প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা

দীপজয় বড়ুয়া : আইনজীবী হলেন ‘আইন ব্যবসায়ী’, যিনি একজন অ্যাডভোকেট, ব্যারিস্টার, অ্যাটর্নি, সলিসিটর বা আইনি উপদেশক। আইনজীবী মূলত আইনের তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তির বা সংস্থার আইনি সমস্যার সমাধানের কাজ করে থাকেন।

বিভিন্ন দেশ তাদের নিজ নিজ আইনি ব্যবস্থা অনুযায়ী আইনজীবীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন। ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী আইন বিষয়ে পারদর্শী এবং সনদপ্রাপ্ত যে কেউ আইনজীবী। কিন্তু স্কটিশ ভাষায় রচিত ম্যাক্স আইনে বা দক্ষিণ আফ্রিকা, ইতালিয়ান, ফরাসি, স্পেনিয়, পর্তুগিজ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, পোলিশ, ইসরায়েলিয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার আইন ব্যবস্থা অনুযায়ী অ্যাডভোকেট বলতে উচ্চতর শ্রেণির একজন আইনজীবীকে নির্দেশ করে। অ্যাডভোকেট কিছু দেশে আইনজীবীদের সম্বোধনের উপায়ও বটে। যেমন: “এড. স্যার অ্যালবেরিকো জেন্টলি।”

ব্যুৎপত্তি

অস্ট্রেলিয়ায় আইনজীবী বলতে সাধারণত সলিসিটর বা ব্যারিস্টার উভয়কেই বোঝানো হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডে ল’ইয়ার বা আইনজীবী বলতে সংরক্ষিত বা অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে আইনি সহায়তাদানকারী ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। যাদের মধ্যে ব্যারিস্টার ও সলিসিটর কেও ধরা হয়ে থাকে।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত কথায় আইনজীবী বলা হলেও আসল শব্দটি হল এ্যাডভোকেট যা এ্যাডভোকেট এক্ট – ১৯৬১ তে সংজ্ঞায়িত করা আছে। স্কটল্যান্ড এ আইনজীবী বলতে আইনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে।

ইতিহাস

প্রাচীন গ্রিসে

অতীতে ল’ইয়ার বা আইনজীবী বলেতে প্রাচীন এথেন্সে সুবক্তা, বোঝানো হত। সমস্যা হলো এথেনীয় বক্তারা তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের মামলায় নিজেরাই লড়তেন। অন্য ব্যক্তির আইনি মামলায় বন্ধু বা সহকারী হিসেবে দাঁড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। দ্বিতীয়ত অন্যের কেসে পারিশ্রমিক নেওয়ার নিয়ম ছিলনা। সেই কারণে বক্তাদের পুরোপুরি আইনি সহায়ক হিসেবে বিবেচিত করা যেতনা এথেনীয় আইন অনুসারে।

বন্ধুর সহায়ক হিসেবে বিনামূল্য আইনি সাহায্য দানের মধ্যেই এই পেশা আবদ্ধ থাকায় এদের পেশাগতভাবে লইয়ার বলা যায়না। যিনি এই কাজ ন্যায্য পারিশ্রমিকস্বরূপ পেশা হিসেবে করেন তাকেই আইনজীবী বলা যায়।

প্রাচীন রোমে

খ্রিস্টপূর্ব ২০৪ সালের আইনে রোমান আইনজীবীদের পারিশ্রমিক নেওয়ায় বাধা থাকায় আইনের প্রয়োগটিই অবহেলিত হয়। রোমান সম্রাট ক্লদিয়াসের আমলে এ বাধা উঠে যায়। ফ্রিটজ শুলজ এর মতে, চতুর্থ শতকে সাম্রাজ্যে আইনজীবীর ধারণা বদলাতে থাকে। তাদের কোনো বার বা সংগঠনে নাম নথিভুক্ত করে আদালতে সওয়াল করার পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

রোম সম্রাট লিওর নির্দেশ ছিল নতুন আইনজীবীদের নিয়ে আসতে হবে তাদের শিক্ষকদের শংসাপত্র এবং চার বছরের আইন শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন করার পরেই আদালতে পেশাজীবী হিসেবে প্রবেশাধিকার পাবেন তারা।

