সিভিল কোর্টে মামলা চলমান থাকলে এডিএম কোর্টে মামলা চলে কিনা?
অ্যাডভোকেট সাব্বির এ মুকীম

চেকের মামলায় আসামিপক্ষে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ রায়

সাব্বির এ মুকীমসংক্ষেপে বলা যায় যে, নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট ১৮৮১ মোতাবেকই – চেকের মামলায় কনসিডারেশন পরিশোধ হয়নি- এ তথ্য প্রমাণ হলে সে আইনের ১৩৮ ধারায় অভিযুক্ত খালাস পাবে। বহুদিন ধরে ভুলে থাকা এ নীতিটি সম্প্রতি ২০১৭ ইং সনের ৬৩-৬৬ নং ফৌজদারী আপিল  এর যৌথ রায় যা আবুল কাহের শাহিন মামলার রায় হিসেবে সহজে পরিচিত; 25BLC(AD)(2020)115 তে প্রকাশিত সে রায় এ মহামান্য আপিল বিভাগ বিস্মৃতির অন্তরাল হতে তুলে এনে সেই কনসিডারেশন নীতি সু-প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবুল কাহের শাহিন মামলায় ১৩৮ ধারা প্রয়োগ এ চুক্তির গুরুত্ব সুস্পষ্ট হয় তবে সেই রায়ে আপিল বিভাগ সংশ্লিষ্ট মামলায় পক্ষগণের দাখিলকৃত কাগজপত্র দের উপর নির্ভর করেছিলেন ।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারক বিচারপতি মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী ২০২১ সালের ১১৪৪ নং ফৌজদারি আপিল মামলায় প্রদত্ত রায় এ হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন চেকের মামলায় জেরা জবানবন্দি ব্যবহার করে কিভাবে তর্কিত চেক এর ক্ষেত্রে কনসিডারেশন ছিলো কি ছিলো না এই প্রমাণ বের করা যায়।

ঘটনার বিবরণ

ফরিয়াদির নালিশ

সিলেটের ‘রুহি জুয়েলার্স’ এর মালিক জনাব মানিক খান ফরিয়াদি হয়ে সিলেটের মুখ্য বিচারিক হাকিমের ১ম আদালতে সিলেটের আইনজীবী এডভোকেট এ এইচ এরশাদুল হক এর বিরুদ্ধে এন আই এক্ট ১৩৮ ধারায় আনীত নালিশে ২০১০ সালের ৩৫৩ নং সিআর মামলা দায়ের করেন। ফরিয়াদির অভিযোগ সংক্ষেপ হলো অভিযুক্ত এরশাদুল হক তার কাছ থেকে ১মাসের মধ্যে ফেরৎ প্রদানের শর্তে  ৫ লাখ টাকা ধার নেন। পরে এরশাদুল হককে ধার পরিশোধ করতে বললে তিনি তালবাহানা করে ঋণ অপরিশোধিত রাখেন। ঘটনা প্রবাহের এক পর্যায়ে এরশাদুল হক ঋণ পরিশোধ এর মাধ্যম হিসেবে তর্কিত চেকটি ফরিয়াদি মানিক খান কে প্রদান করেন- যা নগদায়ন করতে গেলে প্রত্যাখ্যাত হয়।

২০১৩ সালের ২৮৮১ নং ধারা মামলা হিসেবে উক্ত নালিশটি সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতে বদলি হয় বিচারের রায় অভিযুক্তের ১ বছর সাজা এবং ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশনে ২০১৮ সালের ৯৬০ নং ফৌজদারি রিভিশন দায়ের করেন। বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন মামলাটি পুনরায় বিচারের জন্য রিমান্ডে বিচারিক আদালতে ফেরত পাঠানোর আদেশ দেন। পুনর্বিচার কালে বিজ্ঞ বিচারক আদালত অভিযুক্ত পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

