বাংলাদেশ শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন, ২০০১ একটি সাধারণ আলোচনা
শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট: ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের নাম বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। রাষ্ট্রের অন্যতম সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর এ কোর্টের যাত্রা শুরু হয়। তবে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের ইতিহাস অনেক পুরনো। এই কোর্ট কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট, পরবর্তীকালে কলকাতা হাইকোর্ট এবং সর্বশেষ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বা ঢাকা হাইকোর্টের কাছে বহুলাংশে ঋণী। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট প্রায় আড়াইশ বছরের বেশি ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করছে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বিচার বিভাগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়।

বিচার বিভাগের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণের প্রশাসনিক এলাকায় একতলা ভবনে রয়েছে সুপ্রীম কোর্ট জাদুঘর। এ জাদুঘরে দুশ বছরের অধিক আগে তালপাতায় লেখা পটুয়াখালীর তৎকালীন চৌকি আদালতের (বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে সিনিয়র সহকারী জজ আদালত ও সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট) দেয়া একটি রায়, ঐতিহাসিক ভাওয়ালা সন্ন্যাসী-সহ বিভিন্ন মামলার রায়, প্রধান বিচারপতিদের ছবি, বিচারপতিদের কোর্টে ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ কোর্টের নানা নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট জাদুঘরের নির্দশনাবলি এ যেন ব্রিটিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশের এক দীর্ঘ কালযাত্রার সাক্ষী। উক্ত জাদুঘরের সংরক্ষিত সবচেয়ে প্রাচীন একটি মামলার রায়ের ক্যাপসনে লিখা রয়েছে: “এটি ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় তালপাতার উপর লিখিত একটি বণ্টনের মোকদ্দমার রায়। উক্ত রায়টি বরিশাল জেলা জজ আদালতের মহাফেজখানা থেকে ৮.১.১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পটুয়াখালি জেলা জজ আদালতের মহাফেজ খানায় প্রেরণ করা হয়। এরপর রায়টি পটুয়াখালী জেলা জজ আদালতের মহাফেজখানায় সংরক্ষিত ছিল।”

ইতিহাস বলে, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আদিপর্বের ইতিহাসের সূচনা সর্বপ্রথম কলকাতায় হয়। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন পরিচালনার জন্য ১৭৭৩ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাস হওয়া রেগুলেটিং অ্যাক্ট, ১৭৭৩ (Regulating Act, 1773)-এর অধীনে ১৭৭৪ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে সুপ্রিমকোর্ট স্থাপন করা হয়। স্যার এলিজা ইম্পে (১৭৩২-১৮০৯) ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনিই ভারতীয় উপমহাদেশের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি (১৭৭৪)।

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এই প্রতিষ্ঠানের কলঙ্কের ইতিহাসও রয়েছে। সমকালে ইউরোপীয়গণ কর্তৃক কলকাতা সুপ্রিমকোর্টকে কখনও কখনও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে বহুল আলোচিত মহারাজা নন্দ কুমার (১৭০৫-১৭৭৫) আইনি হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের চার বছর পূর্বে একটি উইলে কথিত জালিয়াতির অভিযোগে সুপ্রিমকোর্ট নন্দনকুমারের বিচার করে এবং অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ১৭৭৫ সালের ৬ই মে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অথচ একই অভিযোগে ব্রিটিশ নাগরিকদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

কলকাতা সুপ্রিমকোর্ট অনেক বছর স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। এ কোর্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের শেষ সময় পর্যন্ত টিকেছিল। ১৮৫৮ সালে কোম্পানির শাসন বিলুপ্তি করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৮৫৮ সালে গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাস হলে ব্রিটিশ রাজ সরকার উপমহাদেশের শাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে। ফলে কলকাতা সুপ্রিমকোর্ট তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে।

পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আইনসভায় ১৮৬১ সালে ইন্ডিয়ান হাইকোর্ট অ্যাক্ট পাস হলে ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি প্রেসিডেন্সি শহরে [কলকাতা, মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই), বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই)] হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার বিধান করা হয়। উক্ত আইনের বিধানুযায়ী ১৮৬২ সালের ১লা জুলাই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বিদ্যমান সুপ্রিমকোর্ট প্রতিস্থাপন করে হাইকোর্ট স্থাপন করা হয়। সমকালে এ হাইকোর্টের নাম ছিল হাইকোর্ট অব জুডিকেচার অ্যাকট্ ফোর্ট উইলয়াম।

তবে কলকাতা হাইকোর্ট নামেই পরিচিতি লাভ করে। স্যার বার্নেস পিক্ক (১৮১০-১৮৯০) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি (১৮৬১)। ফলশ্রুতিতে কলকাতা সুপ্রিমকোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তি ঘটে।

দীর্ঘ কালপরিক্রমায় কলকাতা হাইকোর্টের সঙ্গে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জড়িত। অবিভক্ত ভারতের রাজধানী কলকাতার সঙ্গে অবিভক্ত বাংলার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। উল্লেখ্য, ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত কলকাতা শুধুমাত্র বাংলার নয়, সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। পরে প্রথম বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫)-সহ নানা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৩১ সালে পুরোপুরিভাবে দিল্লিতে রাজধানী আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ারাধীন ছিল অবিভক্ত বাংলা। কলকাতা হাইকোর্টের সঙ্গে বিশেষ করে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ড ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। পূর্ববাংলার মানুষের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য মামলার সাক্ষী কলকাতা হাইকোর্ট। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে কলকাতা হাইকোর্টের নানা কথা, নানা বিচার, নানা কাহিনি শুনে যায়। বিশিষ্ট লেখক শঙ্কর (জ. ১৯৩৩) কলকাতা হাইকোর্টের নানাকথা নিয়ে তাঁর রচিত ‘কত অজানারে’ শীর্ষক স্মৃতিকথায় বিধৃত করেছেন। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলাসহ নানা মামলা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। প্রখ্যাত আইনজীবী, বিজ্ঞ বিচারকদের কথাও শোনা যায়।

কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের ধারাবাহিকতায় কলকাতা হাইকোর্ট বিচার কাজে সুনাম ঐতিহ্য সমগ্র ভারত বর্ষের শিখরে স্পর্শ করেছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের পর নতুন করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের সৃষ্টি হলে প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ তৎকালীন পুরো রমনা এলাকা নতুন প্রদেশের রাজধানীর কেন্দ্রস্থল ছিল। ঢাকা পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী মর্যাদা পেলে ঢাকা রাজধানীরূপে ব্যাপক উন্নতি লাভ করে।

ফলে নতুন প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরের মর্যাদা বহুলাংশে বেড়ে যায়। নতুন প্রদেশের জন্য ঢাকা শহরে নানা ভবন ও স্থাপনা গড়ে ওঠে। যোসেফ ব্যাসফিল্ড ফুলার (১৮৫৪-১৯৩৫) নতুন প্রদেশের প্রথম গভর্নর হিসেবে (১৯০৫-১৯০৬) যোগ দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড তাঁরই স্মৃতিবহন করছে। রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকা শহর নতুনভাবে উদ্ভাসিত হতে শুরু হলো। প্রদেশের লে. গভর্নরের বাসভবন হিসেবে পুরাতন হাইকোর্টের বিল্ডিং (বর্তমানে একটি অংশ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল) তৈরি করা হয়। তবে পুরাতন হাইকোর্টের এই ভবনটি কখনও প্রদেশের গভর্নরের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।

মোট কথা, পুরনো হাইকোর্টের ভবনটি তৈরি হয়েছিল প্রথম বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) সময় যখন ঢাকা, পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ছিল তখন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে এ ভবনে কখনও ঢাকা কলেজ, পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের সভা (বর্তমানে সিনেট) সহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। মতিঝিলের দিলকুশায় ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়িটি নতুন প্রদেশের লে. গভর্নরের জন্য নির্ধারণ করা হয়।

