মেডিকেল সনদ প্রদানে কক্সবাজার 'জাস্টিস অব পিস' এর ১২ দফা নির্দেশনা
বিচারক আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী

মেডিকেল সনদ প্রদানে কক্সবাজার ‘জাস্টিস অব পিস’ এর ১২ দফা নির্দেশনা

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : জখমীর মেডিকেল সনদ, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট তৈরি, ধর্ষণ সংক্রান্ত পরীক্ষার রিপোর্ট, বয়স নির্ধারণী রিপোর্ট সহ আদালতে স্বাস্থ্যগত সকল প্রতিবেদন তৈরি ও সরবরাহে দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের সাথে যথাযথ আইনী বিধি বিধান প্রতিপালন, অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য ১২ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত প্রতিবেদনের অর্থ বুঝতে যাতে আদালত এবং আদালত সংশ্লিষ্ট সকলের কোন সমস্যা না হয়, সেজন্য এ বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী ১৮৯৮ সালের The Code of Criminal Procedure এর ২৫ ধারার ক্ষমতাবলে “জাস্টিস অব দি পিস” (Justice of the Peace) হিসাবে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে এ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি করেন।

কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশেক এলাহী শাহজাহান নুরী ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম-কে এ তথ্য জানিয়েছেন।

নির্দেশনায় জাস্টিস অব দি পিস উদ্বেগের সাথে বলেন, বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সনদ প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিধি বিধান অনুসরণ করছেন না। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও গাফেলতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে। ন্যায় বিচার ব্যাহত হচ্ছে। আদালতকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। যা কোনভাবেই কাম্য নয় বলে কক্সবাজারের জাস্টিস অফ দি পিস আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী তাঁর নির্দেশনায় উষ্মা প্রকাশ করেন।

জারীকৃত নির্দেশনায় বলা হয়, হাসপাতাল হতে প্রদত্ত ভিকটিমের জখমী সনদপত্রে সনদ প্রদানকারী বোর্ডের সদস্যগণের স্বাক্ষরের নীচে নামসহ সীল অনেক সময় ব্যবহার করা হয় না। যে কারণে জখমী সনদ ইস্যুকারী চিকিৎসকদের চিহ্নিত বা সনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া, হাতে লিখে জখমী সনদ ইস্যু না করার জন্য বার বার নির্দেশনা দেওয়া সত্বেও তা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না। বিভিন্ন সময় কম্পিউটারে টাইপকৃত জখমী সনদ ইস্যু করা হলেও উক্ত জখমী সনদ সমূহে নিম্নমানের কালি ব্যবহার করা হয়। যার ফলে কিছুদিন গেলেই নিম্নমানের কালি ব্যবহার করে ইস্যু করা মেডিকেল সনদ অস্পষ্ট হয়ে যায়, লেখা আপনাআপনি মুছে যায়।

আবার একই ঘটনার, একই ভিকটিমের জখমের বর্ননা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ইস্যুকৃত জখমী সনদে আঘাতের ব্যাখ্যায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এসব সমস্যা সমাধানে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি কনফারেন্সে বারবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা যথাযথভাবে প্রতিপালনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সচেষ্ট হননি।

এ অবস্থায় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মামলার বিচারকার্যে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানের সুবিধার্থে জাস্টিস অব দি পিস আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবরে ১২ দফা নির্দেশনা জারি করেন। জারীকৃত নির্দেশনা সমূহ হচ্ছে :

