জনমত নয়, বিচারের ভিত্তি আইন ও নজির
অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির

সফল হতে একজন আইনজীবীর যে তিনটি গুণ থাকা অত্যাবশ্যক

মোহাম্মদ শিশির মনির : আইন পেশা চ্যালেন্জিং। প্রতিনিয়ত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যথাযথ (appropriate) জবাব দিতে হয়। পক্ষ-বিপক্ষ-নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হয়। জজ সাহেব একটার পর একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। শান্তভাবে ক্রমান্বয়ে জবাব দিতে হয়। সন্তুষ্ট করতে হয়। প্রতিপক্ষ নিত্য-নতুন আইন দিয়ে ঘায়েল করতে চায়। সেটিও ঠান্ডা মাথায় সামাল দিতে হয়। জজ সাহেবরাও মানুষ; তাঁরাও অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতে পারেন। সেটিও মোকাবিলা করতে হয়। এই চতুর্মুখী মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উপযুক্ততা থাকা অত্যাবশ্যক।

শারীরিক যোগ্যতা

একজন আইনজীবী অবশ্যই শারীরিকভাবে ফিট হতে হবে। অন্যথায় তিনি সকাল-সন্ধ্যা-রাত-দুপুর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারবেন না। যেমন ধরুন: সুপ্রীমকোর্টের একজন্য ব্যস্ত আইনজীবী সকাল ৮:৪৫ টার মধ্যে কোর্ট প্রাঙ্গণে থাকতে হয়। কারণ ৯ টায় আপিল বিভাগে বিচার কাজ শুরু হয়। কখনও কখনও জরুরী বিষয় মেনশন করতে হয়। কখনও কখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা থাকে এবং শেখার জন্য হলেও মামলার শুনানি অনুসরণ করতে এজলাসে উপস্থিত থাকতে হয়। নতুন নতুন বিষয় শেখার থাকে। বুঝার থাকে।

এদিকে ৯:৩০ টায় হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ শুরু হয়। সেখানে বিশেষ মেনশন থাকতে পারে। উপরে আইটেম থাকতে পারে। এক কোর্ট থেকে আরেক কোর্টে যেতেও সময় লাগে। মামলার শুনানি শুরু হল বলে এই সময় হাজির হয়ে সঠিক কথাটা বলা এবং মক্কেলের পক্ষে যথোপযুক্ত আদেশ পাওয়া সহজ কথা নয়।

হাইকোর্ট চলে ১২:৪৫টা পর্যন্ত। তারপর নামাজ-দুপুরের খাবার ও ১০/১৫ মিনিটের বিরতি। আবার ১:৩০ টায় শুরু হয় হাইকোর্ট। চলে ২:৪৫ পর্যন্ত। সে সময়ও বিভিন্ন আদালতে মামলা থাকে। এরই মধ্যে ২টায় শুরু হয় মাননীয় চেম্বার জজের আদালত। সেখানেও মামলা থাকতে পারে। এভাবে বিকাল ৩/৪/৫ টার সময় আদালতের বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়। কখনও হার আবার কখনও জিত। হার-জিতের এই খেলায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখেই চলতে হয়। ভেঙ্গে পরলে চলে না। হারলেও মাচ অবলাইজড (much obliged) আবার আবার জিতলেও বিনয়ের সাথে বিস্তর কৃতজ্ঞতা (much obliged) প্রকাশ করে মুচকি হাসি দিতে হয়।

এখানেই শেষ নয়। বিকাল/সন্ধ্যায় শুরু হয় চেম্বার। নানান ধরনের মক্কেল আসতে থাকে। তাদের অনেক ধরনের সমস্যা থাকে। হার-জিত আছেই। মনেও বেশ প্রভাব পরে। নতুন মামলা আসলে নথি পড়তে হয়। মামলা খসড়া (draft) করতে হয়। গবেষণা করতে হয়। নতুন নতুন নজির খুঁজতে হয়। পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। রাত গভীর হয়ে যায়। বইয়ের পাতায় জীবনের মূল্যবান সময় বিলীন হয়ে যায়। কখনও রাত ১০/১১/১২ বেজে যায়। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ইবাদত বন্দেগী সেরে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। নাস্তা-পানি খেয়ে চেম্বার হয়ে আবার কোর্টের দিকে রওয়ানা। এ যেন স্বয়ংক্রিয় মেশিন। চলছে ত চলছেই।