২য় বার বিচারের রায় এ আবারো পূর্বের প্রদত্ত সাজার রায় বহাল থাকে। এই সাজার রায়ের বিরুদ্ধে মামলার অভিযুক্ত আলোচ্য ফৌজদারি আপিলটি দায়ের করেন। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রায় কোন প্যারা নাম্বারিং প্রদান করা হয়নি। তাই প্রকাশিত পিডিএফ আকারে রায়ে প্রাপ্ত পৃষ্ঠা নম্বর অনুসরণ করে এই আলাপটি লেখা হয়েছে। [ রায়ের লিংক- https://www.supremecourt.gov.bd/resources/documents/1817323_cra1144202111.pdf]

অভিযুক্তের সাফাই

অভিযুক্তপক্ষের উপস্থাপিত ঘটনার বিবরণ হলো অভিযুক্ত আইনজীবী এরশাদুল হক সিলেট জেলা জজ কোর্টের সাবেক গভর্মেন্ট প্লিডার তথা সরকারী কৌঁসুলি। তিনি প্রচুর অর্থঋণ মামলা করেন। কাজের সুবিধার্থে কোর্ট ফি অগ্রীম কিনে রাখার কৌশল রাখেন। সে নিমিত্তে তিনি তার চেম্বারে কিছু খালি বা ব্ল্যাংক চেক রাখেন, যাতে কেবল তাঁর স্বাক্ষর করা থাকে। মামলার প্রয়োজন মোতাবেক তার ক্লার্ক বা মুহুরী সেসব চেক ব্যবহার করে কোর্ট ফি খরিদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদন করত। তার দুজন মুহুরী ছিল- যাদের নাম সাধন এবং শেখ আহমদ- যারা সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আইনজীবী এরশাদুল এর সাথে প্রতারণা করে । এই দুই মুহুরীর সাথে যোগসাজশ করে মূল মামলার ফরিয়াদি মানিক তর্কিত চেক হাসিল করে। আইনজীবী এরশাদুল সেই মুহুরী সাধনের নামে সিলেট আইনজীবী সমিতিতে লিখিত অভিযোগ ও দাখিল করেছিলেন । [রায়ের ৫ম পৃষ্ঠা]

অভিযুক্তের পক্ষে ঘটনার বিবরণ অভিযুক্তের পক্ষে হাইকোর্টে উপস্থাপিত যুক্তি

বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশনের ২০২১ সালের ১১৪৪ নং ফৌজদারি আপিল শুনানি কালে অভিযুক্ত পক্ষের অভিযুক্ত নিযুক্ত আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুদীপ্ত অর্জুন নিম্নলিখিত যুক্তি উপস্থাপন করেন। [রায়ের ৫ম পৃষ্ঠা, শেষ প্যারা]

(১) ফরিয়াদি তর্কিত চেক আদান প্রদান কালে কনসিডারেশন এর আদান প্রদান প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন;

(২) অভিযুক্ত ফরিয়াদির নিকট থেকে ধার নিয়েছেন এই তথ্য নালিশে উল্লেখ করলেও ফরিয়াদি তার নালিশের কোথাও বলতে পারেন নাই ঠিক কত তারিখে অভিযুক্ত সেই কথিত ধার অভিযুক্ত নিয়েছে;

(৩) অভিযুক্ত তার কথিত ঋণ পরিশোধ কল্পেই- ফরিয়াদিকে তর্কিত চেকটি প্রদান করেছেন- এটা ফরিয়াদি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন

ফরিয়াদি পক্ষে হাইকোর্টে উপস্থাপিত যুক্তি

(১) ১১৮ ধারা মোতাবেক কনসিডারেশন প্রমাণিত

(২) অভিযুক্ত তর্কিত চেকে তার স্বাক্ষর স্বীকার করেছেন। [রায়ের ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা]

বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশনের ধার্যকৃত বিচার্য বিষয় সমূহ

বিজ্ঞ আদালত হাইকোর্ট ডিভিশন দুটি বিচার্য বিষয় নির্ধারণ করেন। [রায়ের ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠা, ৩য় প্যারা]

(১) ১৩৮ ধারার সব উপাদান ফরিয়াদি পক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছেন কিনা?

