অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম
অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম

‘মানসম্মত নাগরিক সেবা পেলে দেশের জনগণ কর প্রদানে উৎসাহিত হবে’

তৌফিকা করিম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। আইন পেশায় প্রায় তিন দশকের ক্যারিয়ার তাঁর। সেই সাথে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। একজন আইনজীবী হিসেবে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে অসহায় কারাবন্দীদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংস্থা ‘লিগ্যাল এসিসটেন্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পার্সনস (এলএএইচপি)। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ সভায় প্রস্তাবিত এবং অনুমোদিত নতুন ব্যাংক ‘সিটিজেন ব্যাংক’–এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আইনজীবী ক্যাটাগরিতে একাধিকবার দেশের সর্বোচ্চ করতাদাও হয়েছেন তিনি।

দেশের আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর মূল্যবান মতামত জানতে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম-এর সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচির নেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনার নানা এবং বাবা উভয়েই আইনজীবী ছিলেন, আইন পেশায় আসার ক্ষেত্রে উনারা অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছেন কি-না?

তৌফিকা করিম: অনেক ছোট ছিলাম বলে আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নানার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়নি। আমি বলব বাবা আইনজীবী হিসেবে বিখ্যাতই ছিলেন। উনার কাছ থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত যে হয়নি তা নয়। বাবারও ইচ্ছা ছিল যেন আমি আইন পড়ি এবং এ পেশায় যুক্ত হই। তবে আইন পেশায় নিয়োজিত হবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপাটি কাজ করেছে তা হল কর্মের স্বাধীনতা। ছোটবেলা থেকে স্বাধীনভাবে কিছু করার মানসিক তাড়না থেকেই মূলত আইন পেশায় আসা।  

ল’ইয়ার্স ক্লাব: প্রায় তিন দশক আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দেশের আইনের শাসনের বাস্তবতা বিষয় দুটিকে একজন আইনজীবী হিসেবে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

তৌফিকা করিম: বিশ্বের কোথাও বিচার বিভাগের শতভাগ স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। দেশের প্রেক্ষাপটেও কিছু ত্রুতি-বিচ্যুতি নিশ্চিতভাবেই আছে। তবে একজন আইনজীবী হিসেবে বলতে পারি দেশের উচ্চ আদালত যথেষ্ট স্বাধীনভাবেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে। অধস্তন আদালতে ছোট-খাট সমস্যা হয়তো আছে। কিন্তু মোটা দাগে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবেই কাজ করছে বলে বিশ্বাস করি। আইনের শাসনের ক্ষেত্রেও উন্নতির পথেই আছি। যেমন নুসরাত হত্যা মামলা, আবরার হত্যা মামলাসহ চাঞ্চল্যকর বেশকিছু মামলার বিচার তড়িৎ গতিতেই হয়েছে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং জাতীয় চার নেতা হতা মামলার সহকারী কৌঁসুলি নিয়োজিত ছিলেন, এমন চাঞ্চল্যকর মামলা পরিচালনা করা কতটুকু চাপের ছিল? যেহেতু এই মহান ব্যক্তিত্বদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসই কল্পনা করা অসাধ্য।

তৌফিকা করিম: চ্যালেঞ্জ কিংবা চাপ মোটেই ছিলনা। তবে অসাধারণ অনুভূতি ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার যেখানে থমকে ছিল বহু বছর। আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। এমনকি আমার সিনিয়র সিরাজুল হক স্যারও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন কোর্টে মামলাটি শুনানির জন্য মেনশন করলেও আদালত শুনানির ক্ষেত্রে বিব্রতবোধ করছিলেন। এরপর বিচার যখন শুরু হল স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর ছিল। প্রত্যাশা ছিল বিচার প্রক্রিয়া বিনাবাধায় যেন শেষ হয়। সহকারী কৌঁসুলি হিসেবে এ মামলায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সাধ্যমতো সিনিয়রদের সহযোগিতা করা। মামলার খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ তদারকির পাশাপাশি পড়াশোনা করেছি, যেন কোন তথ্য কিংবা উপাত্ত দিয়ে এ মামলায় যেকোন ভাবে  অবদান রাখা যায়।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি তো মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবেও নিয়োজিত আছেন, মানবাধিকার বিষয়ে বাংলাদেশকে কত নম্বর দিবেন, উন্নয়নের জায়গা আছে কি? সে বিষয়ে আপনার পরামর্শ কি?

