১৬৪ ধারার জবানবন্দি ও আইনের বিধান
দিদার আহমেদ, অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট

১৬৪ ধারার জবানবন্দি ও আইনের বিধান

দিদার আহমেদ: ১৬৪ ধারার জবানবন্দি – এর কথাটা শুনলেই আমাদের দেশের আম জনতার মনের মধ্যে প্রথমেই যে বিষয়টি আসে তা হলো দেশে কোন চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে ,আসামী ধরা হয়েছে এবং তার স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। আসলেই কি তাই? এই জবানবন্দিটি কি? কে দেয়? কার নিকট দেয়? এর গুরুত্ব কি? এর প্রক্রিয়া কি? এই সব প্রশ্নের উত্তরসহ আজ আমরা আলোচনার চেষ্টা করব ১৬৪ ধারার সারমর্ম ও খুঁটিনাটি। যদিও মিডিয়ার বদৌলতে এই শব্দের সাথে আমজনতার অনেকটাই পরিচিতি কিন্তু আইনের প্রশ্নে অনেকেই অজ্ঞ। চলুন দেখি আইন কি বলে।

সকল ম্যাজিস্ট্রেটই কিন্তু এই জবানবন্দি গ্রহণের ও লিপিবদ্ধের যোগ্যতা রাখেন না। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী যে কোনো মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা প্রথম শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের এই জবানবন্দি রেকর্ড করার ক্ষমতা রয়েছে।

ফৌজদারি মামলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি। যদিও তা সব মামলার বেলায় বাধ্যকর নয়। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এই পদ্ধতিগত আইন। এই আইনের ১৬৪ ধারা মতে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে থাকেন একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট। সেক্ষেত্রে সকল ম্যাজিস্ট্রেটই কিন্তু এই জবানবন্দি গ্রহণের ও লিপিবদ্ধের যোগ্যতা রাখেন না। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী যে কোনো মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা প্রথম শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের এই জবানবন্দি রেকর্ড করার ক্ষমতা রয়েছে। এই জবানবন্দি গ্রহণ হবে বিচার বা তদন্ত শুরু হওয়ার আগে বা পরে যেকোনো সময়। এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কেবলমাত্র আসামী দিতে পারে। একে আবার বিচারিক দোষস্বীকারও বলা হয়ে থাকে । শুধু ‘জবানবন্দি’ এবং ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দির মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ও পার্থক্য বিদ্যমান।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কেবলমাত্র আসামী দিতে পারে। একে আবার বিচারিক দোষস্বীকারও বলা হয়ে থাকে । শুধু ‘জবানবন্দি’ এবং ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ জবানবন্দির মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ও পার্থক্য বিদ্যমান।

স্বীকারোক্তি হলো, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির  নিজের সংঘটিত অপরাধের স্বীকৃতি আর জবানবন্দি হবে তার বক্তব্য তা স্বীকৃতীমূলক বা অস্বীকৃতিমূলক উভয় ভাবেই হতে পারে বা বৈরীও হতে পারে ।পুলিশের নিকট দেয়া স্বীকারোক্তি আর বিচারিক দোষস্বীকার এর  ব্যাপক গুরুত্ব ও পার্থক্য রয়েছে। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি আবার দুরকম হতে পারে । নিজেকে ঘটনার সাথে জরিয়ে সম্পৃক্ত যখন স্বীকারোক্তি দেয়া হয় তখন তাকে (ইনকাল্পাটরি কনফেশন) এবং নিজেকে না জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিলে তাকে (এক্সকাল্পাটরি কনফেশন) বলা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী ১৬৪ ধারার জবানবন্দি গ্রহন ও লিপিবদ্ধকারী ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধ বিচারের এখতিয়ার  বিবেচ্য হবে না। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেয়া উক্ত স্বীকারোক্তির সাক্ষ্যগত মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হলে তার ওপর ভিত্তি করেই আসামিকে সাজা দেওয়া যাবে।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী ১৬৪ ধারার জবানবন্দি গ্রহন ও লিপিবদ্ধ করতে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটকে একই আইনের ৩৬৪ ধারা অনুসরন করতে হয় এবং সেমতে তা লিপিবদ্ধ করতে হয়। কোন আসামির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জবানবন্দির পূর্বেই ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জানাবেন যে,তিনি পুলিশ নন তিনি ম্যাজিষত্রেট,তার নিকট আসামীকে আনা হ্যেছে দোষ স্বিকার করার জন্য , তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য নন এবং স্বীকারোক্তি দিলে তা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। আসামী প্রদত্ত স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় হচ্ছে বলে যুক্তিসংগতভাবে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট তা লিপিবদ্ধ করবেন না। বর্ণিত সকল  বিষয়গুলো যথাযথভাবে পালন করা হয়েছে মর্মে একটি সনদ মন্তব্য ম্যাজিস্ট্রেট নিজে উল্লেখ করবেন। অতঃপর সেই জবানবন্দি ঘটনা সম্পর্কে যিনি অনুসন্ধান করবেন বা বিচার করবেন তার কাছে পাঠাবেন। পুরো জবানবন্দিই আইন

