অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সেলিম মিয়া
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সেলিম মিয়া

কোম্পানীর বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলা, ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা

মোহাম্মদ সেলিম মিয়া: কোম্পানীর নামীয় চেক দিয়ে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সম্প্রতি ঢাকার সিএমএম কোর্টের বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট কোম্পানীসহ ১২ জন ডিরেক্টরকে আসামী হিসাবে উল্লেখ করাতে আমাদের মামলা নিচ্ছিলেন না। এমন কি আমার জুনিয়রকে বলে দিয়েছে এ ব্যাপারে রেফারেন্স দিতে এবং আমাদের মামলা আদেশের জন্য রেখে দিয়েছিল।

পরবর্তীতে ধার্য তারিখে আমি শুনানি করি। আইনের রেফারেন্স দিয়ে কোর্টকে সন্তুষ্ট করাই একজন আইনজীবীর দায়িত্ব। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট, আইনজীবী ও আইন আশ্রয়প্রার্থীদের জ্ঞাতার্থে এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরা হলো-

[ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র, ৭ সিএলআর (২০১৯) ২৪১] মামলায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রতি নির্দেশনা-

(১) নিম্ন লিখিত শর্তাদি পূরণ না হলে নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার সাথে পঠিত ১৪০ ধারার অধীনে কোনো নালিশ-দরখাস্ত গ্রহণ করা যাবে না। যথা-

ক) নালিশের দরখাস্তে কোম্পানীকে ১ নং আসামি করতে হবে।

খ) নালিশের দরখাস্তে চেক সইকারীকে ২ নং আসামি করতে হবে।

গ) কোনো পরিচালককে আসামি করা হলে তার পদবিসহ কোম্পানীতে তার দায়-দায়িত্বের প্রকৃতি বর্ণনা থাকতে হবে।

ঘ) কোম্পানীর ব্যবসা পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত-পরিচালকগণ দায়িত্বে ছিলেন মর্মে নালিশের দরখাস্তে উল্লেখ থাকতে হবে।

ঙ) নালিশের দরখাস্তের সাথে অভিযুক্ত-কোম্পানীর আর্টিকেলস ও মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন এবং ফর্ম-১২ এর কপি সংযুক্ত থাকতে হবে, যাতে করে প্রত্যাখ্যাত চেক দেওয়ার সময় অভিযুক্ত-পরিচালকরা কোম্পানীর দায়িত্বে ছিলেন মর্মে ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে পারেন।

চ) ১৩৮(১) ধারার অধীনে প্রদত্ত নোটিশ ১৩৮(১এ) ধারার বর্ণিত তিন পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে মর্মে দেখাতে নালিশের দরখাস্তের সাথে প্রমাণ যুক্ত করতে হবে।

ছ) চেকে উল্লেখিত টাকা দাবি করে দেওয়া ডিমান্ড নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশের প্রেক্ষিতে কোনো উত্তর থাকলে তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।

জ) যদি অভিযোগকারী দাবি করেন যে ডিমান্ড নোটিশ বা লিগ্যাল নোটিশের প্রেক্ষিতে তিনি কোনো উত্তর পাননি, তাহলে নালিশের দরখাস্তে এটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে।

(২) অভিযোগকারীকে উপর্যুক্ত তথ্যাদি বর্ণনা করে এবং কাগজপত্র সংযুক্ত করে নতুন নালিশ-দরখাস্ত নিয়ে আসার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট বলতে দ্বিধা করবেন না।

(৩) অপরাধ বিচারার্থে আমলে নেওয়ার আগে অভিযুক্ত-পরিচালকের দায়-দায়িত্বের ধরন জানার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক অনুসন্ধান করতে পারেন।

(৪) আলেয়া বনাম রাষ্ট্র, ৭০ ডিএলআর (২০১৮) ৩০৩ মামলায় প্রদত্ত নির্দেশনার পাশাপাশি উপর্যুক্ত নির্দেশনা ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুসরণ করতে হবে।

পাশাপাশি [পারভেজ ভুঁইয়া (মোঃ) এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র এবং অন্যান্য, ৭২ ডিএলআর (২০২০) ১৩৪] মামলার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের নিম্নরূপ নির্দেশনাও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