মধ্যযুগে

রোম সাম্রাজ্যের পতনের পর এই পেশার কিছু অবনতি হয়। জেমস ব্রান্ডেজের মতে পাশ্চাত্য ইউরোপের কাউকে সেই অর্থে পেশাদার আইনজীবী বলা যেত না। ১১৫০ সালে কিছু বাক্তি আইনে অভিজ্ঞ হন তাও বিশেষ উদ্দেশ্যে। তারা রোমান ক্যাথলিক চার্চের পুরোহিত হিসেবে কাজ করতেন। ১২৩১ সালে ফরাসি কাউন্সিল নিয়ম প্রণয়ন করে যে কেউ এই পেশায় আসার আগে, বিশপ আদালতে শপথ করতে হবে।

পেশাদারিত্ব প্রমাণ করার জন্যে প্রায় সারা ইউরোপেই নতুন নতুন আইন ও বিধিনিষেধ প্রণয়ন হতে থাকে। ইংল্যান্ডে ১২৭৫ সালে আইন পাশ করা হয় এবং অপেশাদারি ও ত্রুটির জন্যে আইনজীবীদের সাজার বিধান দেওয়া হয়।

আমেরিকা

১৭০০ সালের দিকে আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে আইনী পেশা বা আইনজীবীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সে সময়ে ইংলিশ সাধারণ আইনে পারদর্শী মানুষের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে তেমনি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের ক্ষমতা। ২১ শতকের দিকে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রী অর্জন করে এবং আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করে।

ভারত

ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ হওয়ার কারণে ভারতে কোর্ট এবং আইনজীবীর গুরুত্ব ও চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। সে সময়ে ভারতে বর্ণপ্রথার প্রচলনের কারণে বেশির ভাগ আইনজীবী আসতো উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। ফলস্বরূপ কেবল উচ্চশ্রেণির মানুষরাই এইসব আদালতে বিচার দাবি করতে পারতো। সাধারণ জনগণের তেমন কোনো সুযোগ ছিলো না।

১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী একটি ব্যতিক্রমী বিচার ব্যবস্থার প্রস্তাব করলেও তা গ্রাহ্য হয় না। অনেক চেষ্টার পরে ভারতে সাধারণ জনগণের জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তন হলেও অন্তঃকলহের কারণে এই পরিকল্পনা ব্যার্থ হয়।

বাংলাদেশ

১৯৭১ সালে পাকিস্তান হতে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে নিজস্ব সংবিধান গঠন এবং আইনী ব্যবস্থার প্রচলন হয় ( The Bangladesh legal Practitioners and Bar Council Orders & Rules,1972 )। আইনী কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র আইন বিভাগ চালু করা হয়।

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বর্তমানে বহুসংখ্যক আইনজীবী তৈরি হচ্ছে এবং বিভিন্নভাবে তারা দেশের বিচার বিভাগে তাদের অবদান রেখে যাচ্ছে।

দায়িত্ব

অধিকাংশ দেশে আইনের বিভিন্ন ধারার কাজের বিভিন্নতার কারণে আইনপেশার সাথে সংযুক্ত ব্যক্তি থাকেন যাদের আমেরিকান ধাঁচে লইয়ার বলা যায়না। এ পেশাতে আইনজীবী ছাড়াও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে মুহুরি, মোক্তার, আইন কেরানি ও জজ। নানা দেশের আইন ও তার প্রয়োগের বিভিন্নতার কারণে এই পেশার সাধারণীকৃত সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব না।

অ্যাডভোকেসি এমন একটি পেশা যেখানে কর্মের প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো ভাবেই উন্নতি সম্ভব না। সঠিক বিচার কাজে সাহায্য করা এবং দোষীকে চিহ্নিত করতে বিচারককে সহায়তা করার ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। তাই আইনী পেশাকে মহৎ পেশা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। [জেএস যাদব বনাম মোস্তফা হাজী মোহাম্মদ ইউসুফ, এআইআর ১৯৯৩, এসসি ১৫৩৫]

