মেধাবীরা অপরাধে জড়ালে কী হয়, পি কে হালদার তার উদাহরণ: আদালত
প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার

মেধাবীরা অপরাধে জড়ালে কী হয়, পি কে হালদার তার উদাহরণ: আদালত

একজন মেধাবী ব্যক্তি অপরাধে জড়ালে সে যে জাতির জন্য ‘বিপজ্জনক’ হয়ে দাঁড়ায়, পি কে হালদার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে মন্তব্য এসেছে আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে।

ঢাকার দশম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম রোববার (৮ অক্টোবর) তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, যারা অবৈধভাবে বিদেশে দ্বিতীয় আবাস গড়ে তোলে, তারা ‘দেশকে ভালোবাসে না’।

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের এই মামলায় গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে ২২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

দুর্নীতির কোনো মামলায় এবারই প্রথম পি কে হালদারের সাজার রায় এল। মামলার বাকি ১৩ আসামির প্রত্যেককে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।

আসামিদের মধ্যে সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা, অবন্তিকা বড়াল ও শংখ বেপারীর উপস্থিতে রায় দেন বিচারক।

পলাতক রয়েছেন ১০ জন। এরা হলেন- পিকে হালদার, তার মা লিলাবতী হালদার, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রিতিশ কুমার হালদার, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় ও স্বপন কুমার মিস্ত্রি।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “একজন নাগরিক তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে জাতি গঠনে যেরূপ ভূমিকা রাখতে পারে, ঠিক তেমনি অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তখন সে জাতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। আসামি পি কে হালদার তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

“মানুষ ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। পি কে হালদারের নিকট দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থ অনেক বড় ছিল । আমরা যেন নিজের সামান্য ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মানিলন্ডারদের সহযোগী না হই।”

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের মামলার আসামি পিকে হালদার বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবাংলায় কারাগারে আটক আছেন। সেখানেও তার বিচার চলছে।

করোনাভাইরাস মহামারীর সময় তিনি দেশে ফিরে টাকা ফিরিয়ে দেবেন জানিয়ে আদালতে কাগজ জমা দিয়েছিলেন তার আইনজীবীরা। দেশে ফিরলে তাকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, এমন আবেদন ফিরিয়ে বিমানবন্দর থেকে ধরে তাকে আদালতে নিয়ে আসার আদেশ আসে হাইকোর্ট থেকে।

এরপর পিকে আর দেশে ফেরেননি। তিনি কানাডায় আছেন, এমন একটি প্রচারের মধ্যে গত বছরের মে মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তাকে গ্রেপ্তারের খবর আসে।

পিকে হালদারের কারণে দেশের বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশায় পড়েছে। শত শত কোটি টাকা তুলে নেওয়ার কারণে আমানতকারীদের টাকা ফিরিয়ে দিতে পারছে না সেগুলো। এসব ঘটনায় ডজন তিনেক মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এর মধ্যে দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের এই মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।

সেখানে বলা হয়, পি কে হালদার নামে-বেনামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ জমি কিনেছেন। এ সম্পদের বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা।

বর্তমানে এর বাজারমূল্য ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিজের নামে জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ। এর দাম দলিলে দেখানো হয়েছে ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা। অথচ এ সম্পদের বর্তমান মূল্য ২২৮ কোটি টাকা।

এছাড়া রাজধানীর ধানমন্ডিতে পি কে হালদারের নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পি কে হালদার তার নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন করেছেন। যার দাম ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন। যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা।

নিজের কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে ২ একর জমির ওপর নির্মাণ করেন ৮তলা হোটেল, যার আর্থিক মূল্য এখন ২৪০ কোটি টাকা। এছাড়া পি কে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি, এর বর্তমান দাম ১৬৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং কানাডিয়ান ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যের বরাত দিয়ে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পি কে হালদার ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভাই প্রীতিশ হালদারের কাছে ১ কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডীয় ডলার পাচার করেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮০ কোটি টাকার বেশি।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, পি কে হালদার মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার পরিবর্তে সম্পদ গড়ার নেশায় মত্ত হন। তার মা ও ভাইসহ ঘনিষ্ঠজনের সহযোগিতায় অসংখ্য নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পাহাড়সম অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন।

“যে ব্যক্তিরা বিদেশে অবৈধভাবে দ্বিতীয় আবাস গড়ে তোলে, তারা দেশকে ভালোবাসে না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটের আলোকে অর্থপাচার প্রতিহত করতে হবে।”

প্রশান্ত কুমার হালদারদের কোনো আদর্শ নেই মন্তব্য করে বিচারক বলেন, “তারা দেশের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। প্রকৃতপক্ষে এরা দেশের শত্রু।”

পর্যবেক্ষণে কানাডা সরকারকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, “এটা অতীব দুঃখের বিষয় যে, যদিও পারস্পরিক আইনি সহযোগিতা করার জন্য অনেক আগে কানাডা সরকারকে আহ্বান করা হয়েছিল, যা এখেনো নিষ্পত্তি হয়নি। উন্নত বিশ্বের সহযোগিতা ছাড়া অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব নয়।

একজন বিচারক শুধু রেকর্ড ও নথি দেখে রায় ঘোষণা করতে পারেন মন্তব্য করে বিচারক বলেন, এতে এক পক্ষ খুশি হবে, অপর পক্ষ অখুশি হয়। দুই পক্ষকে কখনো খুশি করা যায় না। আর এটা বিচারকের কাজও না।

“আমাদের রেকর্ডে যা আছে তা দেখেই আমাদের জাজমেন্ট দিতে হয়। রেকর্ডে কিছু তথ্য সত্য থাকে কিছু মিথ্যা থাকে ডকুমেন্টস কিছু ফলস থাকতে পারে। আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব বিচার-বিশ্লেষণ করে রায় দেওয়ার চেষ্টা করি। কংক্রিট জাস্টিস আমরা দিতে পারি না। মহান সৃষ্টিকর্তা তা দিতে পারেন।”

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, “অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হওয়ার মাত্র ১৩ মাসের মধ্যে এ মামলার রায় দেওয়া হল।”