নীরবে, নিভৃতে বিস্মৃত বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ!
বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ

নীরবে, নিভৃতে বিস্মৃত বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ!

দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গতকাল। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ১৯ মার্চ, সকাল ১০টা ২৮ মিনিটে ৯২ বছর বয়সে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন প্রখ্যাত এই আইনবিদ।

আইন অঙ্গনের খ্যাতিমান ও ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে পরিচিত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আইন অঙ্গনের বাইরেও দেশের গণতন্ত্র উত্তরণে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। সর্বত্র দলীয় বিভাজন ও বিদ্বেষে অভ্যস্ত দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী চলে গেছে নীরবে, নিভৃতে; জীবন সমাপ্তির সাথে সাথে বিস্মৃত হয়েছেন তিনি ও তাঁর কর্ম!

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজনীতিক নন। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ বিধানে তাঁকে রাজনীতি ও রাজনীতিক পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে হয়েছে। তবে তিনি রাজনীতির দ্বন্দ্ব ও দলাদলি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি নিজেকে নিরপেক্ষতার এক দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের পেমই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সাহাবুদ্দীন আহমদের। তাঁর পিতার নাম তালুকদার রিসাত আহমেদ; তিনি একজন সমাজসেবী ও এলাকায় জনহিতৈষী ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ছিলেন।

শিক্ষাজীবন

সাহাবুদ্দীন নান্দাইলে তাঁর বোনের বাড়িতে বড় হন। ১৯৪৫ সালে নান্দাইলের চন্ডীপাশা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানি সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি প্রথমে লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমি এবং পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রশাসনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

কর্মজীবন

সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মজীবনে প্রথমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়।

বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তাঁর দেওয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর দেওয়া এই রায় যুগান্তকারী এবং দেশের সংবিধান পরিশোধনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। এছাড়া ঢাকা ল রিপোর্ট, বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিসন এবং বাংলাদেশ কেস রিপোর্টসে তার প্রচুরসংখ্যক রায় প্রকাশ করা হয়। চাকুরিসম্পর্কিত, নির্বাচন নিয়ে কলহ, শ্রম ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক ইত্যাদি কেসে তার গৃহীত বিচারের রায় বহুল সমাদৃত হয়।

১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। যদিও সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।

ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি

সাহাবুদ্দীন আহমেদের রাজনীতিতে আসাটা কিছুটা নাটকীয়। ১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ উপ-রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পর, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শূন্য রাষ্ট্রপতির পদে এবং নির্বাচন হবার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানরূপে কে আসীন হবেন তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারছিল না।

এক দল অন্য দলের প্রার্থীর প্রতি অনাস্থা পোষণ করছিল। অবশেষে যখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নাম এলো, তখন দুটি দলই ঐকমত্য পোষণ করল যে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন-ই একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ বাংলাদেশের ৫ম জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি আবার তার মূল পদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে যোগদান করেন।

রাষ্ট্রপতি

১৯৯৬ সালের ২৩ জুলাই তিনি আওয়ামী লীগের দ্বারা রাষ্ট্রপতির পদে মনোনয়নের পর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। যদিও সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা খুবই সীমিত, তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সততা এবং প্রজ্ঞা দ্বারা দেশের সকল স্তরের মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান জয় করেন। ১৪ই নভেম্বর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন।

মতবিরোধ

১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতি অবিচল আস্থাশীল সাহাবুদ্দীন আহমদ কখনোই সেই অধিকার প্রয়োগ করেননি। তিনি চেয়েছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হোক। তিনি দ্রুত নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও তাগিদ দিলেন। তখনো বিএনপির নীতিগত অবস্থান ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকারের পক্ষে।

তবে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ে নিয়োগসহ নানা বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মতভেদ দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করতে থাকেন।

একপর্যায়ে বিএনপি নেতা ও তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথাবার্তা বললে তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাঁর কড়া জবাব দেন। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর বিএনপি সংসদীয় পদ্ধতির শাসন প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর পদাধিকারীরাও সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। ৬ আগস্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে আগের দায়িত্বে ফিরে যান।

এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জননিরাপত্তা আইন নামের একটি বিতর্কিত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানান। সেকারণে তার সাথে তৎকালীন সরকার এবং আওয়ামী লীগের তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই সম্পর্কের আর উন্নতি ঘটেনি।

সংসদীয় পদ্ধতিতে সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি অতি সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হলেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদে সাহাবুদ্দিন আহমেদ তার নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য প্রশংসিত ছিলেন।

পরিবার

তাঁর সহধর্মিণী আনোয়ারা আহমদ ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। সাবেক এই রাষ্ট্রপতির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় মেয়ে অধ্যাপক ড. সিতারা পারভিন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। দ্বিতীয় মেয়ে শাহানা স্মিথের বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ছোট মেয়ে সামিয়া পারভীন একজন স্থপতি। তিনি বাস করেন যুক্তরাজ্যে। বড় ছেলে শিবলী আহমদ একজন পরিবেশ প্রকৌশলী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি ছোট ছেলে সোহেল আহমেদ এর সাথে ছিলেন।