প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

প্যারোলের আদ্যোপান্ত

দীপজয় বড়ুয়া: প্যারোল শব্দের অর্থ হলো, শর্তের অধীনে মুক্তি প্রদান করা। বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথম প্যারোল সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করে ২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। পরবর্তীতে ২০১০ সালের ৪ মার্চ আরেকটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সর্বশেষ গত ২০১৬ সালের ০১ জুন প্যারোলে মুক্তির আইন প্রণয়ন করে, এতে পূর্বের নীতিমালাগুলো বাতিল করে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেন যা অদ্যাবধি কার্যকর রয়েছে।

এই “প্যারোল” (Parole) শব্দটি মূলত এক ধরনের আইনগত পরিভাষা। যার অর্থ দাঁড়ায়, নির্দিষ্ট কোন শর্তসাপেক্ষে একজন আসামীকে মুক্ত স্থানে চলাচল করার সুযোগ দেয়া। সাধারণ অর্থে অপরাধীর সংশোধন ও পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থার একটি আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হচ্ছে প্যারোল (Parole)। এটি হচ্ছে এমন এক সংশোধনমূলক কার্যক্রম যেখানে অপরাধীকে কারাগারে কিছুদিন শাস্তিভোগের পর সাজার নির্দিষ্ট সময়কাল অতিক্রান্ত হবার পূর্বে শাস্তিদান স্থগিত রেখে তাকে প্যারোল কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে শর্তসাপেক্ষে সাময়িকভাবে মুক্তি দেয়া।

প্যারোল নিয়ে আদালত ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত

Parole শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ফারসি ভাষা থেকে যার অর্থ প্রতিশ্রুতি। Parole শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন বোষ্টনের Dr.S.G. Howe- ১৮৪৬ সালে। তিনি মূলত Conditional Release বা শর্তাধীনে মুক্তি হিসেবে প্যারোল শব্দটি ব্যবহার করেন। যে ব্যক্তি প্যারোলে মুক্তি পায় তাকে প্যারোলি (Parolee) বলা হয়।

Prof. J.W. Gillin এর মতে, “Parole as the release from a penal or reformative institution of an offender who remains under the control of correctional authorities, is an attempt to find out whether he is fit to live in the free society without supervision”.

অপরাধবিজ্ঞানী Donal Taft বলেন, “Parole is a release from prison after part of the sentence has been served, the prisoner still remaining in custody and under stated conditions until discharged and liable to return to the institution for violation of any of these conditions”. অর্থাৎ প্যারোল হচ্ছে কোনো কয়েদিকে কিছুদিন শাস্তিভোগের পর কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া, যেখানে অব্যহতি না পাওয়া পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে তিনি হেফাজতেই থাকেন এবং এই শর্তগুলো লঙ্ঘন করলে কারাগারে প্রত্যাবর্তনযোগ্য।

AIR 1987 SC 1383- ভারতের সুপ্রীম কোর্ট Smt. Poonam Lata Vs. Wadhawan & Others মামলায় অভিমত দেন যে, “Parole is a grant of partial liberty or lessening of restrictions to a convict prisoner but release on parole does not, in any way change the status of the prisoner” অর্থাৎ প্যারোল হচ্ছে কোনো সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির আংশিক স্বাধীনতা মঞ্জুর বা সীমাবদ্ধতা হ্রাস করা, কিন্তু প্যারোলে মুক্তি কোনভাবেই বন্দীর মর্যাদা পরিবর্তন করে না।

(2002) 2 SCC(cri) 504-Avtar Singh Vs. The State of Haryana নামক অপর এক মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট অভিমত দেন যে, “Generally speaking, the act of granting parole is an administrative action and parole is a form of temporary release from prison custody, which does not suspend the sentence of the period of detention but provides conditional release from the prison and changes the mode of undergoing the sentence”.