শারীরিক সুস্থতা ছাড়া কেউ এই প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল চালিয়ে যেতে পারে না। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে সময় পার হয়ে যায়। কর্মক্ষমতাও কমতে থাকে। তবুও শরীর ঠিক রাখতে হয়। যে বা যারা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় সে বা তারা নিরবচ্ছিন্ন সার্ভিস দিতে পারে না। থমকে যায়। আর সামনে আগাতে পারে না। সময়ের সাথে সাথে সিনিয়র উপাধি পেয়ে যান কেউ কেউ। তাতেও শেষ নাই। অনেকেই সিনিয়র উপাধি পান। তাঁদের মধ্যে সবাই লম্বা সময় নেক হায়াত পান না। যে বা যারা শারীরিকভাবে নিজেকে রক্ষা (maintain) করে চলেন বা সুস্থ থাকেন তাঁরা সিনিয়রদের মধ্যে সিনিয়র হয়ে যান। প্রায় ৭৫/৮০/৯০/৯৫ বছর পর্যন্ত কর্ম-চঞ্চল থাকেন কেউ কেউ। সৌভাগ্যবান না হলে এটি সম্ভব নয়।

আমি সরাসরি দুইজন স্বনামধন্য বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীর সাথে কাজ করেছি/করছি। জনাব ব্যরিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং জনাব খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাছাড়াও বিভিন্ন মামলার স্বার্থে ৬/৭ জন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীর সাথে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। আইনপেশায় আমার হাতেখড়ি হয়েছে জনাব ব্যরিস্টার রাজ্জাক স্যারের সাথে। তাঁর কথা-কাজ-শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, বাচন ভঙ্গি, স্থিরতা, শারীরিক-মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক উপযুক্ততা (fitness) আমাকে দারুণভাবে মোহিত করত। আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। চোখের পলকে সময় চলে যেত। মনে হত হায় হায় কি হল! নতুন বিষয় পড়ার প্রতি স্যারের আগ্রহ বলে শেষ করা যাবে না। সব সময় বলতেন, ‘শুনা কথায় কান দিবা না। ভাল করে পড় এবং খোঁজ-খবর নিয়ে দেখ। তারপর সিদ্ধান্ত নাও।’ আজও কথাগুলো কানে বাজে।

খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে স্যার ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। ২০১২ সালের ঘটনা। ২০০৬ সালের একটি রাজনৈতিক মামলা নিষ্পত্তি হল। হেডক্লার্ক হাশেম ভাই বললেন সবাই কে খাওয়াতে হবে। জাজেজ ক্যান্টিন থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট আনা হল। স্যারসহ সবাই বসে আছেন। রুম ভর্তি মানুষ। স্যারের সামনে একটি প্যাকেট ও চামচ দেওয়া হল। স্যার বললেন,’বিরিয়ানি খাব! আমি তো বিরিয়ানি খাই না। শিশির যেহেতু আনছে একটু তো খেতেই হয়।’ এই কথা বলে কয়েক চামচ খেলেন আর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। স্যার সব-সময় বাসায় তৈরি করা খাবার খেতেন। দুপুরের খাবার ছিল লাল আটা দিয়ে বানানো রুটি। ঠিক ১ টা বাজলেই খাবার খেতেন। মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। তারপর ১০/১৫ মিনিট চোখ বুজে বিশ্রাম (rest) নিতেন। এই সময় আমরা কেউ কথা বলতাম না। ঠিক ১৫ মিনিট পর আবার সতেজ হয়ে কাজ শুরু করতেন।

