হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সারসংক্ষেপ
অ্যাডভোকেট অভিজিৎ কর্মকার

ভুবন বিখ্যাত যাঁরা আইনের শিক্ষার্থী ও আইনজীবী ছিলেন

অভিজিৎ কর্মকার: অষ্টাদশ শতকের ইউরোপকে Age of reason বলা হতো। ওই সময়ে সবচেয়ে সম্মানের পেশা ছিল আইন পেশা৷ ইউরোপজুড়ে তখন অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েদের আইন পড়ানোর জন্য পিতামাতার প্রবল ঝোঁক ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশেও একসময় আইন পড়ার ও আইনপেশার কদর ছিল অনেক বেশি। ফলে সম্ভ্রান্ত ও জমিদার পরিবারের সন্তানদের আইন বিষয়ে পড়ানোর জন্য পিতামাতারা আগ্রহ বোধ করতেন।

এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিলেতে আইন বিষয়ে পড়তে যাওয়া এবং মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিলেতে আইন পড়া। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। মজার ব্যাপার হল, আইনপেশায় যুক্ত হওয়ার জন্য জীবনানন্দ দাশও আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, পৃথিবীর ইতিহাসের বাকবদলকারী অনেক রাজনীতিবিদ এবং প্রথিতযশা সাহিত্যিক আইন বিষয়ে অধ্যায়ন করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি আইনপেশার সাথে নিযুক্ত হয়ে বিচারালয়ে আইনপেশা অনুশীলন করেছেন।

কলকাতার জোড়াসাঁকোর সম্ভ্রান্ত ঠাকুর পরিবারের ছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ১৮৭৮ সালে ১৭ বছর বয়সে বিলেতে পাঠানো হয় ব্যারিস্টারি পড়ানোর জন্য। (কথিত আছে রবি ঠাকুর ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে আইন বিদ্যা নিয়ে ভর্তি হন। আবার এরূপটি দাবি করা হয় তিনি লন্ডনের ব্রাইটন কলেজে আইন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু এর স্বপক্ষে জোরালো কোন তথ্য-প্রমাণ নেই। ব্রাইটন কলেজের রেজিস্ট্রার খাতায়ও রবি ঠাকুরের নাম পাওয়া যায়নি।) রবি ঠাকুর আইন বিষয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কি হননি এর পক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ না পাওয়া গেলেও তিনি বার- অ্যাট-ল করতে বিলেত গিয়েছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলা সাহিত্যের উনিশ শতকের নবজাগরণের মানসপুত্র মধুসূদন দত্ত ঈশ্বরচন্দ্রের অর্থায়নে আইন পড়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে শেষ দিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত আইন পড়ার জন্য ইংল্যান্ড আসেন এবং ১৮৬৬ সালে লন্ডনের গ্রেইট ইন থেকে বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি নিয়ে; ১৮৬৭-১৮৭০ সাল অব্দি ৩ বছর কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা চর্চা করেন।

এরপর আইন পেশা বাদ দিয়ে ২ বছর এক হাজার টাকা মাসিক বেতনে কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষক হিসাবে কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুনরায় আইন পেশায় নিযুক্ত হন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পিতা রাজনারায়ন দত্ত তিনিও একজন আইনজীবী ছিলেন। মধুসূদন দত্তের পিতা রাজনারায়ণ দত্ত অধস্তন আদালতের নামকরা আইনজীবী হলেও মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আইনজীবী হিসাবে সফলতা পাননি।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন বিষয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলে তিনি সেখানে ভর্তি হন এবং বি.এ পাশ করে তৎকালীন যশোহর জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে প্রথম কর্ম জীবন শুরু করেন।

জীবনানন্দ দাশ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে ১৯২১ সালে ইংরেজি সাহিত্য এম.এ পাশ করার পর আইন পড়ার জন্য একটি আইন কলেজে ভর্তি হন। কিছু দিন পড়াশোনা করে চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনি অংশগ্রহণ না করেই আইন পড়ায় ইস্তফা দেন। বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রেঙ্গুনে থাকাকালীন আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।

জীবনানন্দ দাশ পরীক্ষা না দিয়ে আইন পড়ার পাঠ চুকালেও শরৎচন্দ্র আইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু আইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি কৃতকার্য হতে পারেননি। কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো তিনিও আইনজীবী হিসাবে আইন ব্যবসায় নিজেকে নিযুক্ত করতেন।

ব্যোমকেশ বকশীর স্রষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও তাঁর পিতার ইচ্ছায় আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে পাশ করার পর তাঁর পিতা আইনজীবী তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে কিছু কাল কোর্টে আইনজীবী হিসাবে আইন পেশা অনুশীলন করেন।

অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা রোবেন দ্বীপে ২৭ বছর কারাবাস জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে প্রথম জীবনে জোহানসবার্গ কোর্টে আইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। আইনজীবী থাকা অবস্থায় তিনি আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

সত্যগ্রহ, অসহযোগ আন্দোলনের অগ্রনায়ক ভারতের জাতিরজনক মহাত্মা গান্ধী ১৮৮৮ সালে আইন পড়ার জন্য বিদেশ গমন করেন। বিলেত থেকে আইনশাস্ত্রে স্নাতক করার পর ভারতবর্ষে ফিটে এসে কিছুদিন তিনি ওকালতি করেন। এরপর ১৮৯৩ সালে ১ বছরের চুক্তিতে Legal service এর কন্ট্রাক্ট পেয়ে সাউথ আফ্রিকাতে চলে যান।

