নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মিথ্যা মামলা-অভিযোগ দায়ের দন্ডনীয় অপরাধ
অ্যাডভোকেট শাহ্ নাভিলা কাশফি

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মিথ্যা মামলা-অভিযোগ দায়ের দন্ডনীয় অপরাধ

শাহ্ নাভিলা কাশফি : আমাদের সমাজে নারী ও শিশুদের উপর ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দন্ডবিধির বিধানসমূহ অপর্যাপ্ত থাকায় সরকার ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ১৯৯৫ প্রণয়ন করেন। যা সর্বশেষ ২০২০ সালে সংশোধিত হয় এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ নামে অভিহিত।

সংশোধিত এ আইনের উল্লেখযোগ্য কিছু সংশোধন এবং একজন আইনজীবী হিসেবে আইনি পরামর্শ দিতে গিয়ে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ভিকটিম যেসব বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হন তা অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনার প্রয়াস থেকে আজকের এই লেখা।

পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করলে করণীয়

সর্ব প্রথম যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পরেও পুলিশ মামলা গ্রহণ করছেন না। এখন কি করবো? সাধারণত অপরাধের শিকার ব্যক্তির বর্ণিত ঘটনা এমন থাকে যে, অপরাধ যিনি করেছেন (অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি) তিনি স্থানীয়ভাবে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করছেন না।

উপরে বর্ণিত বর্ণনা অনুযায়ী কারণ বা অন্য যে কোন কারণে হোক কোন অভিযোগকারী যদি পুলিশের নিকট এই আইনের অধীন কোন অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হন, তবে এই আইনের ২৭ ধারা অনুযায়ী অভিযোগকারী ব্যক্তি কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে কোন অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছেন এই মর্মে হলফনামা (affidavit) সহকারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নিকট অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে ট্রাইব্যুনাল থাকে (প্রয়োজন অনুসারে একাধিক ট্রাইব্যুনাল ও থাকতে পারে)। এইরূপ ট্রাইব্যুনাল “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল” নামে অভিহিত বা পরিচিত।

কখন এই আইনের ১১(গ) ধারার অধীন মামলা দায়ের করা যায়

বৈবাহিক জীবনে পারস্পরিক মনোমালিন্যের জের ধরে ঘটে যাওয়া শারীরিক নির্যাতনের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই সবাই ১১(গ) ধারা, যৌতুকের জন্য সাধারণ আঘাত মামলা করতে চান। শারীরিক নির্যাতন বা মারামারি ঘটলেই তার জন্য ১১(গ) তে ঢালাওভাবে মামলা করা যাবে না। যৌতুকের দাবীতে নির্যাতন ঘটলে কেবল তখনই ১১(গ) তে মামলা করা যায়।

বিবাহিত জীবনে অন্য কোন কারণে (যেমন : পরকীয়া আসক্ত হয়ে, ঝগড়া ইত্যাদি) মনোমালিন্যতা থেকে শারীরিক আঘাতে সাধারণ বা গুরুতর আঘাত করলে তার জন্য দন্ডবিধির অধীন মামলা হতে পারে, তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০২০ এর অধীনে মামলা চলবে না।

যৌতুকের দাবীতে শারীরিক নির্যাতনের কারণে সাধারণ বা গুরুত্বর আঘাত (Nature of injury) মেডিকেল সার্টিফিকেট দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। মেডিক্যাল পরীক্ষা সরকারী বা সরকার কর্তৃক এ উদ্দেশ্যে স্বীকৃত বেসরকারী হাসপাতাল কর্তৃক সম্পন্ন হতে হবে। (ধারা ৩২); [উৎপল কুমার রায় বনাম মেঘনাথ শাহা ২৫ বিএলসি (২০২০) ৮৫৭]

তালাকের পরে অর্থাৎ পূর্বে সংগঠিত অর্থাৎ বৈবাাহিক সম্পর্ক চলমান অবস্থায় সংগঠিত অপরাধের জন্য ন্যায় বিচারের স্বার্থে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১(গ) ধারার অধীনে মামলা করতে পারবেন। তালাক হয়ে যাওয়া বা দাম্পত্য সম্পর্ক আর না থাকাতে মামলা করার অধিকার শেষ হয়ে যায় না। ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর মামলা চলবে কিনা তা matter of fact যা বিচার চলাকালীন সময়ে (trial) সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। [মোঃ তৌয়ব আলী মোল্লা বনাম সুলতান এবং গং ২২ বিএলটি (HCD) ৮৮]

মামলা আপোষ করা যাবে কিনা

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ সালের পর ১১(গ) ধারা যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম ঘটানো অপরাধ এখন আপোষযোগ্য। যৌতুকের দাবীতে সাধারণ জখম ঘটনানোর অপরাধে মামলা চলাকালীন সময়ে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে এবং তারা বর্তমানে একত্রে বসবাস ও দাম্পত্য জীবন বলবৎ রেখেছেন মর্মে আদালতে আপোষমূলে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