তবে সাধারণ ভাষায় আইনজীবী বলতে আমরা সে সকল ব্যক্তিকে বুঝে থাকি যারা আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নানা ধরনের মামলার পক্ষে-বিপক্ষে আদালতে দলিল, সাক্ষ্য ও যুক্তি পেশ করে মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেন।

তাই আইনজীবীদের কাজ সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ সম্পাদন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা তাদের একটি মিথ্যা দলিলের জন্য একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে।

এই পেশাটি একদিকে যেমন মর্যাদার অন্যদিকে তেমনি দায়িত্বেরও বটে।

শিক্ষা

বিভিন্ন দেশে আইনের শিক্ষাপ্রণালী ও যোগ্যতা বিভিন্ন প্রকার। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পঠন পাঠন হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান পরীক্ষা, উপযুক্ত সরকারি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের ল স্কুল গুলিতে পড়ানো হয় এবং আমেরিকায় বার এসোসিয়েশন বা আইনজীবী সংঘ ঠিক করে কোন ল স্কুলের ডিগ্রী গ্রহণযোগ্য ও সর্বোত্তম।

আমেরিকার মত কানাডাতে (কুইবেক বাদে) স্নাতক স্তরের আইন ডিগ্রি ল স্কুল গুলি থেকে দেওয়া হয় এবং এগুলির প্রায় সবই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। অন্যান্য সমস্ত মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে পূর্ণ সময়ের আইন শিক্ষার প্রচলন আছে। উন্নয়নশীল দেশে অবশ্য আংশিক সময়ের শিক্ষা প্রচলিত, যেখানে ছাত্রদের কাজ করা ও তার উপার্জিত অর্থে পড়াশোনা করার রীতি প্রচলিত।

ভারত

ভারতে ১৯৬১ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী অশোক কুমার সেন Advocates Act-1961] মে একটি নতুন আইন উপস্থাপন করেন এবং তা সংসদে পাশ হওয়ার মাধ্যমে দেশের আইন সংক্রান্ত বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা এবং আইন প্রয়োগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয় বার কাউন্সিলকে। যার ফলে বার কাউন্সিল পরিচালনার জন্য ভারতে আইনজীবীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

ভারতে আইনজীবী হতে হলে যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তা হলো :

• যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় (যেখান আইন বিভাগ রয়েছে) থেকে আইন ডিগ্রি অর্জন করতে হবে।
• বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
• বার কাউন্সিলের সদস্য পদ লাভের মাধ্যমেই সে দেশের একজন আইনজীবীর মর্যাদা লাভ করবে।

পাকিস্তান

পাকিস্তানে বিভিন্ন স্তরের আইনজীবী প্রথা প্রচলিত।

আইনজীবী

• যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ বছরের এলএলবি করতে হবে।
• কোনো সিনিয়র আইনজীবীর অধীনে কমপক্ষে ৬ মাস অনুশীলন করতে হবে।
• বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাশ করে সদস্য পদ লাভ করতে হবে।

হাইকোর্টের আইনজীবী

আইনজীবী হিসেবে ২ বছর কাজ করার পর একজন ব্যক্তি হাইকোর্টের আইনজীবী হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবে এবং সাক্ষাৎকারের এর পর সে যদি যোগ্য প্রার্থী হয় তবে হাই কোর্টে প্র্যাকটিসের লাইন্সেস পাবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

হাইকোর্টে ১০ বছর সফল ভাবে প্র্যাকটিসের পর একজন আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদানের যোগ্যতা অর্জন করে এবং আবেদন করার পর তা পাকিস্তান বার কাউন্সিল ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক কর্তৃক মূল্যায়নের মাধ্যমে তাকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশ

উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার পর ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আইন বিভাগে অধ্যয়নের জন্য দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এরপর ৪ বছরের এলএলবি করার মাধ্যমে সেই ব্যক্তি বার কাউন্সিলের সদস্য পদ লাভের যোগ্যতা অর্জন করে।

বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাশ করলেই সে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করতে পারে এবং ২ বছর নিম্ন আদালতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলে সে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হওয়ার লাইসেন্স লাভ করে।

পেশাগত আচরণবিধি

একজন আইনজীবীর জন্য বেশ কিছু আচরণবিধি রয়েছে যা অবশ্য পালনীয়। আইনজীবীদের আচরণবিধির প্রধান দিকসমূহ:

• একজন আইনজীবীর প্রধান দায়িত্ব তার আইন পেশা এবং নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা।
• অসাধু উপায় অবলম্বন করে কোনো কাজ করার বা নিয়োগ প্রাপ্তির চেষ্টা করবেন না।
• সর্বদা সত্যের পথে থাকবেন। কখনও মিথ্যাকে সাহায্য করবেন না।
• কোনো আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে বা তার সম্মতি ছাড়া তার মক্কেলের সাথে কথা বলবেন না।
• আইনজীবীগণ কর্ম জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনকে পৃথক রাখবেন।
• জুনিয়র আইনজীবীরা সিনিয়র আইনজীবীদের সম্মান করবেন তদ্রূপ সিনিয়র আইনজীবীগণ জুনিয়রদের সাহায্য করবেন।
• একজন মক্কেলের পক্ষে একাধিক আইনজীবী থাকলে সিনিয়র আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন।

আইনজীবীর সাথে খারাপ আচরণের ফল

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন আইনজীবী অনেক সময় নানারকম বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন যা কখনো আশা করা যায় না। অনেক সময় অনেক জায়গায় আইনজীবীদের সাথে এমন আচরণ করা হয় যা কখনো কাম্য নয়। আসুন আইনজীবীদের সাথে খারাপ আচরণ করলে কি ফল হয় উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে আলোকে জানা যাক।

AIR 1994 Lah 196 (199-200) & 46 cr.LJI(S.B) Home Rustomji Vs. Sub-Inspector Baig মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“আইনজীবীর ‘চেম্বার’ আদালতের অংশ বিশেষ হিসেবে বিবেচিত”।

DLR 1960(SC)124 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“কোন মক্কেলের পক্ষে ন্যায়বিচার না পাওয়ার ব্যাপারে আদালতের ওপর আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপট তুলে ধরার অধিকার তার নিযুক্তীয় আইনজীবীর রয়েছে”।

(1993)13BLD(AD)152-Supreme Court, High Court Division মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে আইনজীবীকে দায়ী/অভিযুক্ত কয়া যাবে না”।

P.L.D.(1962)Lahore,335 State Vs. Abdul Aziz মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,”মোকদ্দমার কোন পক্ষ অপর পক্ষের আইনজীবীর প্রতি হুমকি প্রদর্শন করলে আদালত অবমাননা হবে; কারণ এটা বিচার কার্যে বাধার শামিল”।

1975ALI L.J.41 & 1975cr.LJ659 Advocate Prag Das Vs. P.c Agrwal মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “যদি আদালত কোন মোকদ্দমা শুনানিকালে পুলিশ গার্ড ডাকেন এবং কোন যথার্থতা ছাড়াই আইনজীবীকে আদালত কক্ষ হতে বের করে দেন তবে আদালত অবমাননার শামিল”।

(1930)58 Cal. 884 Anantalal Singha Vs. Alfred Henry Watson মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,“আইনজীবীর বিরুদ্ধে তার মোকদ্দমা পরিচালনার ব্যাপারে মিথ্যা দুর্নাম রটানো যা তাকে এ মোকদ্দমা পরবর্তী পরিচালনা করতে বিব্রত করে তা আদালত অবমাননা হিসেবে চিহ্নিত হবে”।

প্রাথমিক শর্ত

বাংলাদেশে আইনজীবী হওয়ার প্রথম ও প্রাথমিক শর্ত প্রার্থীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং ২১ বছর বয়স পূর্ণ করতে হবে। এই দুটি পূর্ণ হলে এবার শুরু আপনার দ্বিতীয় ধাপ।

আইন নিয়ে পড়তে হলে কি করতে হবে

বাংলাদেশ বার কাউন্সিল রুলস এন্ড অর্ডার অনুযায়ী একজন আইনজীবী হতে হলে বাংলাদেশ সীমার মধ্যে অবস্থিত কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে হবে অথবা বার কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃত বাংলাদেশের বাইরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে ডিগ্রি থাকতে হবে যা পরবর্তীতে সমমান সার্টিফিকেট দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে। যদি ব্যারিস্টার অ্যাট ল হয়ে থাকেন তাহলে তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিতে যোগ্য।

