প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

নারাজি দরখাস্ত অগ্রাহ্য হলেও প্রতিকার আছে

দীপজয় বড়ুয়া : নারাজি বলতে বুঝায় যে, ‘আমি মানি না’। সাধারণত ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে নারাজি পিটিশন দায়ের করা হয়। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণত ফৌজদারী কার্যবিধির ১৮৯৮ এর ১৭৩ ধারা মোতাবেক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মূলত ২(দুই) ধরণের রিপোর্ট বা প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন।

প্রথমতঃ মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তের কার্যক্রম সম্পন্ন করে যদি দেখেন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধ করার সত্যতা পাওয়া গিয়েছে তখন তাদের বিচার প্রার্থনা করে “চার্জশীট বা অভিযোগপত্র” বলে।

দ্বিতীয়তঃ তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার তদন্তের কার্যক্রম সম্পন্ন করে যদি দেখেন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের বা অপরাধের কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় নি তখন মামলার দায় হতে অভিযুক্তে অব্যাহত চেয়ে “ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন” দাখিল করেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রদত্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে অভিযোগকারী বা মামলার বাদী সঠিকভাবে বা পূর্ণাঙ্গভাবে মামলার তদন্তকার্য সম্পন্ন করা হয় নি মর্মে আপত্তি উত্থাপন করে  ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অধিকতর তদন্তের দরখাস্ত করতে পারেন। এই দরখাস্তকেই নারাজি বলে।

ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নারাজি দরখাস্ত নিষ্পত্তি

সংবাদদাতা/অভিযোগকারী ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নারাজি দরখাস্ত দাখিলের পর ম্যাজিস্ট্রেট মামলার নথিপত্র, কেস ডায়েরি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে যদি মনে করেন যে, তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন করেননি তাহলে তিনি নারাজি দরখাস্তটি নিষ্পত্তি করার জন্য নিম্নলিখিত উপায়ে অগ্রসর হতে পারেন-

১) ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত নারাজি দরখাস্তটিকে নালিশী দরখাস্ত হিসেবে গণ্য করে ফৌজদারী কার্যবিধির ২০০ ধারায় শপথ গ্রহণপূর্বক অভিযোগকারীকে পরীক্ষা করে অভিযোগ আমলে নিবেন এবং কার্যবিধির ২০৪ ধারায় আসামীদের বিরুদ্ধে প্রসেস বা পরোয়ানা ইস্যু করতে পারেন।

২) ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২ ধারা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে পারেন অথবা মামলাটি অধঃস্তন কোন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট তদন্তের জন্য পাঠাতে পারেন।

৩) ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭৩(৩-খ) ধারার বিধান অনুসারে মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য থানায় পাঠাতে পারেন।

৪) ফৌজদারী কার্যবিধির ২০৩ ধারার বিধান অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট নারাজির আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন।

নারাজি নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত

64 DLR (HCD) 91- Khorsheda Begum Vs. Monira Begum মামলার সিদ্ধান্ত বলা হয়েছে যে, যখন কোন পুলিশ রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি পিটিশন দায়ের করা হয়, তখন সেই পুলিশ রিপোর্ট আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হয়।

36 DLR (SC) 58- মামলার সিদ্ধান্ত বলা হয়েছে যে, পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে যদি নারাজির দরখাস্ত করা হয়, তবে অভিযোগকারীকে পরীক্ষা করে ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে নিতে পারেন কিংবা ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২ ধারার পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন।

29 DLR 427 মামলার সিদ্ধান্ত বলা হয়েছে যে, ফৌজদারী কার্যবিধিতে বর্ণিত বিধান মতে পুলিশ রিপোর্টের বিপক্ষে কোন ধরণের নারাজি দরখাস্ত দায়ের করা হলে তখন ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারী কার্যবিধির ২০২ ধারাতে উল্লেখিত কার্যপদ্ধতি মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।

যদি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক দাখিলীয় তদন্ত রিপোর্টের উপর সন্তুষ্ট হতে না পারেন তাহলে তিনি মামলাটি যথারীতি আমলে নেয়ার আগে পুলিশকে আরো তদন্তকার্য চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন। এমনকি এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করলেও ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আরো অধিকমাত্রায় তদন্ত করার নির্দেশ দিতে ক্ষমতাবান হবেন।

ফলে তদন্ত মোতাবেক পেশকৃত চূড়ান্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে আগেই অব্যাহতি প্রাপ্ত কোন আসামীর বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তার সাধ্যমত আরও তদন্ত কাজ চালিয়ে অতিরিক্ত অভিযোগপর দাখিল করতে কোন বাধা নেই। এভাবে আইন স্বীকৃত বিধান মতে ম্যাজিস্ট্রেট নারাজি দরখাস্ত সুষ্ঠুভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেন।

ম্যাজিস্ট্রেট প্রদত্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিকার

নারাজি দরখাস্ত অগ্রাহ্য হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির অবশ্যই প্রতিকার আছে। নারাজি দরখাস্ত ম্যাজিস্ট্রেট অগ্রাহ্য(না-মঞ্জুর) করলে অসন্তুষ্ট পক্ষ আদেশের তারিখ থেকে ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে বিজ্ঞ দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৩৯(ক) ধারা মতে রিভিশনের দরখাস্ত করতে পারেন এবং যে সকল হেতুমূলে তা করতে পারেন নিম্নে তা উল্লেখ করতে পারেন।

১) অভিযোগকারী মারাত্নক এবং অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবেন যা অর্থের দ্বারা পরিমাপযোগ্য নয়।
২) সমাজে তার মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে এবং সে চিরতরে ন্যায়বিচার থেকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে।
৩) ভবিষ্যতে অন্যায় কাজ হতে অপরাধী বিরত থাকবে, তার অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে, ভীতির সঞ্চার হবে ও চরিত্র সংশোধনের সুযোগ পাবে।

লেখক :আইনজীবী, জজকোর্ট, চট্টগ্রাম।

তথ্য কণিকা: ফৌজদারী কার্যবিধি- অ্যাডভোকেট জহিরুল হক, আইন শব্দসমূহ- অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য- গাজী শামসুর রহমান, উকিপিডিয়া, শত বছরের ক্রিমিন্যাল রেফারেন্স অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন।