সংবিধানের চোখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা!
সৌরভ গাঙ্গুঁলী

সংবিধানের চোখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা!

সৌরভ গাঙ্গুঁলী : 

“স্বাধীনতা তুমি অমর চেতনা, বীর বাঙ্গালী’র কণ্ঠ; স্বাধীনতা!

মোরা জ্বলে উঠেছি, ভেঙ্গে ফেলেছি রুদ্ধ কারা’কপাট, করেছি

নিপীড়ন- নির্যাতন-সেচ্ছাচারী’তাকে লন্ডভন্ড!”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস আমরা কম বেশি সকলেই জানি। প্রাথমিক থেকে শুরু করে নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক,  উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর মত উচ্চ পর্যায়ের স্বাধীনতা’র লিখিত গৌরবমণ্ডিত ইতিহাস আমাদের সকলেরই পড়া। পাশাপাশি অনেক লেখকগণ তাদের কলমের কণ্ঠে বাজিয়ে যাওয়া অমরগাঁথা ইতিহাসের কথাগুলোও, আমরা সকলে পড়েছি ।  তবে আজকের এই আর্টিকে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে (৭২’র সংবিধান)  গেঁথে থাকা অমর ইতিহাসের কথা। সংবিধানের চোখে বাংলার স্বাধীনতা। সংবিধান কি বলেছে স্বাধীনতা নিয়ে?  কিভাবে অর্জিত এই স্বাধীনতা?  অঙ্গীকার, আইনী পদ্ধতি ও  সাংবিধানিক বাংলাদেশের জন্মকথা!

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঘোষণার মাধ্যমে। জনগণের একত্রিত কন্ঠস্বর, উচ্চারিত স্বাধীনতা-শব্দের ঝঙ্কার বাংলার মাটিতে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করেছে।  আমরা যদি সর্বপ্রথম আমাদের ৭২’র সংবিধানে’র ‘প্রস্তাবনায়’ প্রথম অংশের দিকে তাকাই তবে আমরা খুব স্পষ্টভাবে জানতে পারবো বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাস। ‘প্রস্তাবনার’ প্রথম অংশ বলছে,

“আমরা, বাংলাদেশের জনগণ,  ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া [জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি “

প্রস্তাবনার এই অংশানুযায়ী,  আমরা স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রকে জন্ম দিয়েছি,  যা বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে পরিচিত। (প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ-১, প্রজাতন্ত্র)। আসুন এবার জেনে নেই বাংলাদেশ জন্মের পরবর্তী সাংবিধানিক ইতিহাস।

২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে তৎকালীন ১৯৭০ এর নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  স্বাধীনতা’র ঘোষণাপত্রে প্রথমাংশ বলছে,

“যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়”

এবং পরবর্তীতে সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ৭০ এর নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ’কে  ১৯৭১ সালের ৩ রা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক এসেম্বেলিতে মিলিত হবার জন্য আহ্বান করেন। কিন্তু সেই এসেম্বলিকে সফল ভাবে সম্পন্ন না করে  সেচ্ছাচারী ও বেআইনী সিদ্ধান্তে অনির্দিষ্টকালে’র জন্য স্থগিত করা হয়। বাংলাদেশ তখনও স্বাধীনতা অর্জন করেনি। স্থগিত হওয়া এসেম্বলি’র তীব্র প্রতিবাদ ও জনগণকে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ৭ ই মার্চের জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করেন। পরবর্তী’তে ২৫ মার্চের গণহত্যা আমাদের সকলেরই জানা আছে।  সংবিধানে উল্লেখিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বলছে পরদিন, ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেদিন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।

কিন্তু সব কিছুর পরেও পাঠক মহলে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে,  বাংলাদেশ স্বাধীন হলো ২৬ মার্চ, কিন্তু তখনও তো সংবিধান প্রণয়ন করা হয় নি।  তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ চলেছে কোন সাংবিধানিক আইনবলে?  প্রশ্নটির সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে  ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক জারিকৃত দুই পৃষ্ঠার  স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে।  [বলে রাখা ভালো যে, এই মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় ১৯৭০-৭১ এর ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একাংশ থেকে] স্বাধীনতা’র ঘোষণা পত্র বলছে,

”যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত  হয়েছে; সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্জাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথযথ ভাবে একটি গণপরিষদ রুপে গঠন করিলাম”

এই গণপরিষদ কেনো গঠিত হয়েছে সেটা এই অংশের পরে বুঝিয়ে বলছি। এই গণপরিষদ গঠনের সাথে সাথে একই পৃষ্ঠায় বলা হলো যে,

”সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররুপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম।”

এই অনুমোদন করবার পরেই মূলত ২৬ মার্চের ঘোষিত স্বাধীনতা আইনত বৈধতা পায়।

আমাদের মনে আরো একটি সঞ্চার হয়, সেটি হচ্ছে, ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ এর ১০ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশ কোন আইনে পরিচালিত হয়েছে?  আইনগত দিক থেকে,  ১০ এপ্রিল ঘোষিত দুই পৃষ্ঠার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের দ্বারা।  কিভাবে?  উত্তর হচ্ছে,  স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের শেষাংশে বলা হয়েছে,

”আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে,  স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে”।

বিষয়টি হচ্ছে,  স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছে ২৬ শে মার্চ, কিন্তু ১০ই মার্চে ঘোষণা পত্রটি জারি হবার দিন থেকে  কার্যকর না করে, করা হয়েছে  ২৬ শে মার্চ দিনটি থেকেই।  এই বিষয়টিকে আইনের ভাষায় বলা হয় Retrospective effect বা ভূতাপেক্ষ কার্যকরতা। এই Retrospective effect ব্যবহার করে কোনো আইনকে পূর্বের কোনো দিবস থেকে কার্যকর করা যায় যা আইনসিদ্ধ একটি প্রক্রিয়া।

আসুন এবার আমরা জেনে নেই,  সেই গণপরিষদ কেনো গঠন করা হয়েছিলো!  গণপরিষদ গঠন করা হয়েছিলো বাংলাদেশের একটি সংবিধান প্রণয়ের উদ্দেশ্যে।  আর এই গণপরিষদে অনুমোদিত স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে উল্লেখ করা হয় যে,

”সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন”

এই অংশে উল্লেখিত,’সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত’ কথাটির দ্বারা টেকনিক্যালি বাংলাদেশে একটি দুই পৃষ্টার সংবিধান চুপিসারে জন্মগ্রহণ করে। যদিও এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি নিজে থেকেই বলে নি, আমি বাংলাদেশের সংবিধান। কিন্তু একটি সংবিধানের সকল গুণাবলি থাকায়এটি কে (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করা হয়।  সংবিধানটির নাম হয়, স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র বা The Proclamation of Independence।

পরিশেষে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে আজকের মত লেখা সমাপ্ত করতে চাই, ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত  টানা ২১ মাস  এই ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’  দ্বারা দেশ পরিচালিত হয়।  পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে  ১৫৩ অনুচ্ছেদের একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান কার্যকর হলে পূর্বের দুই পৃষ্টার সংবিধান টি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

”মনে রাখবেন স্বাধীন বাংলাদেশ দুইটি সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছেঃ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (কার্যগত দিক থেকে সংবিধান) ১৯৭২ সালের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান (৭২’র সংবিধান)   আমরা বাঙালী,  সর্বস্তরের স্বাধীনতাকামী  মানুষ সেদিনে’র জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামে গাঁথা অমর চেতনা ভুলি নি। হৃৎস্পন্দনে’র অলিন্দদ্বয় ভুলে যায় নি তোমার সাহসি রক্তমাখা পিন্ডে মোড়ানো, বাংলার সবুজ ঘাসের উপর লাল রক্তের অঙ্কিত পতাকা’র চিত্র!

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।