অনাস্থা প্রস্তাব ও আমাদের জাদুকরী ৭০ অনুচ্ছেদ
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ

অনাস্থা প্রস্তাব ও আমাদের জাদুকরী ৭০ অনুচ্ছেদ

মো. বাধন মল্লিক: পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে অনাস্থা প্রস্তাবের প্রচলন রয়েছে। সাধারণত অর্থে বলতে গেলে অনাস্থা হচ্ছে কারো প্রতি আস্থা না থাকা। কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি তার পদে অবস্থানকালে, সেই পদের জন্য সে যোগ্য আছে কিনা এ বিষয়ে মন্তব্য বা ভোটই হচ্ছে অনাস্থা প্রস্তাব। ইংরেজিতে এটাকে Motion of no confidence বলা হয়।

এ প্রস্তাব সংসদে পাস হলে মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী যে কেউ তার পদ থেকে বরখাস্ত হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যক সাংসদের ভোটের প্রয়োজন রয়েছে, অন্যান্য প্রস্তাব পাশের মতো।

ভারত

প্রতিবেশি দেশ ভারতের সংসদে শুধুমাত্র নিম্নকক্ষে (লোকসভা) অনাস্থা প্রস্তাব আনা যায় তবে কমপক্ষে ৫০ জন সংসদ সদস্যদের ভোটের প্রয়োজন। প্রস্তাবটি কার্যকারি হলে লোকসভা ওই প্রস্তাবের জন্য বিতর্ক ও ভোট করে। বেশি ভোট পেয়ে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হলে সরকারকে কার্যালয় খালি করতে হয়।

চীন ও ভারত যুদ্ধের পরে ১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে আচার্য কৃপালিনী সর্বপ্রথম লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনেন‌। ভারতীয় লোকসভার হিসাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সবচেয়ে বেশি ১৫ বার অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এছাড়া জওহরলাল নেহেরু, রাজীব গান্ধী, নরেন্দ্র মোদী সবাই অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

পাকিস্তান

পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া অনাস্থা প্রস্তাব পৃথিবীর সবাইকে এই প্রস্তাবের কার্যকারিতাকে নতুনভাবে জানান দিয়েছে। পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা হয় অনাস্থা প্রস্তাব। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম কোন প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।

জাতীয় পরিষদের ৩৪২ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। তবে এই অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে কাজ করছে পশ্চিমা দেশগুলো এমন শোনা যায়।

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের সময় ইমরান খানের রাশিয়াতে অবস্থানের ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি। তাছাড়া ইমরান খান নিজেও স্বীকার করেছেন তার বিরোধী দলগুলো বিদেশি শক্তির সাথে কাজ করছেন।

বাংলাদেশে অনাস্থা প্রস্তাব

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হলেও এখানে সংবিধানে অনাস্থা প্রস্তাবের কোন কার্যকারিতা নেই। উল্টো সংবিধানের মাধ্যমে এটা রোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে স্পস্টত বলা আছে, কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনীত হয়ে কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে উক্ত দল থেকে পদত্যাগ বা উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করলে তার সংসদ সদস্য পদ শূন্য হবে এবং পরবর্তীতে কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা হবে।

সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের কারণে অনাস্থা প্রস্তাবের কোন প্রচলন বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। যদি প্রশ্ন করা হয় কিভাবে এলো এই অনুচ্ছেদ? তাহলে ফিরে যেতে হবে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময়কাল ১৯৭২ সালে।

গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা চলাকালীন সময়ে সংবিধান বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেনকে দুবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

প্রথমবার বঙ্গবন্ধু পরামর্শ দেন রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংযোগ ছিন্ন করার বিধান অনুসারে ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ জুড়ে দিতে। দ্বিতীয়বার সরকারের স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে নিজ দলের বিপক্ষে কেউ ভোট দিলে তার সংসদ সদস্য পদ খারিজ করার বিধান করার জন্য (অনুচ্ছেদ ৭০)।

এই অনুচ্ছেদের কারণে বাংলাদেশের কোন নির্বাচিত সরকার কোনো ভারসাম্যহীনতায় পড়েনা। তবে এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামত বা ভোট দেয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

কিন্তু পাকিস্তানের অনাস্থা প্রস্তাবে যদি বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ থাকে, তাহলে এই অনুচ্ছেদ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে কতো বড় হাতিয়ার তা ধারণা করা যায় এবং এই অনুচ্ছেদ রাখার পরামর্শদাতা কে স্বগর্ভে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান জানানো যায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।