চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার

আসামি না হয়েও যেতে হলো কারাগারে!

প্রতারণার মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান তিনি। নিয়ম অনুযায়ী কারাগারে বন্দীর আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। আর সেই ছাপ নিতেই দেখা গেল তিনি এই মামলার আসামিই নন। প্রকৃত আসামির নাম নবিজ উদ্দিন। তাঁর হয়ে জেল খাটতে এসেছেন যিনি, তাঁর নাম আজির উদ্দীন। স্বেচ্ছায় নবিজের হয়ে জেল খাটতে গিয়ে ধরা পড়লেন তিনি। এ যেন জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র আয়নাবাজির কাহিনি।

অন্য এক আসামির হয়ে আজির উদ্দিনের কারাগারে আসার বিষয়টি আদালতকে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। আদালতের নির্দেশে হাজির করা হয় নবিজ সেজে কারাগারে আসা আজির উদ্দীনকে। তিনি আদালতকে বলেন, চাকরির আশায় আসামি নবিজ উদ্দীনের ভাই নাজমুল হোসেনের পরামর্শে এই কাজ করেছেন।

এ ঘটনায় চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হক বাদী হয়ে গতকাল সোমবার (২৭ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বক্কর সিদ্দিকের আদালতে প্রতারণার মামলা করেন।

এতে আসামি করা হয় আজির উদ্দীন ও নবিজের ভাই নাজমুল হোসেনকে। একই সঙ্গে আজিরকে নবিজ সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানোয় আইনজীবী টি আর খানের কাছে ব্যাখ্যাও চান বিচারক মাহমুদুল হক।

আদালত সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানার বারইয়ারহাট এলাকার লোহা ব্যবসায়ী মো. জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে একটি প্রতারণা মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় আক্তার হোসেন, নাজমুল হোসেন ও নবিজ উদ্দিনকে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, জসিমের দোকানে মাল পাঠানোর কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে চার লাখ টাকা নেন আসামিরা। তদন্ত শেষে পুলিশ এই মামলায় আদালতে গত বছরের ১১ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দেয়। পরে আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন আসামি নবিজ উদ্দিন। তবে সেদিন কাগজে নবিজের নাম থাকলেও বাস্তবে গিয়েছিলেন আজির উদ্দীন।

আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে আসামিকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু চট্টগ্রাম কারাগারে যাওয়ার পর আসামির আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। সেখানে ধরা পড়ে প্রতারণার মামলায় নবিজ উদ্দীন হয়ে কারাগারে আসা বন্দী আসলে আরেকজন।

জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজে (তথ্যভান্ডার) ভোটারদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে আঙুলের ছাপে ধরা পড়েছে অনেক বন্দীর আসল পরিচয়। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে।

জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হকের আদালতে গতকাল দুপুরে হাজির হয়ে আজির উদ্দীন তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জে একটি রোলিং মিলে চাকরি করতাম। নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রামে কাজের (চাকরি) কথা বলে আমাকে নিয়ে আসেন নাজমুল হোসেন। পরে আদালতের বারান্দায় দাঁড়াতে বলেন। এরপর পুলিশ আমাকে কারাগারে নিয়ে যায়। নাজমুলের সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে। তিনি আমার জেলা কুড়িগ্রামের বালাপাড়ার বাসিন্দা।’

আরেকজনের হয়ে কারাগারে যাওয়ায় এখনই মুক্তি মিলছে না আজির উদ্দিনের। একজনের হয়ে কারাগারে যাওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হক বাদী হয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা করেছেন। এতে তাঁর সঙ্গে আসামি করা হয় নাজমুলকেও।

পরে আদালত নতুন মামলায় আজিরকে কারাগারে পাঠান। নাজমুলের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে বিচারক মাহমুদুল হক আজিরকে নবিজ সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানোয় আইনজীবী টি আর খানের কাছে ব্যাখ্যাও চান।

জানতে চাইলে টি আর খান গণমাধ্যমকে বলেন, আসামি নবিজের নামে জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি ফটোকপি আদালতে দেন তিনি। তাড়াহুড়োর মধ্যে এটি যাচাই–বাছাই করা সম্ভব হয়নি। পরে জানতে পারেন পরিচয়পত্রটি ভুয়া।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দীন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, সত্যায়িত জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো আসামির ওকালতনামা না দিতে বলা আছে। কেউ যাতে প্রতারণার সুযোগ না পান, আইনজীবীদের সে বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।