নির্দিষ্ট একটি প্রেস্ক্রাইব ফরমে লিপিবদ্ধ করা হবে। ম্যাজিস্ট্রেটকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৪ ধারার নিয়ম অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। এই ধারা অনুযায়ী আসামিকে জিজ্ঞাসিত প্রতিটি প্রশ্ন জবাবসহ পুরো জবানবন্দি আসামির ভাষায় বা আদালতের ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে। এরপর সেই জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পড়ে শুনাবেন। জবানবন্দি আসামির বোধগম্য ভাষায় লিখিত না হলে সারমর্ম বুঝিয়ে দেবেন। জবানবন্দির শুদ্ধতা ও সত্যতা স্বীকার করলে আসামি এবং ম্যাজিস্ট্রেট উভয়েই সেটাতে স্বাক্ষর করবেন। এছাড়া উপরোক্ত বিষয় যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয়েছে মর্মে ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যয়ন করবেন।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী ১৬৪ ধারার জবানবন্দি গ্রহন ও লিপিবদ্ধকারী ম্যাজিস্ট্রেটকে আসামীকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট হতে হবে যে এই জবানবন্দিদাতা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এবং কোনো প্রকার প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করছেন এবং সর্বশেষ তিনি স্বীকারোক্তির শেষে জবানবন্দির একেবারে শেষে সব কিছু উল্লেখ করে অর্থাৎ আইন আরোপিত দায়িত্ব কিভাবে পালন করেছেন এবং কিভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে এই জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে প্রদান করা হয়েছে এবং তিনি জবানবন্দি দেওয়ার ফলাফল সম্পর্কে ব্যক্তিটিকে অবহিত করেছেন কি না ইত্যাদি উল্লেখ করে একটি মেমোরেন্ডাম লিখবেন এবং নিজ স্বাক্ষর করবেন।

১৬৪ ধারার জবানবন্দি হচ্ছে একজন আসামির স্বেচ্ছায়, স্বপ্রণোদিত হয়ে ভুল বুঝতে পেরে স্বীকারোক্তিমূলক বয়ান। যেটা সে ক্ষেত্র বিশেষে করে। আমাদের দেশে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয় পুলিশ রিমান্ড শেষ করার পর। কেউ রিমান্ডে থাকেন ৫ দিন, কেউ বা ৭ দিন। তাহলে পুলিশ রিমান্ডে কি এমন হয় যে রিমান্ড শেষেই তারা অনুতপ্ত হয়ে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়ে দেন সাথে সাথে?

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি অবশ্যই খাস কামরা ব্যতীত গহন করা হবেনা এবং সেখানে আসামী ও ম্যাজিস্ট্রেট ব্যতীত অন্য কেউ থাকবে না । এটা অবশ্যই শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে রেকর্ড হবে, এমনকি এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষেও কোনো পুলিশ উপস্থিত থাকতে পারবে না। আসামীকে চিন্তা ভাবনা করার জন্যও ম্যাজিস্ট্রেট তাকে পর্যাপ্ত সময়(৩ ঘণ্টা) দিবেন ।এই সময়ও সে ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনেই খাস কামরায় থাকবে ।

যদিও আমাদের দেশে আসামীপক্ষকে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কপি দেয়া হয়না বা দেখতে দেয়া হয় না কিন্তু সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একটি পাবলিক ডকুমেন্ট যা আসামিপক্ষে পেতে কোন আইনি বাধা-নিষেধ থাকার কথা নয়। যে মামলায় আসামী ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সেই মামলায় জবানবন্দি গ্রহন ও লিপিবদ্ধকারী ম্যাজিস্ট্রেটকে গুরুত্বপূর্ন সাক্ষী মান্য করা হয় এবং তিনি বিচারিক আদালতে সমনপ্রাপ্ত হয়ে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য প্রদানে বাধ্য থাকেন, সেক্ষেত্রে আসামী পক্ষ তাকে জেরা করার আইনত অধিকার রাখে ।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি  ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়ার পর যেকোনো সময় তা প্রত্যাহারের আবেদনও করা যায়। উক্ত আবেদন দিলে তাকে বলা হয় প্রত্যাহারকৃত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি (রিট্রাক্টেড কনফেশন)। এই আবেদন আসামীকেই করতে হয়।  ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামী পরীক্ষার পর সাফাই সাক্ষীর বেলায়ও আসামী কর্তৃক প্রদত্ত  ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করা যায়।