তৌফিকা করিম: মানুষ জন্মগতভাবেই কিছু অধিকার নিয়ে জন্মায়। সহজ কথায় এসবই মানবাধিকার। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষই অধিকার সচেতন নন। অনেকে বুঝতেও পারেন না, তাঁর আসলে কী কী অধিকার রয়েছে। আর এ কারণেই কিছু একটা সমস্যা হলেই সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে দেন। নানা অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে। অধিকার আদায়ে মূলত নিজেদেরকেই সবচেয়ে বেশি সজাগ থাকতে হবে এবং তা আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। সরকার অবশ্যই জনগণের অধিকার বিষয়ে দেখভাল করবেন কিন্তু অধিকার আদায়ে নাগরিক হিসেবে আমাদেরও সচেতনতা জরুরি।

নাগরিকের অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে মানবাধিকার কমিশন চেষ্টা করে। কমিশনের এ বিষয়ে আইন রয়েছে, সেই আইনের আলোকে কমিশন কাজ করছে। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে মানবাধিকার কমিশন আইনের দু-একটা জায়গায় কিছু বাধা আছে, ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় কাজ করতে অসুবিধা হয়। তবে কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম এসব কিছুর মধ্যে থেকেও নাগরিকের মানবাধিকার সুরক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: বিনা বিচারে আটক অসহায় কারাবন্দীদের বিনামূল্যে আইন সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন, এই বিষয়টি ঠিক কবে উপলব্ধি করেছেন, এবং এই মহতি উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু বলুন।

তৌফিকা করিম: আইন পেশায় চার-পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মাঝেমধ্যে কিছু মক্কেল এসে খুব দুঃখ করে বলতেন যে খুব ছোটখাটো অপরাধে বছরের পর বছর বিনা বিচারে কারাবন্দী হয়ে আছে অমুক কিংবা তমুক। কোন তদবিরকার নেই। শুধুমাত্র তবিরকারের অভাবে কেউ কেউ আট বছর ধরেও অভাবে জেলে বন্দী! তখন আমার মনে হল এই অসহায় বন্দীদের মুক্তির জন্য একটা অর্গানাইজেশন করা দরকার। এরপর লিগ্যাল এসিসটেন্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স এন্ড পার্সনস (এলএএইচপি) নামের সংস্থা করি। এরমাধ্যমে বিনা বিচারে আটকদের খুঁজে খুঁজে জেল থেকে বের করে আনা হল। এক্ষেত্রে বন্দীদের কোন খরচও দিতে হয়নি। বিনামূল্যে আইন সহায়তা দেওয়া হল। প্রায় এক হাজারের মতো অসহায় কারাবন্দীদের আমরা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: অসহায়দের শুধু আইনি সহায়তা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, বরং তাদের কাউন্সিলিং ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন, এই অতিরিক্ত দায়িত্ব নেয়ার কারণ কি?

তৌফিকা করিম: কেউ কেউ এতোটা অসহায় যে জেল থেকে বের হওয়ার পর বাড়ি যাওয়ার ভাড়ার টাকাও তার কাছে নেই। সেক্ষেত্রে তাদের এ অর্থ দেওয়া হয়। পাশাপাশি আলোচনা করে যদি জানাওতে পারি তাদের কাজ করার মতো অবস্থা নেই তখন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া অনেক আসামি জেল থেকে বের হয়ে আবার অপরাধে লিপ্ত হয়। তো এদেরকে কাউন্সিলিং করা সংস্থার পক্ষ থেকে। সেই সাথে পরবর্তীতে যেন অপরাধে লিপ্ত না হয় এজন্য তাদেরকেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। ধরুন দোকান করে দেওয়া বা একটা রিকশা কিনে দেওয়া যখন যার ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করেছি। যাতে করে আবার অপরাধে জড়িত না হয়। রোজগারের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে পুনরায় কোন অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা থাকে না। মূলত এমন ভাবনা থেকেই এজন্যই এ উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে খুব যে সফলকাম হয়েছি তা বলব না, তবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কেননা কারামুক্ত সকলকেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়নি। যারা কেবল যোগাযোগ করেছে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তাদের জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক কারাবন্দী তো জামিন পেয়ে দেখা না করেও চলে গেছে, আর হদিস পাওয়া যায়নি। 

ল’ইয়ার্স ক্লাব: লিগ্যাল এসিসটেন্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স এন্ড পার্সনস (এলএএইচপি) দেশ সেরা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছে, এই সংস্থা নিয়ে আপনার প্রত্যাশার জায়গা নিয়ে কিছু বলুন।

তৌফিকা করিম: যেকোন কাজে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত নিঃসন্দেহে দ্বিগুণ উৎসাহ দেয়। সরকারের এই পুরষ্কার আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছে এ কথা অনস্বীকার্য। দেশের অসংখ্য এনজিও থাকলেও ঠিক এই ব্যাপারটিকে কেউ কাজ করে না। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা অর্থাৎ সরকারী লিগ্যাল এইড কাজ করে। প্রকারান্তরে সরকারের কাজটিই আমাদের সংস্থা করছিল। এ কাজে সরকারী স্বীকৃত আরও বেশি কাজ করার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করবে অবশ্যই।

