ লাখ টাকা খরচ করে ৫২জন শ্রমিকের জীবন নেওয়ার দায় মেটাতে পারে এই আবুল হাসেম।জীবন কত সস্তা! এই অঙ্গার হওয়া প্রতিটি মানুষের সাথে জড়িয়ে ছিলো আরো কতো নির্ভরশীল মানুষ, হায়! বিগত ছয় বছরে শিল্পকারখানায় ৬০৮১ টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে যাতে শতশত শ্রমিক মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছে। কোনটির বিচার হয়নি।

১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ৯ ধারা অনুসারে কারো অবহেলাজনিত কাজের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হলে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি স্থানীয় দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে পারেন। টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ শ্রম আইনের মতো নির্দিষ্ট নয়। তাই কারখানায় অবহেলাজনিত জখম ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলার সুযোগ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

অন্ধকার টানেলের শেষপ্রান্তের আলো হিসেবে উচ্চ আদালতের কিছু বিচারিক সক্রিয়তার দেখা মেলে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ঘটনার মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণে গঠিত কমিটি ILO Convention ও pain and sufferings বিষয় বিবেচনা করেছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন মামলায় উচ্চ আদালত ‘Public Tort Compensation’ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যেখানে দূর্ঘটনা বা অবহেলার শিকার ব্যক্তির আয়, দুর্ভোগ, পরিবারের নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থা- সব বিবেচনায় নিয়ে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদেশ প্রদান করেছেন।

শেষ কথা-

হাসেম ফুডসের মালিক আবুল হাসেম তাঁর কারখানায় আইন মেনে চলছেন কিনা সেটি দেখভাল করার আইনি দায়িত্ব ছিলো অনেক সরকারি সংস্থার। ৫২ জন শ্রমিকের কয়লা হওয়া লাশ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এরা সবাই আইনগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। এদেরকেও আইনের আওতায় এনে বিচার করা জরুরি। আবুল হাসেম আশা করি বুঝতে পারবেন যে, আইনে দায়ী হওয়ার জন্য ‘যেয়ে আগুন লাগানো’র প্রয়োজন হয় না। এটি কোন দূর্ঘটনা নয়, এটি নরহত্যা। শ্রম আইন দিয়ে নয়, নরহত্যার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে দৃষ্টান্তমূলক সাজার ব্যবস্থা করতে হবে, একইসাথে টর্ট আইনে ক্ষতিপূরণ মামলাও দায়ের করতে হবে। বাংলাদেশের আইনজীবী ও বিচারকদের সক্রিয়তা এক্ষেত্রে ভীষণ প্রয়োজন। অন্যথায়, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এভাবে শ্রমিকের রক্তে তৈরি জুস সেবন করিয়ে এই পিশাচেরা বলতে থাকবে- ‘এটা একটা দূর্ঘটনা!”

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

s.ahsankhalid@yahoo.com