উল্লেখ্য যে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত দুই ধরণের আইন ডিগ্রি প্রদান করা হয়। প্রথম এইস.এস.সি বা সমমান পাশের পর সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর মেয়াদী এলএল.বি(অনার্স) এবং অন্যকোন বিষয়ে ডিগ্রি বা স্নাতক পাশের পর বিভিন্ন ল কলেজ থেকে দুই বছর মেয়াদী এলএল.বি ডিগ্রি। বর্তমানে এই দুই উপায়ে আইন শাস্ত্রে শিক্ষা অর্জন করা যায়।

আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা

আইন বিষয়ে উপরে উল্লিখিত যেকোন একটি ডিগ্রি নেওয়ার পরে ও উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণ হলে যে কেউ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পিউপিলেজ রেজিষ্ট্রেশন বা শিক্ষানবিশ আইনজীবী ফরম পূরণ করে জমা দিতে পারবেন। আইনজীবী হওয়ার প্রথম প্রক্রিয়া হলো এই ফার্স্ট ইন্টিমেশন বার কাউন্সিলে জমা প্রদান।

মনে রাখা আবশ্যক যে, আবেদনকারীর জন্মের সনদের সন্তোষজনক সাক্ষ্যপ্রমাণ, অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী আইন বিষয়ে যোগ্যতার সন্তোষজনক সাক্ষ্যপ্রমাণ, আবেদনকারীর চরিত্র ও আচরণ সম্পর্কে ভালো অবস্থানরত দুজন ব্যক্তির প্রশংসাপত্র, ফরমে উল্লিখিত তথ্য সত্য ও নির্ভুল মর্মে একটি এফিডেফিট ও ছয় মাস শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করবেন এ মর্মে এমন একজন সিনিয়রের সঙ্গে (যার কমপক্ষে ১০ বছর নিয়মিত ওকালতি করার অভিজ্ঞতা আছে) একটি চুক্তি করতে হবে। আর থাকবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অনুকূলে নির্ধারিত ফির ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার প্রেরণের রসিদ।

আইন বিষয়ে স্নাতক বা অন্য কোনো ডিগ্রিপ্রাপ্তির পরীক্ষা প্রদানের পরপরই অনতিবিলম্বে উল্লিখিত চুক্তিপত্র, এফিডেভিট ও ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার প্রেরণের রসিদ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সেক্রেটারি বরাবর পাঠিয়ে দিতে হবে।

পিউপিলেজ বা ফার্স্ট ইন্টিমেশন ফর্ম পূরণ কাজ হয়ে গেলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তা জমা দিলে তারা এক কপি রিসিভ কপি যাতে সীল, স্বাক্ষর ও তারিখসহ দিবে এবং সে কপি পাওয়ার পর থেকে আপনার দায়িত্ব হলো আপনার সিনিয়র এডভোকেট যার সাথে চুক্তি করেছেন তার চেম্বারে ধারাবাহিক ছয় মাস শিক্ষানবিশকাল অতিক্রম করা। বাস্তবিকভাবে আদালতের কার্যক্রম শেখা।

অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তি পরীক্ষার ধাপসমূহ

আপনার পাঠানো পিউপিলেজ রেজিষ্ট্রেশন ফর্ম বার কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত হওয়ার দিন থেকে ছয় মাস পূর্ণ হলে বার কাউন্সিল আপনার বরাবর একটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড ইস্যু করবে। যেখানে একটা রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া থাকে।

সচরাচর বার কাউন্সিল নিজেদের নানানবিধ ব্যস্ততার কারণে রেজিষ্ট্রেশন কার্ড ডাকযোগে পাঠায় না, প্রার্থীকে সরাসরি বার কাউন্সিল অফিসে গিয়ে রেজিষ্ট্রেশন কার্ডটি সংগ্রহ করতে হয়। রেজিষ্ট্রেশন কার্ড পেয়ে গেলে আপনি আসন্ন আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষা দিতে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত।