(১) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাহিদাপত্র ব্যতীত জখমী সনদ ইস্যু না করা।
(২) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ১৯৯৫ সালের ১০ অক্টোবর ১৮০৬৯ নম্বর স্মারকে জারীকৃত পরিপত্রের নির্দেশনা মতে ৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে জখমী সনদ ইস্যু করা। প্রয়োজন হলে আবাসিক মেডিকেল অফিসার, ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসার এবং যে চিকিৎসক জখমীকে চিকিৎসা প্রদান করেছেন- তাঁদেরকে আই.ডি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নাম, পদবী উল্লেখপূর্বক আবশ্যিকভাবে মেডিকেল বোর্ডে অর্ন্তভূক্ত রাখা।
(৩) Criminal Rules and Orders, Vol-II এর Form No. (M)4 অনুযায়ী জখমীর মেডিকেল সনদ ইস্যু করা।
(৪) সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জখমী সনদপত্রে জখমী সনদ প্রদানকারী মেডিকেল বোর্ডের সদস্যগণের স্বাক্ষরের নিচে আই.ডি নং (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), নাম ও পদবীসহ সীল, তারিখ ব্যবহার করা এবং মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ করা।
(৫) হাতের লিখা জখমী সনদ সরবরাহ না করে, কম্পিউটারে টাইপকৃত জখমী সনদ সরবরাহ করা।
(৬) কম্পিউটার টাইপ করে ইস্যুকৃত জখমী সনদের লেখা মুছে যাওয়া কিংবা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকায় কম্পিউটারে টাইপকৃত জখমী সনদসমূহে উন্নতমানের প্রিন্টার ও কালি ব্যবহার করা।
(৭) একই ঘটনায়, একই ভিকটিমের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদর হাসপাতালের জখমী সনদে আঘাতের বর্ণনার ভিন্নতা থাকার বিষয়ে এবং আঘাতের বর্ণনায় বানান ভুল না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং তৎবিষয়ে উভয় হাসপাতালের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা
(৮) জখমী সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে জখমী সনদে ভিকটিম ও ভিকটিমকে সনাক্তকারীর নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তাদের স্বাক্ষর ও ঠিকানা নিশ্চিত করা।
(৯) সংশ্লিষ্ট রেজিস্টার পর্যালোচনা করে জখমী সনদ প্রদানের সুযোগ থাকলেও অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত ও আঘাত অনুযায়ী জখমী সনদ প্রদানের স্বার্থে জখমী সনদ ইস্যুকারী বোর্ডের সামনে ভিকটিমের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। জরুরী বিভাগের প্রাথমিক চিকিৎসা পরবর্তী জখমীকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হলে, সেক্ষেত্রে উক্ত ওয়ার্ডে অবস্থান করা রোগীর রেজিষ্টার পর্যালোচনা করে জরুরী বিভাগের রেজিষ্টার ও ওয়ার্ডে থাকা রেজিষ্ট্রারের তথ্যাবলী সমন্বয় করে পরিপূর্ণ জখমী সনদ সরবরাহ করা।
(১০) জখমী সনদ ইস্যুকালে সংশ্লিষ্ট এক্স-রে রিপোর্ট, সিটি স্ক্যান রিপোর্ট, আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট, ডিসচার্জ সার্টিফিকেট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), অন্যান্য ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট ও আনুষাঙ্গিক কাগজপত্র জখমী সনদের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া। তাছাড়া উক্ত জখমী সনদের সাথে জখম সংক্রান্ত রেজিষ্ট্রারের সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার সত্যায়িত ছায়াকপি সংযুক্ত করা।
(১১) ধর্ষণ সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে ভিকটিম/অপরাধের শিকার ব্যক্তিকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার (ফরেনসিক বিভাগ) দ্বারা পরীক্ষা করা, প্রয়োজনে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক উক্ত রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সাথে উক্ত বিষয়ে সমন্বয় সাধন করা।
(১২) পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বাক্ষরের নীচে সীলসহ স্পষ্ট নাম, পদবী, মোবাইল নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করা।

তাছাড়া, এক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বরের সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ক্রিমিনাল আপীল নং-১০৯৬৯/২০১৯ এর নির্দেশনামতে একই মৃত ব্যক্তির স্পষ্ট হাতের লিখা সম্বলিত এবং কম্পিউটারে টাইপকৃত দু’টি পৃথক পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট সকল কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণ করা দরকার। প্রয়োজনে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ কর্তৃক উক্ত রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

কক্সবাজারের জাস্টিস অব পিস এবং চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী জারীকৃত নির্দেশনায় আরো বলেন, স্বাস্থ্যগত সকল সনদ প্রতিটি মামলার অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক সনদ তৈরি ও সরবরাহে বিধি বিধান অনুসরণ করে সুস্পষ্ট লেখায় সরবরাহ করা হলে আদালত তা আমলে নিয়ে জখমের ধরন, জখমের মাত্রা দেখে অপরাধের পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করে আদালত বিচারকার্যে যথার্থ সিদ্ধান্ত উপনীত হতে পারে। অপরদিকে, স্বাস্থ্যগত সনদ তৈরি ও সরবরাহে বিধি বিধান প্রতিপালন করা নাহলে অপরাধের মাত্রা নিরূপণে সংকট সৃষ্টি হয়। বিচার প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়। এতে, বিচারপ্রার্থীদের কাছে বিচার বিভাগ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যায়। তাতে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হ্রাস পাওয়ার আশংকা থাকে।

নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে অনুসরণ পূর্বক তা প্রতিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। একইসাথে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয় থেকে জারীকৃত পরিপত্র ও আইনের বিধান সমুহের ছায়াকপিও প্রেরণ করা হয়েছে।

কক্সবাজারের বিজ্ঞ জাস্টিস অব পিস এর উল্লেখিত ১২ দফা নির্দেশনা অধ্যক্ষ, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ, পুলিশ সুপার, কক্সবাজার, সিভিল সার্জন, কক্সবাজার, তত্ত্বাবধায়ক, জেলা সদর হাসপাতাল, কক্সবাজার, পুলিশ সুপার, পিবিআই/সিআইডি/ট্যুরিস্ট পুলিশ, কক্সবাজার, কক্সবাজারের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের সকল সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটর, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজারের সকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, কক্সবাজারের সকল আবাসিক মেডিকেল অফিসার এবং কক্সবাজারের সকল থানার অফিসার ইনচার্জের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।