 উত্তর: না, ফরিয়াদি পক্ষ ১৩৮ ধারার অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন।

(২) অভিযুক্ত ১১৮ ধারায় অনুমান খন্ডন তথা রিভার্স অনাস করতে পেরেছেন কিনা?

উত্তর: হ্যাঁ, অভিযুক্ত ১১৮ ধারায় অনুমান খন্ডন করতে পেরেছেন।

তবে আলোচ্য রায় এর সার্বিক পাঠ এ আরো ৩টি বিচার্য বিষয় বিজ্ঞ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কতৃক পরোক্ষভাবে নির্ধারণ হয়েছে মর্মে অনুভব করা যায়, যথা-

(৩) ১১৮ ধারার অনুমান খন্ডনের দায় কি অভিযুক্ত নির্দোষ নীতির চেয়ে বেশি প্রভাবশালী?

উত্তর: না। নিঃসন্দেহে দোসী প্রমাণের আগতক অভিযুক্ত নির্দোষ অনুমান নীতি অভিযুক্ত মৌলিক অধিকার এর আওতাভুক্ত।[রায়ের ৯ম পৃষ্ঠা, শেষ প্যারা]

(৪) এন আই এক্ট এর মামলায় অভিযুক্ত নির্দোষ নীতি প্রযোজ্য কিনা?

উত্তর হ্যাঁ না একটা মামলায় অভিযুক্ত নির্দোষ অনুমান নীতি প্রযোজ্য মামলার ফলাফল [রায়ের ১৫তম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা]

(৫)ব্ল্যাংক চেক বা নাম, টাকার পরিমান, তারিখ ইত্যাদি না লিখে কেবল মাত্র স্বাক্ষরিত চেক দিয়ে এন আই এক্ট এর ১৩৮ ধারায় প্রতিকার চাওয়া যাবে কীনা?

উত্তর: না।  [রায়ের ১২তম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা]

মামলার ফলাফল

সার্বিক দিক বিচার বিশ্লেষণ এর মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন আপিলটি মঞ্জুর করেন এবং  বিচারিক আদালতের সাজার রায় বাতিল করে অভিযুক্তকে খালাস দেন। [রায়ের ২১তম পৃষ্ঠা]

ফরিয়াদির নালিশ, জবানবন্দি, সাফাই সাক্ষীকে জেরাতে প্রাপ্ত ত্রুটি

আলোচ্য মামলায় ফরিয়াদি- (i) যে লিখিত নালিশ দাখিল করেছেন, (ii) পি ডাব্লিউ ১ হিসেবে যে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন কিংবা (iii)পরে সাফাই সাক্ষীকে যে জেরা করেছেন- এসব কিছুর সার্বিক বিবেচনায় তাতে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন মোটামুটি ৯টি ত্রুটি  খুঁজে পেয়েছেন মর্মে আলোচ্য রায় পাঠে অনুভব হয়। সে সকল ত্রুটি সমূহ সংক্ষেপে নীচে তুলে ধরা হলো।

(১) ফরিয়াদি নালিশি বলেছে অভিযুক্ত ৫ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছে কিন্তু কত তারিখে উত্তর ধার নিয়েছে তা বলেনি ; [রায়ের ১১ম পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা, ১৭তম লাইন]।

(২) ফরিয়াদি নালিশে বলেছে অভিযোগকারীর বাড়িতে গিয়ে টাকা ফেরত চেয়েছে; কিন্তু কত তারিখে টাকা ফেরত চাইতে গেছে তা নালিশে বলেনি বা কোনো প্রমাণ হাজির করেনি। [রায়ের ১৫তম পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা, ২/৩য় লাইন]