বঙ্গভঙ্গের পর নতুন প্রদেশের সরকারের সচিবালয় ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের অফিস এবং বাসভবনের জন্য সমকালে সমগ্র রমনা এলাকায় আরও কিছু সুরম্য ভবন তৈরি করা হয়েছিল। তন্মধ্যে বিশেষ করে লর্ড কার্জনের (১৯৫৯-১৯২৫) নামে নির্মিত কার্জন হল এবং তৎসংলগ্ন বর্তমানে ফজলুল হক মুসলিম হল, ঢাকা হল (বর্তমানে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল), বর্ধমান হাউস (বাংলা একাডমি)-সহ রমনায় আরও কতিপয় স্থাপনা। যার স্মৃতিচিহ্ন এখনও বিদ্যমান রয়েছে।

নতুন প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরে রাজধানীর জন্য বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ বাংলা ভাগ রদ করেন। এরপর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলা অবিভক্ত থাকে। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা রাজধানী শহরের মর্যাদা হারিয়ে জেলা শহরে পরিণত হলো। এরই অনুবৃত্তিক্রমে সমকালে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ নানা কারণে ভিক্টরিয়া পার্ক (বর্তমানে বাহাদুর শাহ্ পার্ক) সংলগ্ন এলাকা থেকে ঢাকা কলেজ কার্জন হল এবং তৎসংলগ্ন ভবনগুলোতে স্থানান্তর করা হয় এবং ঢাকা কলেজের জন্য ভবনগুলো হস্তান্তর করা হলো। ঢাকা কলেজ দীর্ঘ সময় এ ভবনগুলো ব্যবহার করে। বঙ্গভঙ্গের সময় নির্মিত বর্তমান ফজলুল হক মুসলিম হলের সামনের কলেজ রোডটি এখনও ঢাকা কলেজের স্মৃতিবহন করে চলছে।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এভবনগুলোর মধ্যে দু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ করা হয়। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ঢাকা কলেজের জন্য হস্তান্তরিত ফজলুল হক মুসলিম হলের ভবনটিতে ব্রিটিশ ফৌজের জন্য জায়গা হলে সাময়িকভাবে ঢাকা কলেজে পুরাতন হাইকোর্ট বিল্ডিং-এ স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীকালে এ কলেজ লক্ষ্মীবাজার, তারপরে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন এবং সর্বশেষ ১৯৫৫ সালে নিউমার্কেট সংলগ্ন বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তর ঘটে।

ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের শেষপর্বে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ভারত শাসন আইন, ১৯৪৭ পাস হলে উক্ত আইন বলে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। ফলে ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয়। উল্লেখ্য, ১৯০৫ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গ হলেও তা ১৯১১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রদ করা হয়েছিল। ভারত শাসন আইন, ১৯৪৭-এর বিধানুযায়ী এ দুটি রাষ্ট্রের সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসনের বিধানানুযায়ী পরিচালিত হতে থাকে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রদেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনানুযী India Independence Act, 1947-এর অধিনে পাকিস্তান (প্রভিশনাল সংবিধান) আদেশ, ১৯৪৭ বলে আলাদা একটি হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। যা পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বা ঢাকা হাইকোর্ট নামে পরিচিতি লাভ করে। এই হাইকোর্ট তৎকালীন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের গভর্নরের জন্য নির্মিত বাসভবনে স্থাপিত হয়। উল্লেখ্য, এ ভবনটিতে গভর্নর কখনও বসবাস করেননি, ভবনটি কখনও ঢাকা কলেজ, কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ সরকারি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো। হাইকোর্ট স্থাপিত হলে পরবর্তীকালে এ ভবনটি হাইকোর্ট বিল্ডিং হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। যা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আমলে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন রূপে খ্যাত। বর্তমানে এ ভবনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে।

ভারত ভাগের পর পূর্ব বাংলার ভূখণ্ডে গভর্নর হাউসে স্থাপিত ঢাকা হাইকোর্টই হলো প্রথম হাইকোর্ট। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম ঢাকা হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সালেহ মুহাম্মদ আকরাম (১৮৮৮-১৯৬৮)। ঢাকা হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর কর্মকাল ছিল ১৯৫০ সাল পর্যন্ত। ঢাকা হাইকোর্টের প্রথম অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন এ এ ফায়েজ আলী (কর্মকাল ১৯৪৭-১৯৫০)। তারপর হন হামুদুর রহমান (১৯১০-১৯৭৫)। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বা ঢাকা হাইকোর্টের ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বেশ কজন প্রধান বিচারপতি উপমাহাদেশে খ্যাতি লাভ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিচারপতি আবু সালেহ মোহাম্মদ আকরাম, বিচারপতি আমিন আহমদ, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ, বিচারপতি বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী অন্যতম।

ঢাকা হাইকোর্ট অধিকন্তু কলকাতা হাইকোর্টের পূর্বাপর এখতিয়ারের ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলার প্রদেশের কলকাতা হাইকোর্টের যাবতীয় আদি ও আপিল ক্ষমতার এখতিয়ার লাভ করে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিধানুযায়ী ১৯৫০ সালে ফেডারেল কোর্ট (এনলার্জমেন্ট অব জুরিকডিকশন) অ্যাক্ট এবং প্রিভিকাউন্সিল (অ্যাবলিশন অব জুরিসডিকশন) অ্যাক্টের বিধান জারি করা হয়। উক্ত বিধানুযায়ী গঠিত পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে ঢাকা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ও শুনানীর বিধান করা হয়।

উল্লেখ্য, পাকিস্তান ফেডারেল কোর্ট ব্যবস্থা ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হলে বিলুপ্ত হয়ে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট গঠিত হয় এবং পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে ঢাকা হাইকোর্টের আপিল দায়ের ও শুনানীর বিধান করা হয়।

শুরুতে ঢাকা হাইকোর্ট নানামুখী প্রতিকূলতার মুখোমুখী হলেও পরবর্তীকালে ঢাকা হাইকোর্ট, পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের চেয়েও বেশি নাম করেছিল। ঢাকা হাইকোর্ট থেকে অনেক যুগান্তকারী রায় হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। জাকের আহমদ বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আবদুল হক বনাম ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রভৃতি উপমহাদেশ খ্যাত রায়। উল্লেখ্য, আবদুল হক বনাম ফজলুল কাদের চৌধুরী মামলার রায়ের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সব মন্ত্রীর সংসদ সদস্য পদ চলে গিয়েছিলে। ঢাকা হাইকোর্টের অনেক আইনজীবী সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, গভর্নর, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, স্পিকারসহ নানা পদে আসীন হয়েছেন। কলকাতা হাইকোর্টের যোগ্য উত্তরাধিকার ছিল ঢাকা হাইকোর্ট। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সৃষ্টির ও অভ্যুদয়ের ইতিহাসেও ঢাকা হাইকোর্টে ভূমিকা রয়েছে।