১৬৪ ধারার জবানবন্দি হচ্ছে একজন আসামির স্বেচ্ছায়, স্বপ্রণোদিত হয়ে ভুল বুঝতে পেরে স্বীকারোক্তিমূলক বয়ান। যেটা সে ক্ষেত্র বিশেষে করে। আমাদের দেশে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয় পুলিশ রিমান্ড শেষ করার পর। কেউ রিমান্ডে থাকেন ৫ দিন, কেউ বা ৭ দিন। তাহলে পুলিশ রিমান্ডে কি এমন হয় যে রিমান্ড শেষেই তারা অনুতপ্ত হয়ে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়ে দেন সাথে সাথে?

আমাদের হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত আছে, যদি পুলিশ রিমান্ডে সামান্যতম নির্যাতনের অভিযোগ থাকে তাহলে এই ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, সেখানে যে যাই বলুক না কেন, এই পুরোটাই এভিড্যান্সের বাইরে চলে যাবে। এভিড্যান্স হিসেবে এটার কোনো ভ্যালু নাই। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো আমাদের যে চলমান ইনভেস্টিগেশন সিস্টেম, সেই সিস্টেম সববসময় শর্টকার্ট মেথড খুঁজে কেন? ১৬৪ ধারার জবানবন্দি তো বিচারের জন্য সবচেয়ে মুখ্য বিষয় নয়।

বিচার বা তদন্ত যদি কেউ করতে চায় চারপাশের আর যে সকল এভিড্যান্স আছে, আলামত আছে, কোনো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হলে সেই অস্ত্রের প্রমাণ থাকে, গুলি করলে গুলির প্রমাণ থাকে, আঘাতের চিহ্ন থাকে, মৃত দেহ থাকে, রক্ত থাকে, ডিএনএ থাকে, ক্রাইম সিন এন্ড প্লেস থাকে এসবের ওপর জোর দিবেন। এসমস্ত জিনিসগুলো যদি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে সংগ্রহ করতে পারেন একজন ইনভেস্টিগেশন অফিসার, ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে এবং সায়েন্টিফিক এভিডেন্স সংগ্রহ করে পারেন তাহলে একজন ইনভেস্টিগেশন অফিসারকে ১৬৪ ধারার জবানবন্দির ওপর কোনভাবেই নির্ভরশীল হবার প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন হলো ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দিয়েই কেন অভিযুক্ত সাজা দিতে হবে? ১৬৪ ধারার জবানবন্দি ছাড়া বাকি যে সমস্ত এভিডেন্স আছে সেগুলো যদি যথোপযুক্ত হয় তাহলে সেটাই সাজা দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি নেয়ার পেছনে টার্গেট কি থাকে, যে শর্টকার্টে ইনভেস্টিগেশন শেষ। নিলাম আমি তাকে রিমান্ডে, নেয়ার পরে সে স্বীকারোক্তি দিল, ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দি রেকর্ড করলেন, কিন্তু হাইকোর্টে যখন মামলাটি আসে তখন বলে আসামি তো নিজেই অপরাধ স্বীকার করেছে যে অপরাধ সে নিজেই করেছে, তখন আর কিছু বলার থাকে না।

কিন্তু অন্যান্য যে পারিপার্শ্বিক এভিড্যান্স আছে সেগুলো কিন্তু নাই। এখানে কিন্তু ব্লাডের স্যাম্পল কালেকশন করা হয় নাই, ওই সংশ্লিষ্ট পিস্তলটা সংগ্রহ করা হয়নি, এখানে যে সংশ্লিষ্ট পিস্তল থেকে গুলিটা বের হয়েছে সেটা যে ওই পিস্তলেরই কিনা, সেটাই ব্যালেস্টিক পরীক্ষা করে নির্ধারণ করা যায় নি, এগুলো কিছু না করে সরাসরি এসে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নিয়ে এসে বলে যিনি খুন করেছেন তিনিই হলেন অপরাধী। এটা সংঘাতিক রকম ইনভেস্টিগেশনের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার ফল।