(৩) ফরিয়াদি কবে কোথায় কখন কার সামনে কথিত ৫ লক্ষ টাকা অভিযুক্তকে হস্তান্তর করেছে তা নালিশে উল্লেখ করেনি, জবানবন্দি প্রদান কালে বলেনি বা কোনরকম প্রমাণ হাজির করেনি। [রায়ের ১৫তম পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা, ২য়,৩য় লাইন]

(৪) সাফাই সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অভিযুক্ত নালিশী চেকটি ব্ল্যাংক চেক ছিলো মর্মে বক্তব্য দেওয়ার পরও ফরিয়াদি পক্ষে জেরায় ওই বক্তব্য অসত্য মর্মে কোন রকম সাজেশন ফরিয়াদি পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি, [রায়ের ১৫ পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা৫ম/৬ষ্ঠ লাইন]

(৫) এতো বড় অঙ্কের টাকা ধার দেওয়া হল কিন্তু কোন লিখিত প্রমাণ রাখা হলো না কেনো সে মর্মে কোন ব্যাখ্যা ফরিয়াদি প্রদান করেনি [রায়ের ২০তম পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা, ১০ম লাইন]

(৬) অভিযুক্ত তার সাফাই সাক্ষ্যতে অভিযুক্ত বলে ”নালিশকারী বা তার প্রতিষ্ঠান কে আমি কোন চেক দেইনি।  চেক এর স্বাক্ষর ব্যতীত অন্যান্য লেখা আমার হাতের নয “। কিন্তু এই সাফাই স্বাক্সীকে ফরিয়াদী পক্ষের করা জেরায় অভিযুক্তর এই বক্তব্য অস্বীকার করে ফরিয়াদি পক্ষে কোন সাজেশন দেওয়া হয়নি।[রায়ের ২০তম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা, ৪র্থ-৭ম লাইন]

(৭) স্বীকৃত মতেই অভিযুক্ত তর্কিত চেকে প্রাপকের নাম ও তারিখ উল্লেখ করেনি। কারণ সাফাই স্বাক্ষীকে জেরা কালে ফরিয়াদি পক্ষে এই বক্তব্যের বিপরীত সাজেশন দেয়া হয় নাই। তাই চেক এ নাম, টাকার অংক, তারিখ ইত্যাদী সেসব কে লিখেছে সে সংক্রান্ত ব্যাখ্যা ফরিয়াদি পক্ষে হাজির না করার ঘটনাতে আইন সম্মতভাবেই অনুমান করা যায় ফরিয়াদি বা তার কোন লোকে খালি চেকটি পূরণ করে। [রায়ের ২০তম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা, ১১তম- ১৬তম লাইন]

(৮) ফরিয়াদীর (i) যে লিখিত নালিশ দাখিল করেছেন, (ii) পি ডাব্লিউ ১ হিসেবে যে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন কিংবা (iii)পরে সাফাই সাক্ষীকে যে জেরা – এসব কিছু হতে স্পষ্ট যে ফরিয়াদি এবং অভিযুক্ত পরস্পর বন্ধু বান্ধব নয়, পরিচিত নয় এবং তাদের মধ্যে কোন লেনদেন ছিল না। তাই অভিযুক্তের কোন কারণ বা দরকার ই পড়ে  নাই ফরিয়াদি হতে কোনো ঋণ নেওয়ার ।

(৯) অভিযুক্তের দায়িত্ব ছিলো কেবলমাত্র দেখানো যে হয় কোনো কনসিডারেশন ছিলো ই না অথবা কনসিডারেশন থাকলেও সেটা পরিশোধ বা পরিপালন করতে ফরিয়াদি ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য ফরিয়াদি ৫লক্ষ টাকা অভিযুক্তকে ধার দেয়ার তথ্য বা কনসিডারেশন পরিশোধ কোনোটাই প্রমান করতে পারে নাই। [রায়ের ১৪তম পৃষ্ঠা, ৩য় প্যারা, ৪র্থ -১১তম লাইন]