এখন দেখছি খন্দকার মাহবুব হোসেন স্যারকে। কাগজপত্রে স্যারের বয়স ৮৫ হলেও আসল বয়স নিশ্চয়ই বেশি। অনেক স্বাস্থ্য সচেতন। নিয়ম মেনে চলেন। সৌখিন কাপড়-চোপড় পরিধান করেন। স্যারের প্রতিটি কাজ অনুকরণীয় (Eye opening). এই বয়সে মক্কেলের প্রতি দরদ দেখলে ঈর্ষা হয়। স্যার সব সময় বলেন,’ মক্কেল তার মামলা সম্পর্কে জানতে চায়। এটা তার অধিকার। সে উদ্বিগ্ন থাকে। তাকে জানানো আমাদের দায়িত্ব।’

এখনও মামলা থাকলে সবার আগে কোর্টে এসে হাজির হন। স্যার প্রায়ই একটি গল্প বলেন। খন্দকার স্যার এবং মরহুম সিনিয়র আইনজীবী রফিকুল হক একে অন্যকে মামা ডাকতেন। আপিল বিভাগে রফিকুল হক স্যার সবার আগে এসে বসে থাকতেন। লিস্ট নিয়ে দাগ দিতেন আর ফাইল পড়তেন। একদিন খন্দকার স্যার আপিল বিভাগে এসে দেখেন সামনের বেঞ্চ ফাঁকা। কেউ আসে নাই। স্যার বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই রফিকুল হক স্যার প্রবেশ করে সামনে আসলেন। পিছন ফিরে দেখেন রফিকুল হক স্যার। ঠাট্টা করে বললেন,’মামা আজেক কিন্তু আমি ফার্স্ট (First) হয়ে গেছি।’ বেশ হাসাহাসি করলেন।

এই বয়সে আমরা বেঁচে থাকব কি না জানি না। আমাদের হায়াত থাকবে কি না আল্লাহই ভাল জানেন। স্যারকে দেখে খুব উৎসাহ পাই। মনে হয় সত্যিই জীবন খুব বিচিত্র। আল্লাহকে স্যারকে নেক হায়াত দান করুন। আমিন।

মানসিক যোগ্যতা 

খুবই জরুরী বিষয়। মানসিক স্বস্তি/শান্তি না থাকলে ভাল প্রস্তুতি নেয়া যায় না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত (Mentally disturbed) বা পারিবারিকভাবে সংবিগ্ন (disturbed) ব্যক্তিরা সকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হারিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত চালিয়ে (continue) যেতে পারেন না। অকুন্ঠ পারিবারিক সমর্থন ছাড়া বেশিদূর যাওয়া যায় না। সফল আইনজীবীদের সবাই তাঁদের পরিবারের কাছে ঋণী। কিংবদন্তী সিনিয়র আইনজীবী জনাব মাহমুদুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন,’ জীবনে অনেকবার বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার জন্য স্ত্রীকে রেডি থাকতে বলেছি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে কিন্তু স্যার যেতে পারিনি।’ সেজন্য ফোন করে বলেছেন,’সরি, কাজের ঝামেলায় পড়ে গেছি।’ উত্তরে বলেছেন ‘ঠিক আছ।’ এই ধরণের স্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকাই স্বাভাবিক। এই সহযোগিতা সকলে হয়ত করতে পারবে না। এই উদারতা সকলের কপালে থাকে না।

শরীর ও মন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানসিক সতেজতা (freshness) ছাড়া অন্য মানুষের সমস্যার যথাযথ সমাধান বের করা সত্যিই দুরূহ। বস্তুতঃ একজন মানুষ নিজের সমস্যা আইনজীবীর কাঁধে তুলে দেয়। তার সমস্যা কাঁধে নিয়ে আন্তরিকভাবে (sincerely) করা বা চালিয়ে যাওয়া সুস্থ মন (sound mind) ছাড়া সম্ভব নয়। অনেক ঝামেলা মাথায় নিয়ে অনেকেই পথ চলতে পারে না। এলোমেলো হয়ে যায়। খেই হারিয়ে ফেলে। অধৈর্য হয়ে যায়। সময়মত পদক্ষেপ নিতে পারে না। শুরু হয় অনাস্থা আর অবিশ্বাস। বদনাম বাতাসের রেগে ছড়িয়ে পরে। এই পেশায় বদনাম বা সুনাম দুটোই খুব তড়িৎ গতিতে বিস্তার লাভ করে। বিশেষ করে ভুক্তভোগীরা এই সকল ঘটনার উপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখে। একে অন্যের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করে। আমি/আপনি হয়ত ধারণাও করতে পারি না কত দ্রুত বিষয়গুলো ছড়ায়!!