ছয় মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পার অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির পরবর্তী তিনধাপের পরীক্ষার তারিখ জানিয়ে আপনাকে ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবারো অনেক কাগজ সংযুক্তি সাপেক্ষে আবেদনপত্র প্রেরণের জন্য জানানো হবে যাকে আমরা সেকেন্ড ইন্টিমেশন বা এপ্লিকেশন ফর এনরোলমেন্ট এজ এ অ্যাডভোকেট বলে থাকি।

বিজ্ঞপ্তি পাওয়ার পর বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অনুকূলে পরীক্ষার নির্ধারিত ফি বাবদ টাকা ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার বা ব্যাংকে বার কাউন্সিলের অ্যাকাউন্টে নগদ জমা দেওয়ার রসিদ। সিনিয়রের কাছ থেকে শিক্ষানবিশকাল সফলভাবে সমাপ্তির প্রত্যয়নপত্র।

শিক্ষানবিশকালে প্রাপ্ত মামলার পূর্ণ বিবরণসহ পরীক্ষার্থী ও সিনিয়রের স্বাক্ষর, সিলমোহর ও তারিখযুক্ত পাঁচটি দেওয়ানি ও পাঁচটি ফৌজদারি মামলার তালিকা, যার শুনানিকালে প্রার্থী নিজে তাঁর সিনিয়রের সঙ্গে আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

এসবের সাথে শিক্ষাগত যোগ্যতার সব সনদ, চারিত্রিক সনদ ও ছবিসহ আরো নানান চাহিদাকৃত কাগজপত্র দিয়ে বার কাউন্সিলে স্বশরীরে জমা প্রদান করতে হবে। সেকেন্ড ইন্টিমেশন জমা দেওয়ার পর আপনার বরাবরে এডমিট কার্ড ইস্যু করা হবে।

অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির পরীক্ষা পদ্ধতি

এডমিট কার্ড পাওয়ার পর প্রার্থীদের প্রথমে এমসিকিউ পদ্ধতিতে ১০০ নাম্বারের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে যার পাশ নাম্বার ৫০। এম.সি.কিউ পরীক্ষায় পাশ করলে প্রার্থীকে ১০০ নাম্বারের লিখিত পরীক্ষায় বসতে হবে, এই পরীক্ষার পাস নাম্বারও ৫০।

লিখিত পরীক্ষায়ও পাশ করলে শেষ ধাপে ৫০ নাম্বারের মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রার্থীকে ডাকা হবে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা এই মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্ন করে থাকেন।

মৌখিক পরীক্ষায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর অধীনে প্রার্থী যে বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তা থেকেই প্রশ্ন করা হয়। সন্তুষ্টজনক উত্তর দিতে পারলে একজন প্রার্থীকে অ্যাডভোকেট হিসেবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে সনদ প্রদান করা হয়।

প্রাথমিক বা এম.সি.কিউ পরীক্ষার বিষয় ও পূর্ণমান

মোট সাতটি বিষয়ের ওপর প্রাথমিক এম.সি.কিউ ও লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রাথমিক বা এম.সি.কিউ পরীক্ষায় দেওয়ানী কার্যবিধি থেকে ২০, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন থেকে ১০, ফৌজাদারী কার্যবিধি থেকে ২০, দন্ডবিধি থেকে ২০, সাক্ষ্য আইন থেকে ১৫, তামাদি আইন থেকে ১০, পেশাগত আচরণ, বার কাউন্সিল রুলস এবং লিগ্যাল ডিসিশন থেকে ৫ পূর্ণমানের প্রশ্ন করা হয়। সর্বমোট ১০০ নাম্বারের এম.সি.কিউ যার উত্তর প্রদান করতে হবে ১ ঘন্টা সময়ের মধ্যে।

লিখিত পরীক্ষার বিষয় ও পূর্ণমান

অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তি লিখিত পরীক্ষায় মোট ছয়টি গ্রুপ করে প্রশ্ন করা হবে। “ক” গ্রুপে দেওয়ানী কার্যবিধি ও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন থেকে তিনটি প্রশ্ন থাকবে যার মধ্যে দুইটির উত্তর দিতে হবে। এখানে প্রতি প্রশ্নের নাম্বার ১৫। “খ” বিভাগে ফৌজদারী কার্যবিধি থেকে দুইটি প্রশ্ন দেওয়া থাকে এবং একটির উত্তর দিতে হবে। এখানে পূর্ণমান ১৫।