আলোচ্য রায়ের একাডেমিক দিক আলোচনার সার সংক্ষেপ

আলোচ্য রায়ে স্মরণ করা হয়েছে যে-

(১) রোমান ডাইজেস্টিভ বলা আছে প্রমাণের দায়িত্ব তার- যে দাবী করে- যে অস্বীকার করে তার নয় । [রায়ের ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠা, শেষ প্যারা]

(২) প্রমাণের আগ পর্যন্ত অভিযুক্তের নির্দোষ তা ফরাসি দার্শনিক জ্য ল্যাঁম সুস্পষ্ট করেছেন। [রায়ের ৭ম পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা]

(৩) আদালতে অনুমান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে কোনো অনুমান কে কেমন অনুমান হতে হবে  সেটা মূল্যায়নে মুয়েলা্র  ও ক্রিকপ্যট্রিক প্রদত্ত ধারণা নেয়া হয়েছে। [রায়ের ৭ম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা]

(৪) ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকস্টোন যুক্তি স্মরণ করা হয়েছে যাতে বলা হয়েছে দরকার হলে ১০ জন অপরাধী মুক্তিপাক তবুও একজন নিরপরাধী যেন সাজা না পায়। এই নীতির প্রতি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এর সমর্থন ও স্মরণ করা হয়েছে। [রায়ের ৭ম পৃষ্ঠা, শেষ প্যারা]

(৫) আমেরিকান সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা জন এডামস বোস্টন গনহত্যা মামলায় অভিযুক্ত ব্রিটিশ সৈন্যদের পক্ষে আদালতে বক্তব্য দিতে গিয়ে সেই ব্ল্যাকস্টোন নীতি কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা আলোচ্য রায় স্মরণ করা হয়েছে। [রায়ের ৮ম পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা]

(৬) অভিযুক্ত নির্দোষ নীতি আমেরিকার সংবিধানের ৫ম, ৬ষ্ঠ, ১৪ তম সংশোধনীর মাধ্যমে সে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা আলোচনায় স্মরণ করা হয়েছে।[রায়ের ৮ম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা]

(৭) ১৮৯৫ সালের কফিন বনাম আমেরিকা মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে  অভিযুক্তের নির্দোষ নীতি প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করা হয়েছে।[রায়ের ৮ম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা]

(৮) উলমিংটন বনাম ডিপিপি মামলায় ২৩/০৫/১৯৩৫ তারিখে প্রদত্ত রায়ে লর্ড শ্যাংকি প্রতিষ্ঠিত গোল্ডেন থ্রেড নীতির কথা স্মরণ করা হয়েছে। গোল্ডেন থ্রেড নীতির বক্তব্য হলো- অভিযোগ যাই হোক না কেনো রাষ্ট্রপক্ষকেই প্রমাণ করতে হবে অভিযুক্ত নিঃসন্দেহে দোষী।

অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার

আলোচ্য রায়ের ১০ম পাতায় ১ম প্যারায় ১৩৮ ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণ এর আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত নির্দোষ নীতির আশ্রয় নিতে পারা- অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। কারণ বিজ্ঞ আদালত মনে করেন যেহেতু সংবিধানে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চুপ থাকার সাংবিধানিক অধিকার দেয়া আছে, তাই নির্দোষ নীতি ১৩৮ ধারার অভিযোগের ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত পক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজে দেয়।

নির্দোষ নীতি বনাম রিভার্স অনাস নীতি বা ১১৮ ধারায় অভিযুক্তের দায়

বিজ্ঞ আদালত কতৃক কোনো অভিযুক্ত এর বিরুদ্ধে আনা অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ সন্দেহ্তীতভাবে প্রমানিত হওয়ার আগতক অভিযুক্ত নির্দোষ-এটাই নির্দোষ নীতি।

১৩৮ ধারার মামলার ক্ষেত্রে এক দিকে নির্দোষ নীতির কারণে অভিযুক্তের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের কোন দায়িত্ব ফরিয়াদির ঘাঁড়ে বর্তায়, অভিযুক্তের ঘাঁড়ে বর্তায় না। অন্যদিকে এন আই এক্ট এর ১১৮ ধারা এর রিভার্স অনাস নীতির কারণে কনসিডারেশন ছিল না সেটা প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্তের ঘাঁড়ে বর্তায়। উল্লেখ্য এই যে অভিযুক্তকেই প্রমান করতে হয় কনসিডারেশন ছিলোনা- এটাকেই বলা হয় রিভার্স অনাস নীতি।

আপাতদৃষ্টিতে এই দুটি নীতি পরস্পর বিরোধী মনে হয়। এতে মনে হয় অভিযুক্তকে যদি রিভার্স অনাস প্রমাণ করতে না পারে তাহলে সে দোষী হয়ে যাবে। এই বিরোধের প্রেক্ষিতে আলোচ্য রায়ে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের কৃষ্ণর জনার্দন ভল বনাম দত্তটরায় জি মামলায় বিগত ১১/০১/২০০৮ ইং তারিখে প্রদত্ত রায়ে উক্ত ২নীতির আপাত বিরোধ নিষ্পত্তির নিমিত্তে প্রদত্ত যুক্তি গ্রহণ করা হয়। সেই ভারতীয় রায় যে অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে তার পড়ে এই মর্ম অনুভব হয় যে, উপরোল্লিখিত ২নীতির পরস্পর বিরোধের ক্ষেত্রে আলোচ্য রায়ে বিজ্ঞ হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের মতামত হলো নির্দোষ হতে হলে এই রিভার্স অনাস অভিযুক্তকে ই প্রমাণ করতেই হবে বিষয়টা এমন কঠোর ধরাবাঁধা নয়। আদালতের সামনে উপস্থাপিত সব প্রমান কেই একসাথে বিবেচনায় নিতে হবে। রিভার্স অনাস নীতি সুবিধা পাওয়ার দায়িত্ব পালন না করলেও সার্বিক বিবেচনায় যদি দেখা যায় সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণ হয় নাই তথাপিও অভিযুক্ত খালাস পাবে।

অর্থাৎ নির্দোষ নীতি সবসময়ই প্রযোজ্য। রিভার্স অনাস নীতির ক্ষেত্রে নির্জোট নীতি প্রযোজ্য। রিভার্স অনাস নীতি সংক্রান্ত দায় পালনে ব্যর্থ হলে ও অভিযুক্ত দোষী – আইনের সুত্রটা এতো সরল নয়। রিভার্স অনাস প্রমাণে ব্যর্থ হলেও নির্দোষ নীতি কার্যকর রয়ে যায়। অর্থাৎ রিভার্স অনাস করতে অভিযুক্ত ব্যর্থ হওয়ার পরও সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণের যদি সন্দেহ বজায় থাকে- যে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে হয়নি তবে অভিযুক্ত খালাস পাবে।

রিভার্স অনাসের পরিমিতি

সাধারণত ফৌজদারি মামলায় প্রমাণের দায়িত্ব ফরিয়াদি পক্ষের। অভিযুক্তের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের কোন দায় নাই। কিন্তু এন আই এক্ট এর ১১৮ ধারার প্রতিক্রিয়ায় চেকের মামলা ফৌজদারি মামলা হলেও অভিযুক্তকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে কিছুটা দায় নিতে হয়। এই আইনের ৪৩ ধারা মোতাবেক এই আইনে এর প্রতিকার পাওয়ার সবচেয়ে অনিবার্য শর্ত হলো কনসিডারেশন। কনসিডারেশন নাই তো নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট আইন অপারগ।

ফৌজদারি মামলার সাধারণত নীতি মোতাবেক কনসিডারেশন এর অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রমাণের দায়িত্ব পড়ে ফরিয়াদি পক্ষের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আইনের ১১৮ ধারার নির্দেশ হলো – কনসিডারেশন এর অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রমাণের প্রাথমিক দায়িত্ব অভিযুক্ত এর উপর বর্তায়। এই প্রাথমিক দায়িত্ব ফরিয়াদির নয়- ধরেই নেওয়া হবে কনসিডারেশন এর অস্তিত্ব ছিল। ১১৮ ধারার এই অনুমান কে বলা হয় আইনগত অনুমান বা স্ট্যাটিউটরি প্রিজামশন।

এই যে ফৌজদারি মামলায় প্রমাণের চিরায়ত নীতির বিপরীত দিকে গিয়ে- অভিযুক্তকে নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়া হলো প্রাথমিক ভাবে প্রমান করতে যে আসলে কোন কনসিডারেশন ছিলো না এটাই রিভার্স অনাস নীতি- তত্যটা আগেই বলা হয়েছে। আলোচচ্য রায়ে রিভার্স অনাস নীতি এর দায়য় পালনের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কিভাবে রিভার্স অনাস নীতি সুযোগ নিবে তার ৩টি বিকল্প পথ বাতলে দেয়া হয়েছে।

সে ৩টি বিকল্প হলো

(১) প্রমাণদিয়ে,অথবা

(২) ফরিয়াদি সাক্ষীকে জেরা করে, অথবা

(৩) পারিপার্শ্বিক স্বাক্ষ্য উপস্থাপন করে। [রায়ের ১৪তম পৃষ্ঠা, ২য় প্যারা, ৭ম- ১২তম লাইন]

অর্থাৎ ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে প্রমাণ হাজির করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি।কোনো রকম প্রমাণ হাজির করা ছাড়াই কেবল জেরা করে অভিযুক্ত রিভার্স অনাস নীতি থেকে সুবিধা পেতে পারে। এক্ষেত্রে অকাট্য বা প্রতক্ষ্য প্রমাণ এর কোন দরকার নাই। [রায়ের ১১তম পৃষ্ঠা, ১ম প্যারা, ২৪তম- ২৫তম লাইন]। কনসিডারেশন ছিল না এমন যৌক্তিক সম্ভাবনা তৈরী করাই অভিযুক্ত পক্ষের জন্য যথেষ্ট।

আলোচ্য রায়ের সার্বিক পাঠে তাই ১৩৮ ধারার অভিযোগ তথা চেকের মামলা প্রমাণ ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারক যে পরিমিতি নির্ণয় করেছেন বলে অনুভব হয়েছে, সেসব হলো:-

(১) এন আই এক্ট এর মামলায় ধরে নেয়া হবে কনসিডারেশন ছিলো,

(২) কনসিডারেশন ছিল না এটা প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্ত পক্ষের,

(৩) অভিযুক্ত পক্ষ অকাট্য প্রমাণ দিয়ে দেখাতে পারবে কনসিডারেশন ছিল না। তবে অকাট্য প্রমাণ দেখানো অভিযুক্ত পক্ষ এর জন্য বাধ্যতামূলক নয়।

(৪) অভিযুক্ত পক্ষ অকাট্য প্রমাণ দিতে না পারলেও কেবল ফরিয়াদির সাক্ষীকে জেরা করে যদি দেখাতে পারে কনসিডারেশন না থাকার সম্ভাবনা আছে তা হলেও রিভার্স অনাস এর দায় পালন হবে। অভিযুক্ত পক্ষ কে অকাট্য প্রমাণ হাজির না করে অথবা ফরিয়াদিকে জেরা না করে কেবল  যদি সাফাই স্বাক্ষ্য দিয়ে দায়সারা ভাবে বলার জন্য সাক্ষীকে বলে বা দাবী করে কনসিডারেশন ছিল না- সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত পক্ষ রিভার্স অনাস সুবিধা পাবে না তবে। এক্ষেত্রে ফরিয়াদি পক্ষকে তবুও সাফাই স্বাক্ষীর সেই দায় সারা দাবি অস্বীকার করে সাজেশন দিতে হবে।