খন্দকার মাহবুব হোসেন স্যার সব সময় বলেন, ‘বঞ্চিতরা একে অন্যের কাছাকাছি থাকে। সুখ-দুঃখ শেয়ার করে। তখন আর দল-মত-জাতি-গোষ্ঠীর বিভেদ থাকে না।’ এর প্রতিফলন প্রায়ই দেখি। হঠাৎ করে জেল থেকে বা দেশের বিভিন্ন কর্ণার থেকে ফোন করে বলে,’স্যার, আমি ওমুক, ওমুক জায়গা থেকে বলছি।’ বললাম ‘বলেন’ এবং জিজ্ঞাসা করি নম্বর কোথায় পেলেন? জবাবে বলে,’ ওমুক মামলার ওমুক আসামীকে আপনি খালাস করাইছেন বা জামিনে মুক্ত করছেন বা চাকুরীর ব্যবস্থা করছেন বা টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।’ তখন মনে হয় আসলেই বঞ্চিতরা মনের দিক থেকে খুব কাছাকাছি। হঠাৎ মৃত্যুর সেল (Condemn cell) থেকে কল দিয়ে বলে স্যার আমি ওমুক বলছি ওমুক মৃত্যুর সেল থেকে। কী জবাব দিব! অবাক বিস্ময়ে তাদের কথা শুনি। কত দরদ! কত আবেগ! কত প্রত্যাশা আর হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা! উল্লেখ্য জেল থেকে ফোনে যোগাযোগ করার ভাল ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকার।

এত অভিযোগ-অনুযোগ শুনার জন্য প্রয়োজন সতেজ মন। অনেকেই অনেক কথা বলেন বা বলতে চান। সব শুনে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য শরীর-মন-বুদ্ধি সবই প্রয়োজন। অন্যথায় বঞ্চিতদের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব নয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা

আইনজীবীদের হলা হয় কৌঁসুলি। এই কলা-কৌঁসুল সঠিকভাবে আয়ত্ত করার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়। তিলে তিলে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে একজন আইনজীবী বিদগ্ধ হয়ে উঠেন। মামলার ফাইল পড়তে পড়তে এক সময় সবকিছু নখদর্পণে চলে আসে। অনেক বড় পেপারবুক হলেও মূল বিষয়বস্তু চট করে ধরে ফেলা যায়। বিজ্ঞ সিনিয়রদের ভাষায় ‘Heart of the case’ এ সহজেই ঢুকা যায়।

একই মামলার কাগজপত্র একজন পড়লে এক রকম Point বের হয় ; আবার অন্যজন পড়লে ভিন্নরকম Point বের হয়। এর মূল কারণ হল ফাইল পড়ার সময় সংশ্লিষ্ট আইন ও নজির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। যার মাথায় আইন ও নজির বেশি খেলে তিনি তত বেশি সুনিপুন সমাধান বের করতে পারেন। একজন আইনজীবীর এটাই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি (intellectual property). এর মালিক শুধুই তিনি নিজে। যেমন: একজন শিল্পীর কন্ঠে বেজে ওঠা ব্যতিক্রমী সংগীত শুধুই তার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি। জোর করে তার কন্ঠে এই গান তোলা যাবে না। আবার তিনি অসুস্থ হয়ে গেলে অন্য কেউ একই রকমভাবে গানটি গাইতে পারবেন না। একজন আইনজীবী, ডাক্তার, কারুশিল্পী ইত্যাদি পেশাও একই রকম।