কোম্পানীর পরিচালক বলেই তিনি সবক্ষেত্রে দায়বদ্ধ হয়ে যাবেন- এমন নয়।

কেবল কোম্পানীর পরিচালক বলেই তাকে নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্টের ১৪০ ধারার অধীনে দায়বদ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। একজন পরিচালককে ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোম্পানির দায়িত্বে ও দায়বদ্ধ বলে মনে করা যায় না। ১৪০ ধারার শর্ত হলো- কাউকে দায়বদ্ধ করতে চাইলে ওই ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বে ও দায়বদ্ধতায় থাকতে হবে। উল্লেখিত মামলার ক্ষেত্রে পরিচালকের কোনো দায়বদ্ধতা ছিলনা। এমন কি নালিশি দরখাস্তে উক্ত পরিচালক ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোম্পানীর দায়িত্বে ও দায়বদ্ধ ছিল বলে উল্লেখ করা হয় নি । যে পরিচালক দায়িত্বে ছিলেন না এবং সংশ্লিষ্ট সময়ে কোম্পানীর ব্যবসা পরিচালনার জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন না, তিনি এই বিধানের অধীনে দায়বদ্ধ হবেন না। তবে নালিশি দরখাস্তে একজন পরিচালক ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোম্পানীর দায়িত্বে ও দায়বদ্ধ ছিল বলে উল্লেখ থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট মামলা নিতে কোন দ্বিধা করবেন না ।

[আলেয়া বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য, ৭০ ডিএলআর (২০১৮) ৩০৩] মামলায় এন আই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার অধীনে অপরাধ বিচারার্থে আমলে নেওয়ার বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য নির্দেশিকা-

১. ম্যাজিস্ট্রেট নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার অধীনে কোনো নালিশের আবেদন গ্রহণ করবেন না যতক্ষন না সেটিতে নিম্নলিখিত বিবৃতি থাকেঃ

ক) তর্কিত চেক দেওয়ার তারিখ

খ) যেই তারিখে উক্ত চেক শেষবার প্রত্যাখ্যান হয়েছিল, অর্থাৎ প্রত্যাখ্যানের সর্বশেষ তারিখ

গ) চেক প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে চেক গ্রহীতা কর্তৃক ব্যাংক হতে তথ্য প্রাপ্তির তারিখ

ঘ) চেক গ্রহীতা কর্তৃক চেক দাতার কাছে লিখিত ডিমান্ড নোটিশ প্রদান (ব্যক্তিগতভাবে/রেজিস্ট্রিকৃত ডাকযোগে/বাংলা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে)

ঙ) চেক প্রদানকারী কর্তৃক ডিমান্ড নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ।

২. নালিশ আবেদন পর্যালোচনা করে যদি ম্যাজিস্ট্রেট দেখেন যে উপর্যুক্ত বিবৃতি গুলোর কোনো একটি বিবৃতি অনুপস্থিত আছে, তবে তিনি সিআরপিসির ২০০ ধারা অনুযায়ী নালিশকারীকে পরীক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানাবেন ।

৩. যখন ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্ট হবেন যে এন আই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার অনুশর্তের (এ) থেকে (সি) অনুচ্ছেদের বিধান অনুসারে উপরোক্ত পদক্ষেপ গুলো নিখুঁতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, তখন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট পরীক্ষা করে দেখবেন যে লিখিত ডিমান্ড নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে চেক গ্রহীতা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন কিনা।

৪. যদি ম্যাজিস্ট্রেট দেখেন যে আইনের উপরোক্ত বিধান গুলো অনুসরণ করার পরেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে, তবেই তিনি অপরাধ বিচারার্থে আমলে নেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

৫. ম্যাজিস্ট্রেটগণ মনে রাখবেন, যদি এই পর্যায়ে মূল চেক উপস্থাপনের পাশাপাশি নালিশকারী উপরোক্ত পদক্ষেপের বিষয়ে কেবল বিবৃতি দেয় তবে মামলা শুরু করার জন্য নালিশকারীর যথেষ্ট ভিত্তি রয়েছে, কারণ বিচারের সময় মৌখিক/দালিলিক প্রমাণাদি দিয়ে তার উপরের বক্তব্য প্রমাণ করা নালিশকারীর দায়িত্ব।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।