পাকিস্তানের জাতির জনক মোহম্মদ আলী জিন্নাহও লিংকন ইন থেকে বার-অ্যাট-ল পাশ করে আইনজীবী হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কথিত আছে, আইনজীবী হওয়ার প্রথম দুইবছর তিনি না’কি কোন মামলা পাননি। তবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসাবে সফল ব্যক্তি ছিলেন।

পাকিস্তানের ৫ম প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯১১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইনের ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি বিসিএল পাশ করেন। এরপর ১৯২০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন।

বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইসলামিয়া কলেজ হতে বি.এ পাশ করার পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধুর পিতার ইচ্ছা ছিল তাঁর সন্তান একজন আইনজীবী হবেন।

১৯৪৭ সালে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু আইন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবিদাওয়া সম্পর্কিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করেন। ১৫ টাকা জরিমানা সহ পুনরায় এরূপ কার্যে অংশগ্রহণ করবে না এই মর্মে বন্ড সই দেওয়ার শর্তসাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিলেও তিনি শর্ত মেনে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখান করেন।

কল্পকাহিনী লেখক জুল ভার্ন ছিলেন আইনজীবী। যদিও তিনি এই পেশায় থিতু হননি কিন্তু প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। জগতবিখ্যাত কার্ল মাক্সের বাবা পেশায় ছিলেন আইনজীবী। কার্ল মাক্সের বাবার ইচ্ছা ছিল তাঁর ছেলেও বড় হয়ে তাঁর মতো একজন আইনজীবী হবেন। কার্ল মাক্স আইন নিয়ে বার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর সেখানে ঝামেলা বাঁধিয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে ফের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু দর্শন শাস্ত্রের ওপর প্রবল ঝোঁক থাকায় শেষমেশ তিনি আইনজীবী হতে পারেননি।

প্রথিতযশা লেখক মার্কেসের বাবা চাইতেন বড় হয়ে তাঁর ছেলেও আইনজীবী হোক। মার্কেস তাঁর পিতার ইচ্ছায় কলোম্বিয়ার বোগতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। চিন্তানায়ক, দার্শনিক মহামতি ফ্রান্সিস বেকনও পেশায় ছিলেন আইনজীবী। ইংল্যান্ডের আদালতে তিনি আইন পেশা অনুশীলন করেছেন।

ওয়ার অ্যান্ড পীসের লেখক লিও তলস্তয়ও কাজান বিশ্ববিদ্যালয় আইন পড়তে পাঠানো হয়েছিল। জগতবিখ্যাত ভলতেয়ারের পিতা ছিলেন একজন যশস্বী আইনজীবী। ছেলে বড় হয়ে বাবার মতো আইনপেশায় নিয়োজিত হোক এজন্য তাকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ভলতেয়ার আইন পড়া শেষ করেননি৷

আমেরিকার সবচেয়ে সফল প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, ভারতের সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু, আয়রন লেডি মার্গারেট থ্যাচার, আমেরিকার সাবেক মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটন, ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, চিত্ত রঞ্জন দাস প্রমুখ আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। চিত্ত রঞ্জন বসু যিনি সি.আর দাস নামে অধিক পরিচিত তিনি আইনজীবী হিসাবে যেমন সফল ছিলেন তেমনি রাজনীতিবিদ হিসাবেও ছিলেন সফল মানুষ।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে তিনজন ব্যতীত সকলেই আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন৷ বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৫৩ সালে এলএল.বি পাশ করে ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহ কোর্টে আইনজীবী হিসাবে যোগদান করেন। দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর প্রথমে কলকাতা হাইকোর্ট আইন ব্যবসা শুরু করেন। এরপর ১৯৪৮ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে যোগদান করেন।

এছাড়া রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, আব্দুর সত্তার, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, আ ফ ম আহসান উদ্দীন চৌধুরী, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, বাংলাদেশের ১৯ তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং নবনিযুক্ত বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সকলেই আইনজীবী ও আইনের ছাত্র।

আওয়ামিলীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অনলবর্ষী বক্তা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সংবিধান সর্ম্পকে যাঁর জানার পরিধি ঈর্ষনীয়। তিনিও একসময় মহামান্য হাইকোর্ট আইনজীবী হিসাবে আইন পেশা চর্চা করেছেন।

ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কট এডিনবারা কোর্টে আইনজীবী হিসাবে আইনপেশা অনুশীলন করেছেন৷ তাঁর পিতাও ছিলেন একজন আইনজীবী। বাংলা গদ্য সাহিত্যে চলিত রীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরীও ছিলেন আইনের শিক্ষার্থী। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাস করার পর আইন পড়তে বিদেশ যান এবং বার-অ্যাট- ল শেষ করে দেশে ফিরে আসেন।

একজন আইনের শিক্ষার্থী এবং আইনজীবী হিসাবে নিজের জানার আগ্রহ থেকেই মূলত এই লেখার প্রয়াস পেয়েছি। “ভুবন বিখ্যাত যাঁরা আইনের শিক্ষার্থী ও আইনজীবী ছিলেন” এই তালিকা আরো দীর্ঘ হবে। উপর্যুক্ত লেখায় যাঁদের নাম এসেছে এই নামগুলোর বাহিরেও আরো অনেকের নাম আছে, যাঁরা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং আইনজীবী হিসাবে বিচারালয়ে আইনপেশা অনুশীলন করেছেন।

লেখক : অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, ঢাকা