পাকিস্তান হাইকোর্ট বা ঢাকা হাইকোর্টের সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি ছিলেন বদরুদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী (১৯১৫-১৯৯১)। তিনি ১৯৭১ সালের ৯ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর সামরিক তদানীন্তন হিসেবে কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কাখানকে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এর ফলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রাম বেগবান হয়েছিল। বিচারবিভাগের জন্যেও এ ঘটনা গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে। এবং বাংলাদেশ সংবিধানগতভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। এরই অনুবৃত্তিক্রমে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎ করণ আদেশ জারি করা হয়। ঐ আদেশ বলে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান প্রচলিত আইন-আদালত কার্যকর রাখা হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীনতার মহান স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এলেন এবং তিনি দ্রুততম সময়ে একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারি ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২ জারি করা হয়। এ অস্থায়ী সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদের বিধানানুযায়ী ১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশ হাইকোর্ট অর্ডার জারি করা (১৯৭২ সালের পি.ও. নং ৫) হলো। উক্ত হাইকোর্ট আদেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম বাংলাদেশ হাইকোর্ট গঠিত হয়। এই হাইকোর্টই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম হাইকোর্ট। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকা হাইকোর্টকে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বিলুপ্ত করে ঢাকা হাইকোর্টে বিচারাধীন সকল মামলা বাংলাদেশ হাইকোর্টে বিচার করার ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং ঢাকা হাইকোর্টের সকল কর্মচারীকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা হয়। ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে (১৯১৬-১৯৯৭৮) বাংলাদেশের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রথম অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন এম এইচ খোন্দকার (১৯০৪-১৯৯৩)।

প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েম ও সাবেক ঢাকা হাইকোর্টের কয়েকজন বিচারপতিসহ আরও কয়েকজন নব বিচারপতি নিযুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম হাইকোর্টের অভিযাত্রা হয়। রাষ্ট্রপতি ১১৪ নং আদেশে অর্থাৎ দি হাইকোর্ট সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট অব বাংলাদেশ আদেশে রাষ্ট্রপতির ৫নং আদেশের কার্যকরতা ১১.০১.১৯৭২ থেকে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ হাইকোর্ট উক্ত তারিখ থেকে যাত্রা করে।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ বিদ্দিকী, অন্যান্য কয়েক জন বিচারপতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বাংলাদেশ হাইকোর্টে বাদ পড়েছিলেন। অতঃপর সাবেক পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টে বাংলাদেশের বিচারাধীন মামলাগুলো বিচার করার জন্য বাংলাদেশ হাইকোর্টের আপিল বিভাগের অভিযাত্রা শুরু করে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির ৯১নং আদেশে পূর্বোক্ত রাষ্ট্রপতির ৫নং আদেশটি সংশোধনক্রমে সাবেক পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টে বাংলাদেশের বিচারাধীন মামলাসমূহ বিচার করার জন্য বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েম ও অন্য দুজন বিচারপতি নিয়ে বাংলাদেশ হাইকোর্টের আপিল বিভাগ যাত্রা করে।

সাবেক পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের বাংলাদেশের বিচারাধীন মামলাগুলো বাংলাদেশ হাইকোর্টের আপিল বিভাগের স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশের প্রথম হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে এএসএম সায়েম-এর কর্মকাল ১২.০১.১৯৭২ থেকে ১৫.১২.১৯৭২ পর্যন্ত এবং বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রথম অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন এম এস খোন্দকার। তার কর্মকাল ২১.০১.১৯৭২ থেকে ১৭.১২.১৯৭২ পর্যন্ত দেখানো হয়। উল্লেখ্য অ্যাটর্নি জেনারেল পদবি সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সৃষ্টির পরে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামনের নেতৃত্বে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হলে এবং ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।

অতঃপর ১৯৭২ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনে ৯৪ অনুচ্ছেদের আলোকে আপীল বিভাগ ও হাইকোট বিভাগ নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোট প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫১ অনুচ্ছেদের শর্তাংশে বর্ণিত বিধানুযায়ী সাবেক বাংলাদেশ হাইকোর্ট গঠনের আদেশসহ এসংক্রান্ত কয়েকটি পি.ও. আদেশ রদ করা হয়। এ রদ করার পাশাপাশি বলবৎকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদের দ্বারা প্রচলিত আইন বহাল রাখার বিধান করা হয়। প্রাক্তন বাংলাদেশ হাইকোর্ট গঠন সংক্রান্ত কয়েকটি পি.ও. আদেশ রদ করার কারণ হলো রদকৃত আদেশগুলোর বিষয়ে বলবৎকৃত সংবিধানে বিধান রাখা হয়েছে।

বলবৎকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দুটি বিভাগ : (ক) আপিল বিভাগ ও (খ) হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে গঠন করা হয় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে কার্যকরতা দেখানো হলো। ১৯৭২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে এসে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য, সেদিন সরকারি ছুটির দিনকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কর্মদিবস হিসেবে আদেশ জারি করেছিলেন এবং বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট ঐ দিন কার্যক্রম শুরুর দিনটিকে অর্থাৎ ১৮ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে সাবেক বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে নিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর কর্মকাল ছিল ১৬.১২.১৯৭২ থেকে ০৫.১২.১৯৭৫ পর্যন্ত। এ সময় বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট ফকির শাহাবুদ্দীন আহমদ (১৯২৪-১৯৮৯)। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তাঁর কর্মকাল ছিল ১৮.১২.১৯৭২ থেকে ২১.০৩.১৯৭৬ পর্যন্ত। উল্লেখ্য, যখন বাংলাদেশ হাইকোর্ট ছিল তখন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার পদবি ছিল অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং যখন বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট হলো তখন রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তার পদবি হলো অ্যাটর্নি জেনারেল।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট গঠিত হয়নি। শুরুতে বাংলাদেশ হাইকোর্টই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। অতঃপর বাংলাদেশ হাইকোর্টের অংশ হিসেবে হাইকোর্টের আপিল বিভাগ গঠন করা হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হলে সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট গঠন করা হয় দুটি বিভাগ নিয়ে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ। বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগ হচ্ছে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টেরই একটি বিভাগ। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নে বাংলাদেশ হাইকোর্ট ছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনকর্মকর্তার পদ ছিল অ্যাডভোকটে জেনারেল।

সুতরাং ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট ব্রিটিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশ পর্বের ইতিহাসের এক বিরাট অংশ। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের ইতিহাস মানে ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস। বর্তমান বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট পুরনো কলকাতা সুপ্রীমকোর্ট, পরে কলকাতা হাইকোর্ট, অতঃপর ঢাকা হাইকোর্টের গর্বিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। এই ঐতিহ্য এখনও বহমান। এ কোর্টের ঐতিহ্য গর্ব করার মতো। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিগণ সুপ্রীম কোর্টের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক পতাকাবাহী গাড়ি ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশ পর্বেও এদেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের বিজ্ঞ বিচারপতি, বিদগ্ধ আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন, এখনও আছেন। তাঁদের মধ্যে থেকে অনেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ নানাপদে আসীন হয়েছেন এবং অনেকে নানা পদকে ভূষিত হয়েছেন। প্রতিটি আন্দোলনে সুপ্রীমকোর্টের ভূমিকা গৌরবজনক। এ কোর্টের বিজ্ঞ বিচারপতি, বিজ্ঞ আইনজীবীদের শিক্ষা, আইনজ্ঞান, নিরপেক্ষতা পূর্বসূরিদের মতোই রক্ষা করে চলছেন।

বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট কোর্ট থেকে বিভিন্ন সময়ে অনেক ল্যান্ডমার্ক রায় হয়েছে। ড. মহিউদ্দীন ফারুক বনাম এবং বাংলাদেশ, কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধপরাধী মামলা, মাজদার হোসেন মামলা, কাজী মোকলেসুর রহমান মামলা, সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী মামলা, প্রভৃতি মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট যুগান্তকারী, সময়োপযোগী ও ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। এগুলোর রায় ঢাকা ল রিপোর্টস, বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশন, বাংলাদেশ কেস রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে আইনানুগ ভূমিকা রাখায় বিশ্বে বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুজ্জ্বল হয়েছে। আইনের শাসন, আইনের ব্যাখ্যা, আইন সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জনসহ সর্বোপুরি মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজও কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

লেখক: গবেষক