প্রসঙ্গ : আইন পেশার ইতিহাস ও আইনজীবী হওয়ার যোগ্যতা
অ্যাডভোকেট দীপজয় বড়ুয়া

অপরাধ শনাক্তকরণে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও হাতের লেখার সাক্ষ্যগত মূল্য

দীপজয় বড়ুয়া: আঙুলের ছাপ হল আঙুলের ছাপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য। যা কোন কঠিন পদার্থ আঙুলের মাধ্যমে স্পর্শ করলে সৃষ্ঠ হয়। মানুষের ত্বকের ‘eccrine glands’ থেকে নিঃসরিত ঘাম কোন কঠিন পদার্থ, যেমনঃ কাঁচ, পলিশ করা পাথর ইত্যাদির উপর আঙুলের ছাপ তৈরী করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম dermatoglyphics। ১৮৮০ সাল থেকে গবেষণা শুরু করে ১৮৯২ সালে ইংল্যান্ডে স্যার হেমচন্দ্র বসু এবং কাজি আজিজুল হক আবিষ্কার করেন যে পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া যাবে না যার আঙ্গুলে ছাপ অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে হুবহু মিলে যাবে।

ব্যক্তি শনাক্তকরণে আঙুলের ছাপের ব্যবহারের নির্ভুলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পৃথিবীতে সর্বজন স্বীকৃত। অপরাধীদের রেকর্ড সংরক্ষণ এবং অকুস্থলে প্রাপ্ত আঙুলের ছাপ দ্বারা অপরাধীকে শনাক্তকরণে এর চেয়ে উত্তমপন্থা আর নাই। এমন কি সাম্প্রতিক বহুল কথিত ডিএনএ পদ্ধতির চেয়ে নিশ্চিত শনাক্তকরণ করে আঙুলের ছাপ।

আধুনিক যুগের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর ওপর আমরা নির্ভর করি। দলিলপত্রাদি আমাদের ব্যবসা, বাণিজ্য, সামাজিক, ব্যক্তিগত, আইনগত বিষয়ে ভূমিকা রাখে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে খুব কম দিনই আছে যে দলিল পত্রাদি ছাড়া চলে। এটি সর্বজনবিদিত যে, দলিল পত্রাদির উৎপত্তিগত অবস্থা অথবা উৎপত্তির সময় বিশুদ্ধতা, তাদের উৎস সংক্রান্ত ঘটনাবলি প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে বিশ্লেষণ কাজের উন্নয়ন করা উচিত।

‘দলিল’: দলিল বলতে বুঝায় কোনো বস্তুর ওপর অক্ষর, অংক, চিহ্ন বা উল্লিখিত একাধিক পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যক্ত বা বর্ণিত কোনো কিছুকে যা ওই বিষয়ের সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে বা হতে পারে।

এটি অপ্রাসঙ্গিক যে, কোন পদ্ধতিতে বা কোন উপাদানের ওপর উক্ত অক্ষর বা অংক গঠিত হয়েছে, অথবা তা কোনো আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে কি হবে না।

  • ব্যাংকের চেক একটি দলিল।
  • আমমোক্তারনামা একটি দলিল।

আঙুলের ছাপের আবিষ্কারের প্রাথমিক যুগে আদালত নির্ধারিত করে যে, এটি সাক্ষ্য আইনের ৯ ধারা অথবা ১১(২) ধারা অনুসারে প্রাসঙ্গিক হবে। কিন্তু আঙুলের ছাপের তুলনা করবে কেবল আদালত স্বয়ং। পরে ১৮৯৯ সনে সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে ৪৫ ধারায় “বিদেশি আইন, অথবা বিজ্ঞান বা চারুকলা প্রশ্নে বা টিপসহি সম্পর্কে পারদর্শী ব্যক্তির অভিমত প্রাসঙ্গিক। এই ধরনের ব্যক্তিকে বলে বিশারদ”। সংযুক্ত করে বিশারদের মতামত নেওয়ার বিধান করা হয়।

অপরাধ তদন্তে আঙুলের ছাপের দুই রকম প্রয়োগ হয়।

১. আটককৃত অপরাধীর পূর্ব চরিত্র অনুসন্ধান এবং সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির রেকর্ড সংরক্ষণ।