একজন ইনভেস্টিগেশন অফিসার একজন দক্ষ লোক একজন এডুকেটেড লোক, একজন প্রশিক্ষিত লোক, তার কাজ হবে তারা টেকনিক্যাল ক্যাপাবিলিটি ব্যবহার করে তথ্য উদঘাটন, রহস্য উদঘাটন এবং ঘটনার রহস্য উন্মোচন করা। কেন তার বিরুদ্ধে আসামাকে হুমকি দিয়ে জোর করে, নির্যাতন করে, হত্যার হুমকি দিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায়ের অভিযোগ উঠবে? তাকে তো রাষ্ট্রের ও জনগণের অনেক অর্থ ব্যয় করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, অনেক ইনভেস্টিগেশন অফিসার আছে তাদেরকে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসা হয়। যেন তারা ভালোভাবে ইনভেস্টিগেশন করতে পারে।

কিন্তু পদ্ধতি অবলম্বন করা অনেক কঠিন, অনেক কষ্টের, অনেক চিন্তার, অনেক বেশি দক্ষতার ফল। সেটি না করে আমরা শর্টকার্ট মেথডে যেভাবে চলে যাচ্ছি ১৬৪ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড করার ক্ষেত্রে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। পৃথিবীর উন্নত সভ্য রাষ্ট্রের কোথাও ১৬৪ ধারার জবানবন্দি এ দেশীয় পদ্ধতিতে গ্রহণ করা হয় না। ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কোনো কোনো দেশে পুলিশই গ্রহণ করে, কোথাও ম্যাজিস্ট্রেট গ্রহণ করেন, সেই ক্ষেত্রে ওই ব্যাক্তির আইনজীবী উপস্থিত থাকে, প্রসিকিউটর পক্ষে আইনজীবী উপস্থিত থাকে, পুলিশও উপস্থিত থাকে, ম্যাজিস্ট্রেটও উপস্থিত থাকে। সবার হাজিরা অনুসারে এটা রেকর্ড করা হয়, এমনকি এটার অডিও ভিডিও রেকর্ডও থাকে। পরবর্তীতে কোর্ট যেন সেটা নিয়ে আসতে পারে।

ন্যায় বিচার পাবার প্রতি মানুষের যে ক্ষণিক সংশয় তৈরি হয় সেটার মূল কারণ হলো আমাদের অদক্ষতা, আমাদের অধৈর্য, গোজামিল দেয়ার একটা প্রবনতা, ইনভেস্টিগেশন সঠিকভাবে না করে ১৬৪ ধারার জবানবন্দির ওপর নির্ভর করা। এটা কোনোভাবেই সঠিক নয়, আইনের স্পিরিটও এটি নয়। এটি যদি ভবিষ্যতে চলমান থাকে তাহলে ন্যায় বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে।

একজন আইন বিশ্লেষকের মতে, সেই ইনভেস্টিগেশন অফিসারকে আলাদাভাবে পুরস্কৃত করা উচিত যিনি কোনো প্রকার ১৬৪ ধারা ছাড়া মামলার তদন্ত শেষ করে অপরাধ প্রমাণ করতে পারেন। পাশাপাশি, ইনভেস্টিগেশন অফিসারের জন্য বিসিএস-এ আলাদা ক্যাডার চালু করার জন্য পরামর্শ দেন তিনি। সেখান থেকে গভীর অধ্যয়ন ও কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে চমৎকার সব ইনভেস্টিভেশন অফিসার বেরিয়ে আসবে। বিভিন্ন দেশের তদন্ত সংস্থার সাথে সমসাময়িক প্রযুক্তি ও তদন্ত প্রশিক্ষণের জন্য দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাড়ানো উচিত। আমাদের দেশের আইনে তদন্ত সঠিকভাবে না করলে শাস্তির ব্যবস্থা রেখে কোনও আইন নাই। তবে পুলিশের আইনে ডিপার্টমেন্টাল ব্যবস্থা গ্রহণের কিছু ধারা আছে। ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন তারা নিতে পারে; গুরুদণ্ড, লঘুদণ্ড তারা দিতে পারে। তবে সে নজিরও খুব কম।

মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আসামিকে সরবরাহ করা যাবে না, এমন কথা ফৌজদারি কার্যবিধির কোথাও বলা নেই। তবে পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দেয়ার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৬৪ ধারার জবানবন্দি অনুলিপি পেতে পারে না মর্মে ৪ ডি.এল. আর, পেজ ১৩৫ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে।