একজন আইনজীবীর কৌশল নির্ভর করে জানার উপর। যিনি যত বেশি নজির জানেন তিনি তত বেশি কৌশল বের করতে পারেন। কারণ বর্তমানের ঘটনার অনেক কিছুই অতীতের ঘটনার সাথে মিলে যায়। আইনজীবী তখন সেটি নজির আকারে আদালতকে দেখাতে পারেন। সহজেই সমাধান বের হয়ে আসে। কারণ বিচারকরাও মানুষ। সব বিষয়ের সমাধান তাৎক্ষণিকভাবে বিচারকের জানা না থাকাই স্বাভাবিক। তখনই দরকার হয় আইনজীবীর সৃজনশীল (creative) সহযোগিতা। গবেষণা নির্ভর, নজির নির্ভর সমাধান বাতলিয়ে দেয়া। কেবল তখনই একজন বিচারক তড়িৎ সমাধান দিতে পারেন।

যেমন: সিনিয়র আইনজীবী জনাব মাহমুদুল ইসলাম স্যারকে দেখেছি। জটিল বিষয়ে আদালত তাঁর মতামত জানতে চাইতেন। তৎকালীন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা একদিন বললেন,’ Mr. Islam, তাহলে আপনি ইয়ে করে দেন। মানে আপনি একটু লিখে দেন আদেশটা কেমন হওয়া উচিত।’ সঙ্গে সঙ্গে স্যার বসে গেলেন এবং কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সাদা কাগজে আদেশটা হাতে লিখলেন এবং দাঁড়িয়ে পড়ে শুনালেন। সব বিচারকরা একমত পোষণ করলেন। পিছন থেকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম।

অনেক সময় তড়িৎ গতিতে কাজ করতে হয়। জরুরী বিষয় থাকে। সময় কম থাকে। রাত জেগে কাজটি শেষ করে পরের দিন সকালে মামলা দায়ের করে আদালতে নিয়ে যেতে হয়। ঐদিনই আদেশ চাইতে হয়। যেমন: জাপানি শিশুর মামলা একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। স্পষ্ট মনে আছে বিকাল ৪:১৫ টার সময় মক্কেল আমাদের জানালেন যে, তিনি মামলা করবেন। ওকালাতনামা স্বাক্ষর করলেন। তখনই কাজ শুরু করা হল। আমরা পরিকল্পনা করলাম। আমার জুনিয়র সাদ্দাম পুরো দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করল। সারারাত কাজ করে ফজরের সময় আমাকে ড্রাফ্‌ট (draft) পাঠাল। আমি ভোর বেলা দেখে আবার তাকে পাঠালাম। তারপর প্রিন্ট হল। সকালে ১০:৩০ টায় ভার্চুয়াল কোর্টে (virtual court) অনুমতি (permission) নিলাম। হলফনামা (Affidavit) সম্পন্ন করে নম্বর ফেলে আবার কোর্টে এসে মেনশন করলাম। মাননীয় আদালত supplementary list করলেন। বললেন ২টায় শুনানি হবে আসেন। দুপুর ২ টায় শুনানি হল। আদেশ দিলেন। স্বস্তি বোধ করলাম। এই pains and sufferings অনেকেই নিতে পারেন না। নিজেস্ব পরিকল্পনামত ধীরে ধীরে চলতে চান। কিন্তু মক্কেলের জরুরীয়াত থাকলে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।

সকল কিছুর পর বিনয়ী হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিচারক-জজ-সিনিয়র-জুনিয়র-প্রতিপক্ষ সবার সাথে বিনয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে কোন বাধা নাই। অবশ্য আইন/নজির দেখিয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারা সামর্থের (ability) বিষয়। মানি না বা মানব না বা সঠিক নয় এই কথা বলার আগে কারণটা বের করতে হবে। যুক্তির সমর্থনে সংশ্লিষ্ট আইন বা নজির থাকতে হবে। তবেই সবাই আপনার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে বাধ্য হবে। এখানে জোর জবরদস্তির কিছু নাই।

‘কন্ঠে বল আর ঝুড়িতে ফল দরকার।’

লেখক : মোহাম্মদ শিশির মনির; আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।