২. ঘটনাস্থলে অপরাধীর ফেলে আসা আঙুলের ছাপ দ্বারা তাকে শনাক্তকরণ।

ব্যক্তি শনাক্তকরণের সর্বোত্তম পদ্ধতি আঙুলের ছাপের তুলনা নাই। ঘটনাস্থলে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেলে এর অর্থ হলো অপরাধী ঘটনাস্থলে গিয়াছিল। আঙুলের ছাপ দ্বারা কোন ব্যক্তিকে শতভাগ নিশ্চিতরূপে শনাক্ত করা যায়। এর কারণ হলো-

(ক) দুইজন মানুষের আঙুলের ছাপ কখনো হুবহু এক রকম হতে পারে না।

(খ) আঙুলের ছাপ সারাজীবন অপরিবর্তনীয় থাকে।

(গ) প্লাষ্টিক সার্জারি বা কেটেকুটে দিলেও ছাপের পরিবর্তন করা যায় না।

(ঘ) অভিন্ন যমজের আঙুলের ছাপের মিল থাকে না। কিন্তু অভিন্ন যমজের ডিএনএ একই রকম।

দোলনা হইতে কবর পর্যন্ত কোন মানুষ এই অবিনশ্বর অপরিবর্তনীয় চিহ্ন অর্থাৎ আঙুলের ছাপ বহন করে।

Finger Prints ব্যুরোর মূল কর্তব্য

ক) শ্রেণি বিন্যাস করা, সূচি দেওয়া এবং রেকর্ডের জন্য গৃহীত F. P. slip বিন্যস্ত করা।

খ) অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত slip গুলোকে খুজে বের করা এবং ফলাফল অবহিত করা।

গ) প্রদর্শনীর ওপর গৃহীত ছাপগুলোকে আরও দৃঢ় করা এবং তুলনা করার জন্য প্রিন্ট ছাপগুলোর ছবি তোলা।

ঘ) বিরোধীয় দলিল পত্রের ওপর আঙ্গুলের ছাপগুলোর তুলনা করা।

ঙ) আঙ্গুলের ছাপ পদ্ধতির সাথে সংযুক্ত সকল কার্যাবলির পরীক্ষা করা।

চ) পিআরবি, ভলিউম-১, বিধি-৬৪৬ এর সঙ্গে সংগতি রেখে স্লিপগুলোকে বিলুপ্ত করা।

আঙ্গুলের ছাপ হাতের লেখার সাক্ষ্য মূল্য

হাতের লেখা একটি সমর্থনমূলক সাক্ষ্য। অন্যান্য সমর্থনমূলক সাক্ষ্য ছাড়া কোনো ঘটনা সন্তোষজনক ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যায় না। সাক্ষ্য আইনের যেসব ধারাগুলো হাতের লেখার সাথে সম্পর্কিত সেগুলো হলো ৪৬, ৪৭,৫১, ৫৪ ও ৭৩।

সাক্ষ্য আইনের ৭৩ ও ৪৫ ধারার আওতায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রাসঙ্গিক কতিপয় উল্লেখ্যযোগ্য সিদ্ধান্ত নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

)  50 DLR(AD)1998(88) Nurul Hoque@ Md.Nurul Hoque Vs.The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,  “বিশেষজ্ঞের মতামত বস্তুনিষ্ঠ সাক্ষ্যের অংশ নয়। প্রদর্শনী-৩ সিরিজ দলিলগুলোতে দৃশ্যমান স্বাক্ষরগুলো প্রার্থীর কিনা তা নির্ধারণের নিমিত্ত নিম্ন আদালতসমূহ নিজস্ব সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাবান”।

খ) 53 DLR(2001) 439 Shova Rani Biswash Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,  “বিশেষজ্ঞের নিকট প্রেরিত আঙ্গুলের ছাপ যেমনি আদালতের আদেশ অনুযায়ী গৃহীত হয়নি, তেমনি তা আদালতের উপস্থিতিতে গৃহীত হয়নি। এহনও ঘটনা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাজা বাতিলযোগ্য”।