প্যারোলের উদ্দেশ্য

আধুনিক অপরাধবিদ্যায় প্যারোলকে (Parole) অপরাধ সংশোধনের একটি অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো কারাগারের সংখ্যাধিক্য রোধ করা এবং অপরাধীদের সংশোধন ও পুনর্বাসন করা। প্যারোলের উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নরূপ-

১। প্যারোল ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধীদের এমনভাবে সংশোধন করা যাতে তারা সমাজে ভালভাবে থাকতে পারে
২। অপরাধীদের প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে উক্ত অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটানো থেকে তাদের নিবৃত্ত করা।
৩। অপরাধীকে কারাভোগ করানোর পর প্যারোলে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয় তখন সে সমাজে নিজে আর অপরাধ করে না এবং কেউ করলেও তাকে বাধা প্রদান করে। ফলে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়।
৪। প্যারোল ব্যবস্থা অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় কারারোধ থেকে দূরে রাখে।
৫। সমাজকে ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষা করা এবং আইন মেনে চলার জন্য প্যারোল ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
৬। মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদিদের সামাজিকীকরণে সহায়তা করা প্যারোলের অন্যতম উদ্দেশ্য।

প্যারোল নীতিমালা

উক্ত আইনটি আমাদের বাংলাদেশে ২০১৬ সালে কার্যকর করা হয়েছে এবং এই বিশেষ আইনটি সরাসরি স্বরাষ্ট্র প্যারোলে মুক্তি বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ১ জুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এ নীতিমালাটিতে বলা হয়েছে-

ক. ভিআইপি বা অন্যান্য সকল শ্রেণীর কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকটাত্মীয়ের যেমন বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি এবং আপন ভাই-বোন মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া যাবে।
খ. ভিআইপি বা অন্যান্য সব শ্রেণীর কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ কিংবা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া যাবে, তবে উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করে দেবেন।
গ. বন্দীকে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরাধীনে রাখতে হবে।
ঘ. মুক্তির সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার অধিক হবে না, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।
ঙ. কোনো বন্দী জেলার কোনো কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক থাকলে ঐ জেলার ভেতরে যেকোনো স্থানে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবে। অপর দিকে কোনো বন্দী নিজ জেলায় অবস্থিত কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক না থেকে অন্য জেলায় অবস্থিত কোনো কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক থাকলে গন্তব্যের দূরত্ব বিবেচনা করে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবে, তবে উভয় ক্ষেত্রেই দুর্গম এলাকা, যোগাযোগব্যবস্থা, দূরত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর কিংবা নামঞ্জুরের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।
চ. কারাগারের ফটক থেকে পুলিশ প্যারোলে মুক্ত বন্দীকে বুঝে নেয়ার অনুমোদিত সময়সীমার মধ্যেই পুনরায় কারাগারে পাঠাবে।
ছ. সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে।

নীতিমালাদৃষ্টে স্পষ্ট প্রতিভাত সরকার সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তিকে বিশেষ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। এটি সম্পূর্ণরূপে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী সিদ্ধান্তের একটি বিষয় এবং আদালতের কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।

তবে কোন কারনে যদি একজন আসামী তার নিজ জেলা থেকে অন্য জেলার কয়েদি হিসেবে থাকেন। তাহলে তার প্যারোলে মুক্তির সময় বিবেচনা করা হবে। কারাগার এর মূল ফটকে প্যারোলে মুক্তি পাওয়া আসামীকে পুনরায় নির্দিষ্ট সময় এর মধ্যে পুলিশ সেই আসামীকে পুনরায় কারাগারে প্রেরণ করবে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক একজন আসামীকে প্যারোলে মুক্তি প্রদানে বিবেচিত হবেন।

প্রবেশন ও প্যারোল এক নয়

অনেক সময় আমরা প্রবেশন ও প্যারোল এই দুটো বিষয় কে এক করে ফেলি। কিন্তু আদতে এই দুটো বিষয় এক নয়। যখন কোন একজন আসামী বা কয়েদির নির্দিষ্ট সাজা পূর্ণ হওয়ার আগে। সেই আসামীর ভালো ব্যবহার এর কারণে মুক্তি প্রদান করা হয়। তখন তাকে আইনের ভাষায় বলা হবে, প্রবেশন। সাধারণ অর্থে বলা যায় যে, যখন কোন একটি আসামী বা কয়েদি কে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শর্ত সাপেক্ষে পুলিশ এর নজরদারী তে মুক্তি প্রদান করা হয়। তখন আইনের ভাষায় তাকে বলা হয়, প্রবেশন।