প্রথম দিকে শুধু কারাবন্দীদের নিয়ে কাজ শুরু করলেও পরবর্তীতে সংস্থার কাজে হেল্পলেস পার্সনস বা অসহায় মানুষ শব্দ যুক্ত করে অসহায়দের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। করোনা পরিস্থিতিতে বস্তি বস্তি ঘুরে সংস্থার পক্ষ থেকে অসহায় মানুষের মধ্যে খাবার ও ওষুধ বিতরণ করেছি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আইন পেশার বাহিরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের সঙ্গে আপনি যুক্ত আছেন, বিশেষত নবগঠিত সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন, আইন পাশায় থেকে এই দায়িত্ব কতটা উপভোগ করেন, একইসাথে দেশের সামাজিক বাস্তবতায় একজন নারী হিসেবে এতোসব করতে গিয়ে কোন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি?

তৌফিকা করিম: যেকোন দায়ত্ব পালন করা উপভোগ করি। বহুমাত্রিক কাজ করতে ভালো লাগে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যদিও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন আমি ব্যাংকের কী বুঝি। জিজ্ঞাসা এসেছে আইন পেশায় নিযুক্ত হওয়ায় ব্যাংকের বিষয়ে তো জ্ঞান থাকার কথা নয় মূলত সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি জানার আগ্রহ থাকলে যেকোন সেক্টরে ভালো কাজ করা সম্ভব। আইন পেশায় আসার আগেও তো আমি এ পেশাগত বিষয়ে অবগত ছিলাম না। পেশায় যুক্ত হওয়ার পড়েই কিন্তু আস্তে আস্তে সবকিছু শিখতে পেরেছি। কাজেই সে সেক্টরেই যুক্ত হইনা কেন জানার প্রবল ইচ্ছা বা আগ্রহ সফলতার দিকেই নিজে যাবে বলে বিশ্বাস করি।

দেশের বাস্তবতায় নারীদের জন্য পদে পদে বাধা রয়েছে, এ কথা সত্য। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, নারীরা ঘরে থাকবে, রান্না করবে, স্বামীর সেবা করবে, সন্তান লালনপালন করবে। যখনই কোন নারী এই বলয়ের বাহিরে গিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে তখনই তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানোর সংস্কৃতি দেশে বিদ্যামান। এক্ষেত্রে প্রথম ধাক্কাটা দেওয়া হয় নারীর চরিত্র হননের মাধ্যমে। মনে করা হয়ে থাকে ঘরের বাহিরে গেলে, পুরুষ সহকর্মীর সাথে কাজ করলে ওই নারীর চারিত্রিক সমস্যা রয়েছে! আর এমন মিথ্যা অভিযোগে ভয় পেয়ে বেশিরভাগ নারীই প্রথম ধাক্কায় চুপসে যায়। স্বপ্ন আর ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দেয়। আমিও নানান বাধার সম্মুখীন হয়েছি। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে- নিজে সৎ থাকলে, প্রিয় মানুষগুলো আস্থা রাখলে, তৃতীয়পক্ষের এসব বাধা প্রতিহত করে এগিয়ে যেতে হবে। নারীদের অগ্রযাত্রায় এসব অভিযোগ নিছক বাধা ব্যতীত কিছু নয়। এজন্য তৃতীয় কোন পক্ষ এসব বললেই থেমে যেতে হবে কেন?

ল’ইয়ার্স ক্লাব: গত ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলায় নারীর ক্ষমতায়ন কিভাবে মূল্যায়ন করবেন, সেই সঙ্গে ৫০ বছর পর এই বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা নিয়ে কিছু বলুন।

তৌফিকা করিম: প্রায় তিন দশক দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারী ক্ষমতায়ন বিদ্যমান। সে হিসেবে নারী ক্ষমতায়ন সফলতার তুঙ্গে। কিন্তু সত্যিকারের নারী ক্ষমতায়ন অর্থাৎ সার্বজনীনভাবে নারী ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের সংবিধান ও বৈশ্বিক সকল নিয়ামকের ভিত্তিতে মানুষ হিসেবে পুরুষ-নারী সমান সমান। কিন্তু দেশের নারীরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিকভাবে যে মর্যাদা প্রাপ্তির কথা ছিল, সেটা পাচ্ছে না। সংরক্ষিত আসন ব্যতীত সাধারণ নির্বাচনে কতজন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়? সর্বক্ষেত্রে কর্মের স্বাধীনতা না থাকায় অর্থনৈতিক মুক্তিও এখনো আসেনি। আর সামাজিকভাবে নারীকে ছোট করে দেখার বহু পুরনো মানসিকতা তো এখনো বর্তমান। এজন্য সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে দেশে নারী ক্ষমতায়ন যতটুকু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। এদিকে রাষ্ট্রের নজর দেওয়া উচিত। নারীদের পেছনে ফেলে সর্বাঙ্গীন উন্নতি সম্ভব নয়।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আইনজীবী হিসেবে নারীদের তালিকাভুক্ত হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও, আদালত অঙ্গনে (প্র্যাকটিসে) নারীদের উপস্থিতি সে তুলনায় কম কেন?