(৬) অভিযুক্ত পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়ে জবানবন্দি দেয় যে কনসিডারেশন ছিল না এবং কিছু প্রমাণ দাখিল করে- কিন্তু সেসব দাবি ও প্রমাণ অস্বীকার করে জেরায় সাজেশন দিতে ফরিয়াদী ব্যর্থ হয় তবে সেক্ষেত্রেও বিজ্ঞ আদালত সার্বিক দিক বিবেচনায় অভিযুক্তকে রিভার্স অনাস সুবিধা দিতে পারবেন।

(৭) রিভার্স অনাস নীতিতে অভিযুক্তের দায়িত্ব কেবল যৌক্তিক সম্ভাবনার দাবি উত্থাপন করা কনসিডারেশন না থাকার একটা প্রমাণ হাজির করার বাধ্যবাধকতা নাই।

(৮) উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে অথবা কেবল বলার জন্য বলা নয় – অভিযুক্ত পক্ষ কনসিডারেশন না থাকার এমন অনিবার্য সম্ভাবনা উপস্থাপন করলে, ফরিয়াদি পক্ষকে অবশ্যই অকাট্যভাবে প্রমাণ হাজির করতে হবে যে কনসিডারেশন ছিল। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ফরিয়াদী পক্ষের অকাট্য প্রমাণের ব্যর্থতায় অভিযুক্তের নির্দোষ নীতি কার্যকর হবে।

(৯) রিভার্স অনাস নীতির সাথে অভিযুক্ত নীতি সাংঘর্ষিক নয়। অভিযুক্ত পক্ষ রিভার্স অনাস নীতি প্রমাণে ব্যর্থ হলে ও, সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে, কিংবা অন্য কোনোও দৃঢ় সন্দেহ উদ্রেকের কারণে নির্দোষ নীতি মোতাবেক অভিযুক্তকে বিজ্ঞ আদালত খালাস দিতে পারবেন।

(১০) রিভার্স অনাস নীতির সুবিধা অভিযুক্তর জন্য। তবে এন আই এক্ট এর মামলাগুলোয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা প্রযোজ্য নয়, ঘটনা থেকে ঘটনায়, মামলা হতেয় মামলা, পরিস্থিতিতে প্রয়োগের বিভিন্নতা হবে। আংশিক নয় সার্বিক বা পুরো চিত্র দেখে পারিপার্শ্বিক সকল দিক মূল্যায়ন করে বিবেচনা করতে হবে রিভার্স অনাস নীতিসুবিধা অভিযুক্ত পাবে কিনা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: সুম্পষ্টভাবে ডিসক্লেইমার দেয় যাচ্ছে যে, উপরের পুরো আলাপ ই আলোচ্য রায় পাঠে লেখকের ব্যাক্তিগত অনুভবের বিবরণ মাত্র। এই আলাপ কখনোই রেফারেন্স নয়। যেকোনো রকম তথ্যর জন্য এই আলাপে সংযুক্ত রায়ের লিংক অথবা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট প্রকাশিত রায় এর টেক্সটই সর্বোচ্চ উপসংহর। কেবল এই আলাপের ভিত্তিতে কোনো সিদ্বান্ত নেয়া চরম ভুল সিদ্ধান্ত  হবে। এই আলাপে ভুল হলে লেখক ক্ষমা প্রার্থী- কিন্তু এই ডিসক্লেইমারের মাধ্যমে এই আলাপের ভুল জনিত সাবধানতা সুস্পষ্ট করায়, এই আলাপের ভিত্তিতে তারপরও কেউ কোনো ক্ষতির শিকার হলে সেটা কেবলই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর দায়।

লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, কুমিল্লা। ইমেইল: samukim1@gmail.com