“গ” বিভাগে দন্ডবিধি থেকে দুইটি প্রশ্ন যার মধ্যে একটির উত্তর দিতে হবে ও পূর্ণমান ১৫। “ঘ” ও “ঙ” বিভাগে যথাক্রমে সাক্ষ্য আইন ও তামাদি আইন থেকে পূর্বের মতো একইভাবে দুইটি করে মোট চারটি প্রশ্ন থাকবে এবং দুইটির উত্তর দিতে হবে। যার পূর্ণমান ১৫ করে।

সর্বশেষ “চ” বিভাগে পেশাগত আচরণ, বার কাউন্সিল রুলস এবং লিগ্যাল ডিসিশন থেকে দুইটি প্রশ্ন করা হবে, উত্তর দিতে হবে একটির যার পূর্ণমান ১০। সর্বমোট ১০০ নাম্বারের উত্তর প্রদান করতে হবে।

আইন পেশা পরিচালনা ও অ্যাডভোকেট

এম.সি.কিউ, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে আপনি একজন অ্যাডভোকেট ও কেবলমাত্র নিম্ন আদালতে আইন পেশা পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করলেন।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে অ্যাডভোকেট হিসেবে সদন অর্জনের পর আপনার কাঙ্কিত বার এসোসিয়েশনে সদস্য পদ গ্রহণ করে আপনি আপনার আইন পেশা পরিচালনা করতে পারেন।

হাইকোর্টের উকিল হওয়ার যোগ্যতা

যদি আপনি হাইকোর্ট বিভাগে আইন পেশা পরিচালনা করতে চান সেক্ষেত্রে নিম্ন আদালতে দুই বছর আইনজীবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এবং তখনি হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে সনদ নেওয়ার যোগ্যতা হবে।

এই যোগ্যতা অর্জন হলে হাইকোর্টে ১০ বছরের বেশি প্র্যাকটিস করছেন এমন একজন সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে শিক্ষানবিশ চুক্তি করতে হয়। সিনিয়র অ্যাডভোকেটের অধীনে আপনাকে এক বছর প্র্যাকটিস করতে হবে। একবছর শেষ হলে আবারো বার কাউন্সিলে হাইকোর্টে তালিকাভুক্তির পরীক্ষা দিয়ে এনরোল হতে হবে।

আপিল বিভাগে প্র্যাকটিস

একজন আইনজীবীর হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিসের বয়স পাঁচ বছর হলে এবং হাইকোর্টের বিচারপতিরা যদি তাঁকে এই মর্মে স্বীকৃতি দেন যে তিনি আপিল বিভাগে আইন পেশা পরিচালনা করার জন্য সঠিক ও উপযুক্ত ব্যক্তি, তবে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন সাপেক্ষে এনরোলমেন্ট কমিটি তাঁকে আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার সুযোগ দিয়ে থাকে।

তবে কাউকে বিশেষভাবে উপযুক্ত মনে করলে এ আনুষ্ঠানিকতা পালন ছাড়াও প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকরা তাঁকে আপিল বিভাগে প্র্যাকটিসের অনুমতি দিতে পারেন।

তথ্যকণিকা

উইকিপিডিয়া, লিগ্যাল হোম অনলাইন পোট্রাল, “NETWATCH: Botany’s Wayback Machine”। Science। 316 (5831): 1547d–1547d। ২০০৭-০৬-১৫। আইএসএসএন 0036-8075। ডিওআই:10.1126/science.316.5831.1547d।↑ Alla ricerca della via più breve। Milano: Springer Milan। পৃষ্ঠা 309–317। আইএসবিএন 978-88-470-1088-8।↑ “J.S. Jadhav vs Mustafa Haji Mohamed Yusuf”।↑ “Advocates Act-1961” (PDF)।↑ “Students lock Bar Council”। bdnews24.com। ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।

লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।