প্রবেশন ও প্যারোল এর মধ্যে পার্থক্য

১। প্রবেশন বলতে কোন অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে, কারারুদ্ধ না রেখে বা কোন প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ প্রদান করাকে বোঝায়। অন্যদিকে, একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামী কে নির্দিষ্ট কারণে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আইনের নজরদারিতে সাময়িক সময় এর জন্য মুক্তি প্রদান করা হয়।
২। প্রবেশন প্রক্রিয়াতে একজন আসামী কে কারাগারে প্রদান করা হয়না। বরং আদালতের বাইরে থেকেও সেই আসামীকে আদালত এর বিশেষ বিধিনিষেধ গুলো মেনে চলতে হয়। অন্যদিকে, প্যারোল এর দিক থেকে একজন আসামীর মুক্তির আগের সময়কে বোঝানো হয়। যেখানে একজন আসামীকে দেওয়া নিয়ম অমান্য করলে তাকে পুনরায় আটক করা হয়।
৩। প্রবেশন হলো আসামীদের কারাগারে বন্দি করার বিকল্প একটি উপায়। অন্যদিকে, প্যারোল হলো, একজন আসামীকে কারাগার এর মধ্যে বন্দি করে রাখার বিকল্প একটি উপায়।
৪। একজন আসামীর আচরনগত দিক বিবেচনা করে আদালত কর্তৃক জরিমানা কে প্রবেশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অন্যদিকে, প্যারোল এর মাধ্যমে একজন আসামী তার স্থায়ী বা সমসাময়িক বন্দি থেকে মুক্তি পায়।

প্যারোল এবং জামিন ভিন্ন বিষয়

প্যারোল এবং জামিন দুটি ভিন্ন বিষয়, যদিও এই দুইইয়ের উদ্দেশ্যে হচ্ছে বন্দীর মুক্তি প্রদান করা। নিম্নে প্যারোল এবং জামিনের কতিপয়

প্যারোল ও জামিনের পার্থক্য

১. আবেদনের শর্ত : জামিন হলো কেউ যদি মামলার আসামী হয়ে থাকেন বা আসামী হয়ে আটক হয়ে থাকেন তখন তিনি আদালতে জামিনের আবেদন করতে পারবেন। অন্যদিকে প্যারোল তখনই দেওয়া হয় যখন আসামী ইতোমধ্যেই আটক হয়ে কারাগারে আছেন কিন্তু বাইরে এমন কিছু ঘটলো যাতে তিনি বিধি মোতাবেক প্যারোল আবেদনের যোগ্য হন তাহলে তিনি আবেদন করতে পারেন।
২. অনুমোদন : জামিন হয় আদালতের নির্দেশে, কিন্তু প্যারোল হয় প্রশাসনিক আদেশে।
৩. জিম্মা : জামিন পাওয়া ব্যক্তি বাইরে স্বাধীন থাকবেন। তিনি কোনো আদালত বা পুলিশের জিম্মায় থাকবেন না। অপরদিকে প্যারোল পাওয়া ব্যক্তি পুরো সময় পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকেন।
৪. হাজিরা ও জেল : জামিনে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তি নির্ধারিত দিনে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী হাজিরা দেন। আর প্যারোল পাওয়া ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময় পর পুলিশ কারাগারে নিয়ে আসবে।

উদাহরণ

যদি কারাবন্দী ব্যক্তির পরিবারের কোন সদস্য কিংবা কোন নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলে একজন বন্দী প্যারোলে মুক্তির আবেদন জানাতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলে তিনি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বাইরে যাবেন, কিন্তু পুরো সময় তিনি পুলিশের কাস্টডিতে (হেফাজতে) থাকবেন। পুলিশ তাকে স্কট করে রাখবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, প্যারোল অর্থ হলো, শর্তের অধীনে অপরাধীর সংশোধন ও পুনর্বাসনমূলক মুক্তি প্রদান করা। প্যারোল তখনই দেওয়া হয় যখন আসামী ইতোমধ্যেই আটক হয়ে কারাগারে আছেন কিন্তু বাইরে এমন কিছু ঘটলো যাতে তিনি বিধি মোতাবেক প্যারোল আবেদনের যোগ্য হন তাহলে তিনি আবেদন করতে পারেন।প্যারোল হয় প্রশাসনিক আদেশে।

তথ্য কণিকা: প্রবেশন ও প্যারোল আইন- সাইফুল ইসলাম, ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক,ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, উকিপিডিয়া, জামিন বিষয়ক আইন- এডভোকেট মোসলেম উদ্দিন খান, ক্রিমিনাল ড্রাফটিং এন্ড প্র্যাকটিস এবং জামিন আইন-পি এম সিরাজুল ইসলাম।

লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।