রায় ঘোষণার পরেও আপোষ করা যাবে কিনা

মামলার বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী যদি মামলা শেষে অভিযুক্ত ব্যক্তি দন্ডিত হন তবে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৫৬১-এ অনুযায়ী ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ আপোষের অভিপ্রায়কে গুরুত্ব দিয়ে দন্ডিত দরখাস্তকারীর দন্ড বাতিল এবং সাজা মওকুফ করতে পারবেন। [সাইফুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র ২৫ বিএলসি (২০২০) ৭৫৮]

আপীল

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের কোন আদেশ রায় বা আরোপিত দন্ড দ্বারা সংক্ষুদ্ধ পক্ষের হাইকোর্ট বিভাগে আপীল করার সময় ৬০ দিন। সংক্ষুব্ধ পক্ষ যদি উল্লেখিত সময় পার করে ফেলে তাহলে তামাদি আইন, ১৯০৮ এর ধারা ৫ এর অধীনে বিলম্ব মওকুফ পাবে না। কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন একটি বিশেষ আইন। তামাদি আইন, ১৯০৮ এর ধারা ২৯(২)(বি) অনুযায়ী, তামাদি আইনের ধারা ৫ এর অধীনে বিলম্ব মওকুফ, কোন বিশেষ আইনের বেলায় প্রযোজ্য না। তবে আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য করতে দেরি হলে ফৌজদারী কার্যবিধিরে ৫৬১ক এর অধীন আবেদন করা যাবে।

মিথ্যা মামলা, অভিযোগ দায়ের দন্ডনীয় অপরাধ

অভিযুক্ত ব্যক্তির অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে মিথ্যা অভিযোগ, মামলা দায়ের করায় সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, যদি কোন ব্যক্তি কারো ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে, ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জেনেও এই আইনের কোন ধারার অধীনে মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন তাহলে তা দন্ডনীয় অপরাধ।

কোন ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মিথ্যা মামলা, অভিযোগ দায়ের করার অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারেন। (ধারা ১৭)

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, কেবলমাত্র কোন ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতেই, ট্রাইব্যুনাল এ ধারার অধীনে গঠিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারবেন । কোর্ট নিজে থেকে এ অপরাধের আমল নিতে পারে না। [নুরুল হক বনাম রাষ্ট্র ৫৫ ডিএলআর ৫৮৮]

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সংশোধনীসমূহ

এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ এর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সংশোধনীসমূহ হচ্ছে ৯(১) ধারার অধীন ধর্ষনের শাস্তি বর্তমানে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয়।

ধারা ৩২ এর অধীন “অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা” শব্দগুলির পরিবর্তে “অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা” শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে শুধু অপরাধের শিকার ব্যক্তি নয়, সাথে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির মেডিকেল পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে কিংবা সরকার কর্তৃক এতদউদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোন বেসরকারী হাসপাতালে  সম্পন্ন করতে হবে।

সেই সাথে ধারা ৩২ এর পরে ধারা ৩২ক সন্নিবেশিত হয়েছে, যথাঃ “৩২ক। অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (DNA) পরীক্ষা। – এই আইনের অধীন সংঘঠিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধারা ৩২ এর অধীন মেডিকেল পরীক্ষা ছাড়াও, উক্ত ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (DNA) আইন, ২০১৪ এর বিধান অনুযায়ী ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (DNA) পরীক্ষা করতে হবে।”

মন্তব্য

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ একটি বিশেষ আইন। যা সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত। তবে আইনের অধীনে আনিত অভিযোগ পোক্ত ও জোরালো আইনগত সাক্ষ্য (Legal Evidence) দ্বারা অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে।

এজাহারে বর্ণিত ঘটনার সাথে ভিকটিমের বিবৃতি, জখমীর চিকিৎসা সনদ (Medical Report) যা সরকারী হাসপাতাল বা সরকার কর্তৃক এতদউদ্দেশ্যে স্বীকৃত বেসরকারী হাসপাতাল হতে সংগৃহীত প্রয়োজনানুসারে পরিধেয় বস্ত্রের পরীক্ষা এবং রাসায়নিক রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শী, অবস্থাগত বা পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ইত্যাদি আইনগত সাক্ষ্য প্রমাণ পরস্পরকে সমর্থিত (Corroborate) হতে হবে। ক্ষতিসাধন কিংবা শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার মানসিকতা থেকে মামলা করে এ আইনের অপব্যবহার রোধে সকলকে সচেতন হতে হবে।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট