মামলার নথির ফটোকপি সরবরাহ না করা হলে বন্ধ হবে আগাম জামিন
কুমার দেবুল দে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক কার্যকরী সদস্য

ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচারকের পাশপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনজীবীকেও প্রশিক্ষণ দিতে হবে

কুমার দেবুল দে : রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থায় বিচারক এবং আইনজীবী এই দুইটি ক্যারেক্টারের একটিকে মহীরুহ বানানো হচ্ছে আবার আইনজীবী নামক ক্যারেক্টারটিকে সব তাঁর নিজের হাতের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে একেবারেই অসহায় অবস্থায়। একজন বিচারকের সাথে আইনজীবীর কোন আর্থিক বা আনুষঙ্গিক কোনো সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য এই দুই ক্যারেক্টার বিচার প্রক্রিয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলার বিষয়ে।

বিচার প্রক্রিয়ায় একজন বিচারক থাকেন আবার তাঁকে সহযোগীতা করার জন্য বিবাদমান দুইপক্ষে ন্যূনতম দুইজন আইনজীবী থাকেন। একটি বিচার প্রক্রিয়ায় যেমন একজন দক্ষ বিচারক দরকার ঠিক তেমনি আইনজীবীও দক্ষ হতে হয়, আমার আক্ষেপের জায়গা হলো একজন বিচারক এবং আইনজীবী দুজনেই সমান একাডেমিক ডিগ্রী এবং সমান যোগ্যতা সম্পন্ন হলেও একজন বিচারককে গড়ে তোলা হয় সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অথচ একজন আইনজীবীকে দক্ষ আইনজীবী হিসাবে গড়ে উঠতে হলে সেটা সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় গড়ে উঠতে হবে।

একজন বিচারককে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং, সার্ভে সেটলমেন্টসহ কত শত কোর্স যে করানো হয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তার ইয়ত্তা নেই। অথচ একজন আইনজীবীকে দক্ষ আইনজীবী হতে হলে তাঁকে আরেকজন দক্ষ আইনজীবীর চেম্বারে কাজে যোগ দিতে হবে, সেই সৌভাগ্য আর কয়জনেরই বা হয়! যেমন আমার জীবনে হয় নাই। অথবা দক্ষ আইনজীবীদের সংখ্যাই বা কত? হাতে গোনা কয়জন তাঁরা ইচ্ছা করলেও সকল আইনজীবীকে তাদের চেম্বারে জুনিয়র বানাতে পারবেন না।

এসব কিছুর পরও হয়তো আপনি অনেক চেষ্টাতে একটা দক্ষ আইনজীবীর চেম্বারে জয়েন করলেন কিন্তু উনার চেম্বারে অনেক জুনিয়র বা তাঁরা অনেক সিনিয়র তাই আপনাকে কাজে সমান সুযোগ দেয়া হয়না, ফলে আপনি আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ছেন। আর যারা ভালো চেম্বারে জয়েন করতে পারেন নাই তাদের বিষয়ে কোন কথাই হবে না। এখন আপনি জীবনে যা-ই করবেন তা একেবারেই নিজস্ব চেষ্টাতে। হয়তো এরপরে মাঝারি মানের একজন সিনিয়র ধরবেন, তেমন একটা পারিশ্রমিকও পাবেন না, পারবেন না খুব বেশি শিখতে এবং একেবারেই খাবেন যাবেন যা করবেন সবই নিজস্ব চেষ্টায়। অতঃপর হতাশ হয়ে পেশা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত জীবনের ধান্দায় একদিন কোন না কোন চাকরিতে জয়েন করবেন, ওকালতি আর করা হলোনা বলে সারাজীবন আক্ষেপ করতে থাকবেন। এইভাবে শুধুমাত্র সুযোগের অভাবে দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কতশত সম্ভাবনাময় এবং মেধাবী আইনজীবী!

অথচ দেশের বিদ্যমান আইন বলে জন্ম নিচ্ছেন একজন বিচারক হয়তো অন্য কোন আইন বলে জন্ম নিচ্ছেন একজন আইনজীবী। একজন বিচারককে রাষ্ট্র তার নিজের লোক (OWN) ভাবলেও একজন আইনজীবীকে রাষ্ট্র নিজের লোক (OWN) ভাবছেন না। তাতেই এই বিপত্তি! একজন বিচারক ক্রমাগত এবং বিজ্ঞানসন্মত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে আইনে এবং জ্ঞানে একজন মহীরুহে পরিণত হচ্ছেন এবং একজন আইনজীবী যিনি বিচারের অপরপক্ষ তিনি দিনদিন প্রশিক্ষনহীনতায় এবং শুধুমাত্র নিজস্ব চেষ্টার মাধ্যমে যুগোপযোগী (up to date) হতে পারছেন না বা তিনি বিচারকের সমান দক্ষ হতে পারছেন না এবং তা বিচারে অসমতার সৃষ্টি করছে।

এইভাবেই হচ্ছে বিচার বিভ্রাট, একজন দক্ষ আইনজীবীর অভাবে একজন বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না অথচ এই বিষয়টা নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছেন একজন বিচারক। হয়তো তিনি মাঝেমধ্যেই আইনজীবীকে বলছেন, আপনি দক্ষ নন বা আপনি আপ টু ডেটেড নন বা দেশে দক্ষ আইনজীবীর সংখ্যা খুবই কম। কথাটি পরিহাসের ছলে বলা হলেও সেইটা কিন্তু বাস্তবতা।

প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় কোনো একটা সভায় মাননীয় বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন দেশের ৭০ ভাগ বিচারপ্রার্থীরা ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না শুধুমাত্র আইনজীবীদের অদক্ষতায়, সেইদিন আমি নিজেও তাঁর প্রতিবাদ করেছিলাম। তিনি কথাটি মিথ্যা বলেছেন বলে নয়, আমি প্রতিবাদ করেছিলাম এই কারণে যে আপনি বিচারক হিসাবে যখন দেখতে পেলেন যে একজন বিচারপ্রার্থী ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না শুধুমাত্র আইনজীবীর অদক্ষতার ফলে সেইদিন আপনি কি বিচার করেছিলেন? আইন তো আপনাকেও একজন বিচারক হিসাবে শুধুমাত্র ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন আপনি কেন তা ব্যবহার করলেন না? আপনি নিজের চোখে দেখেও কেন একজন বিচারপ্রার্থীকে হেরে যেতে দিলেন? আপনার কি এই দায় এড়ানোর কোন সুযোগ আছে? উত্তরঃ আমি মনে করি নাই।

অথচ রাষ্ট্র গ্যারান্টি দিয়েছে একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতের এবং আইনজীবীদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না করলে কি রাষ্ট্র কোনদিন এই বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে পারবে? অবশ্যই নয়। তাই আইনজীবীদেরও জজসাহেবদের যেই মডিউলে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় ঠিক একই সময়ব্যাপী একই রকম পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আইনজীবীদের জন্য ট্রেনিং ইন্সটিটিউট গড়ে তুলতে হবে অথবা বিচারকদের যেই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেইখানেই একই সাথে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। এইখানে আবার অনেকেই আপত্তি তুলতে পারে প্রয়োজনে বড় আকারের সম্মিলিত ট্রেনিং ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা যেতে পারে। আমি তো অনেক ট্রেনিং দেখেছি যেইখানে পুলিশ, প্রশাসনের ক্যাডার এবং বিচারিক কর্মকর্তা সবাই একসাথে ট্রেনিং করছে সেইখানে আইনজীবীদেরও যুক্ত করা যেতে পারে। প্রথম দিকে হয়তো সকল আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব নয় তারজন্য সিলেক্টিভ কিছু আইনজীবীদের নিয়ে সীমিত সংখ্যক আইনজীবী নিয়ে এই প্রশিক্ষন শুরু করা যেতে পারে।

রাষ্ট্রের সকল কাজে, সকল প্রতিষ্ঠানেরই আইনজীবী আছে রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি করার জন্য তারা সবাই কি দক্ষ আইনজীবী? অবশ্যই নয়। আমাদের কথা বাদই দিলাম রাষ্ট্র আগে তাদের আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনেও তো এই কার্যক্রম শুরু করতে পারে, তাতে বরঞ্চ রাষ্ট্রেরই লাভ হবে। আর এতে আমাদের লাভ হলো কিছু আইনজীবী প্রশিক্ষিত হবে সে যেই আইনজীবীই হোক এবং আমরা এই আশায় বুক বাধতে পারবো যে যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অন্তত আইনজীবী প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড শুরু হলো বলে।

আমি আশা করছি একদিন আইনজীবীরাও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষত হবে। আইনজীবীদের নেতারা, সরকারে থাকা আইনজীবী সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ ভেবে দেখতে পারেন কোর্ট আঙ্গিনায় শুধু কি এসপিএল এর নামে ক্রিকেট লীগ খেলবেন বা ফুটবল লীগ খেলবেন নাকি সাথে সাথে আইনজীবীদের উন্নত প্রশিক্ষণের বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করবেন এবং আইনজীবীদের জ্ঞানে গরিমায় এগিয়ে নিবেন? আপনারা চেষ্টা করলে সবই হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

লেখক: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক কার্যকরী সদস্য।