কোন মামলা তদন্ত চলাকালে ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির নকল কপি কেন আসামিকে সরবরাহ করা হবে না তা জানতে চেয়ে ইতোমধ্যে রুল জারি করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট। গত ৯ মার্চ বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ হত্যা মামলার আসামির পক্ষে এক আবেদন শুনানি নিয়ে এ রুল জারি করেন। এর আগে গত ৪ জুলাই’২০২০ নাহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি খুন হন। ওই খুনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আসামি লিপন পাটোয়ারী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। বিচারিক (নিম্ন) আদালতে আসামির দেয়া জবানবন্দির নকল চেয়ে আবেদন করেন। নিম্ন আদালত উক্ত আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর ওই আদেশের বিরুদ্ধে আসামি হাইকোর্টে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ এ ধারায় আবেদন করেন। সেটি শুনানি নিয়ে তদন্ত চলাকালে আসামিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির নকল কপি কেন দেয়া হবে না মর্মে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একটি পাবলিক ডকুমেন্ট। এই দলিল পেতে আসামিপক্ষে কোন আইনি বাধা-নিষেধ থাকার কথা নয়। পাশাপাশি কোনো মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি থাকলে হাইকোর্টে জামিন আবেদন শুনানির সময় আদালত এরূপ জবানবন্দি জামিন আবেদনের সঙ্গে দিতে বলেন। তখন জবানবন্দির ফটোকপি পাওয়ার জন্য আসামিকে তদন্তকারী কর্মকর্তার দ্বারস্থ হতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নিতে হয়।

শুধু ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নয়, আসামি তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিসহ ভিক্টিমের ২২ ধারার জবানবন্দি ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাবলিক ডকুমেন্ট হওয়ায় পাওয়ার অধিকার রাখে। এ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আইনি আলোচনা হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৪-এ বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকবে এবং নাগরিকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে।’ তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চারটি পক্ষ জড়িত যথা আবেদনকারী, তথ্য সরবরাহের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আপিল কর্তৃপক্ষ ও তথ্য কমিশন। আইনের অনুচ্ছেদ ৯ (২) অনুযায়ী, আবেদনকারীকে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথ্য সরবরাহ করবেন।

যদি ওই কর্মকর্তা তথ্য না দেন কিংবা আপিল কর্তৃপক্ষের কাছেও আবেদনকারী প্রত্যাখ্যাত হন, তাহলে তথ্য না পাওয়ার বিষয়ে ২৪ নম্বর সেকশন অনুযায়ী তথ্য কমিশনের কাছে অভিযোগ করা যাবে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সেকশন ২৫ (১০) আবেদনকারীর অভিযোগ ন্যূনতম ৪৫ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৫ দিনের মধ্যে মীমাংসা করবে তথ্য কমিশন। প্রার্থিত সময়ের মধ্যে তথ্য না দিলে তথ্য কমিশন ধারা ২৭ মোতাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জরিমানা এবং আপিল কর্তৃপক্ষ আইনকে অবমাননা করলে বিভাগীয় শাস্তি বিধানের জন্য কমিশন সুপারিশ করতে পারে। তথ্য অধিকার আইনের এই বিধান ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ পদক্ষেপ।

সংবাদকর্মী তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে গোপনে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী ‘সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে’-ওই সংবাদকর্মীকে অভিযুক্ত করা যাবে। এতে একজন সংবাদকর্মীর ১৪ বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।

তথ্য আইন আপিল অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোড অব সিভিল প্রসিডিউর এবং আদালতের সমন জারি, কোন অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তথ্য কমিশনের সামনে উপস্থিত করতে বাধ্য করে ইত্যাদি। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের মাধ্যমে সাক্ষী তলব করা, অভিযোগ সম্পর্কে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেরা করা, বেসরকারি দলিলপত্র উপস্থাপন করা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আসামিকে সরবরাহ করা যাবে না, এমন কথা ফৌজদারি কার্যবিধির কোথাও বলা নেই। তবে পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দেয়ার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৬৪ ধারার জবানবন্দি অনুলিপি পেতে পারে না মর্মে ৪ ডি.এল. আর, পেজ ১৩৫ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে তথ্য অধিকার আইনের প্রথম অধ্যায়ের ৩ (খ) অনুযায়ী তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাবে বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

সংবাদমাধ্যম খুললেই আমরা দেখতে ও পড়তে পারি যে, অমুক আসামি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে এবং ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত তাদের নামও বলেছে। পুলিশ তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। শুধু এতটুকুই নয়, আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা জবানবন্দিতে কি কি বলেছে, তার বিস্তারিত বিবরণও জানানো হয়। এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে সহজ উত্তর হয় যে, সংবাদকর্মী তার নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে গোপনে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী ‘সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে’-ওই সংবাদকর্মীকে অভিযুক্ত করা যাবে। এতে একজন সংবাদকর্মীর ১৪ বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।