গ) 53 DLR(2001) 259 Dinesh Chandra Dev vs. Dulal Chandra kormoker and Oths. মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,   “রেজিষ্ট্রী দলিল যা স্বীকৃত নয় অথবা আদালতের সন্তুষ্টি মোতাবেক প্রমাণিত নয় তার সঙ্গে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক তর্কিত স্বাক্ষর/ টিপসহি তুলনা করা যায় না”।

ঘ) 45 DLR (1993) 169 Shekh. Abul kashem Vs. Moyesh Uddin Mondol মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,  এটা সঠিক যে, আদালত স্বয়ং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজের যেকোনো স্বাক্ষর বা টিপসহি সাক্ষ্য আইনের ৭৩ ধারায় তুলনা করতে পারেন। তবে একই সঙ্গে বিশেষ করে টিপসইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহণ করা শ্রেয়তর।

ঙ) 56 DLR (2004)41 Seraj Uddin Ahamed & Oths. Vs.AKM Saiful Alam & oths. মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,  “যেহেতু স্বাক্ষর, বিশেষ করে টিপসইয়ের পরীক্ষা করার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটেছে, সেহেতু এমন পরীক্ষার বিষয়টি বিশেষজ্ঞের নিকট বা এরূপ পরীক্ষা কাজে বুৎপত্তি অর্জনকারী ব্যক্তির নিকট ছেড়ে দেয়া নিরাপদ ও বাঞ্চনীয়”।

চ) 50 DLR(AD) 1998(23) The State Vs. Raihan Ali Khondoker মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে,  “হাইকোর্ট বিভাগ সার্বিকভাবেই অবধারণ করেছে যে, হস্তলিপি ও আঙ্গুলের ছাপ বিশেষজ্ঞের অসমর্থিত মতামতের ভিত্তিতে আসামিদের সাজা দেওয়া নিরাপদ নয়”।

বিশেষজ্ঞের কাছে আলামত পাঠানোর পদ্ধতি

প্রথমত, অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা/তদন্তকারী কর্মকর্তা/প্রেরণকারী কর্মকর্তা কর্তৃক প্রেরিত পত্রে আলামতগুলো নির্দিষ্ট করতে হবে। তারপর সংশ্লিষ্ট আলামতগুলোতে শনাক্তকরণ চিহ্ন দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, কোনগুলো যথার্থ (standard) আলামত, সেগুলো উল্লেখ করতে হবে এবং সেগুলোতে শনাক্তকরণ চিহ্ন দিতে হবে।

তৃতীয়ত, আইও/ইও-র দায়িত্ব হচ্ছে, কোনগুলো নমুনা আলামত তা লিখে রাখা ও সেগুলোতে শনাক্তকরণ চিহ্ন দেওয়া।

চতুর্থত, সংশ্লিষ্ট/যথার্থ/নমুনা আলামতগুলোকে ছকের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে যেন এগুলোকে পরিষ্কারভাবে আলাদা করা যায়। আলামতগুলোকে পরীক্ষা করতে পারে এবং এ সম্পর্কে মতামত দিতে পারে এরূপ ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট থেকে ইও/আইও-কে প্রয়োজনীয় “লেটার অফ অথরিটি” সরবরাহ করতে হবে।

সুতরাং বলা যায় যে, আঙুলের ছাপ হল আঙুলের ছাপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য। যা কোন কঠিন পদার্থ আঙুলের মাধ্যমে স্পর্শ করলে সৃষ্ঠ হয়। ব্যক্তি শনাক্তকরণে আঙুলের ছাপের ব্যবহারের নির্ভুলতা ও বিশ্বাসযোগুলোর স্থান পৃথিবীতে সর্বজন স্বীকৃত। অপরাধীদের রেকর্ড সংরক্ষণ এবং অকুস্থলে প্রাপ্ত আঙুলের ছাপ দ্বারা অপরাধীকে শনাক্তকরণের উত্তমপন্থা।

লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম

তথ্য কণিকা: আইন শব্দসমূহ-এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন, সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য- গাজী মোঃ শামসুর রহমান, উইকিপিডিয়া, সাক্ষ্য আইন- বাসুদেব গাংগুলিস,সাক্ষ্য আইন- মোঃ আবুল কালাম আজাদ, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের করণীয়- বিচারপতি মোঃ আজিজুল হক, Section Wise 100 years Reference Evidence Act- Mohammed Safiqur Rahman.