তৌফিকা করিম: আমার ধারণা নারীদের জন্য আইন পেশায় টিকে থাকা কঠিন। অনেক বছর প্র্যাকটিসে থেকেও বেশিরভাগ নারী আইনজীবী স্বাধীনভাবে অর্থাৎ নিজস্ব চেম্বার নিয়ে প্র্যাকটিসের সাহস করতে চান না। এছাড়া নানা প্রতিকুলতার সাথে এলবোইং (ধাক্কাধাক্কি) করে এগিয়ে যাওয়াও সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। আবার অনেকেই আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সরকারী আইনজীবী (সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল) হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যান। মূলত এ প্রবণতা নিশ্চয়তা (ন্যূনতম নির্ধারিত আয়) চাওয়া থেকে হয়। পাশাপাশি অনেক সিনিয়র এখন আর আগের মতো বেশি জুনিয়র রাখতে চান না। ভালো সিনিয়র না পাওয়াও নারীদের পক্ষে আইন পেশায় টিকে থাকার ব্যাপারে অন্যতম অন্তরায় বলে মনে করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আদালত অঙ্গনে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে আপনার পরামর্শ কী?

তৌফিকা করিম: দেশে আদালতসহ যেকোন কর্মক্ষেত্রে সবার ধারণা নারীরা কম বুঝে। বিষয়টি দারুণ পীড়াদায়ক। পুরুষেরা সর্বক্ষেত্রে পাণ্ডিত্য জাহির করার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের চেয়ে সফল এবং কার্যকর। এজন্য বলব, আইনাঙ্গনে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টি শুধুমাত্র নারীদের ওপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে পুরুষদের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: এবার একটা ভিন্ন প্রসঙ্গে জানতে চাই, আমাদের দেশে আয়কর বিষয়ে বেশিরভাগ নাগরিক উদাসীন, আপনি একাধিকবার আইনজীবী ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ করতাদা হয়েছে। এটা কি দায়িত্ববোধ থেকে নাকি প্রয়োজনের তাগিদে?

তৌফিকা করিম: অবশ্যই দায়িত্ববোধ থেকে কর পরিশোধ করি। কর পরিশোধের সময় আয়ের একটা পয়সাও লুকাই না। যা-ই কর আসে, পুরোটা পাই টু পাই হিসেব করে পরিশোধ করি। দেশের মানুষ কর দিতে উদাসীন, এ কথার সাথে আমি একমত নই। আমরা কর দিতে প্রস্তুত কিন্তু কর প্রদানের মাধ্যমে সে সকল নাগরিক সুবিধা ভোগ করার কথা তা কি নিশ্চিত করা গেছে? এজন্যই কর প্রদানে অনেকেই আগ্রহ হারান। আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও এ কথা বলেছি। বিদেশে কর বৃদ্ধি করা হলে নাগরিকরা বরং খুশি হন। কারণ তাঁরা জানেন কর বৃদ্ধি মানে সেবা বৃদ্ধি। নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারে বলে কর প্রদানে বিদেশে কেউ অনীহা দেখান না।

দেশের নাগরিক সেবার বিষয়ে ছোট একটা উদাহরণ হচ্ছে- নিয়মিত কর পরিশোধের পরেও মিউনিসিপ্যালিটি থেকে রাস্তা পরিষ্কার যথাযথভাবে করা হয়না। বাড়ি সামনে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা সম্পর্কে অবহিত করার পরও কর্তৃপক্ষ থেকে দ্রুত সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ লক্ষ্য করা যায়না। মশার উপদ্রপের কথা যদি বলি, প্রতি বছর ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। বিষয়টি সম্পর্কে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাহেবরাও অবগত। এক্ষেত্রে অন্তত চার মাস আগে থেকে মশানিধন কর্মসূচি গ্রহণ করা সমীচীন হলেও ডেঙ্গুজ্বরে শতশত মানুষ আক্রান্ত বা কিছু মৃত্যুর খবর বেরোলে তবেই উনারা রাস্তায় নামেন! এসব থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। ঠিক সময় সঠিক দায়িত্বপালন করা উচিত। দায়িত্বশীলদের জনগণের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি দেশের জনগণ কর প্রদান করতে ইচ্ছুক, যদি যথোপযুক্ত নাগরিক সেবা প্রদান করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করতে পারলে আরও বেশি বেশি মানুষ কর প্রদানে উৎসাহিত হবে বলে মনে করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।