মাসদার হোসেন মামলার ঐতিহাসিক রায়ের ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত ১২ দফা নির্দেশনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো সুপ্রিম কোর্টের জন্য গঠিত হয়নি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয়। ফলে স্বাধীন ও দক্ষ বিচার ব্যবস্থার যে কাঠামো প্রত্যাশিত ছিল, তা বাস্তবে দৃশ্যমান হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে আজ রোববার (২২ জুন) রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘বিচারিক স্বাধীনতা ও দক্ষতা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সভাপতিত্ব করছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপের ওপর তথ্যচিত্র তুলে ধরা হবে সেমিনারে।
অনুষ্ঠানটির আমন্ত্রণ পত্রে বলা হয়েছে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামন ও বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফান লেলারের স্বগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হবে শুরু হবে সেমিনারের আলোচনা।
সেমিনার ঘিরে আশাবাদ
প্রধান বিচারপতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এই সেমিনার বিচার বিভাগের জন্য একটি “টার্নিং পয়েন্ট” হতে পারে। যেখানে বিচার বিভাগীয় সংস্কার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে এবং সরকারপক্ষ থেকে বড় কোনো ঘোষণা আসার সম্ভাবনাও রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ও বাস্তবতা
জুলাই অভ্যুত্থানের পর শপথ নেওয়ার পর থেকেই প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংস্কারে দৃঢ় অবস্থান নেন। ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষিত ‘বিচার বিভাগীয় রোডম্যাপ’-এ তিনি বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব দেন।
তিনি বলেছিলেন, “দ্বৈতশাসন বিলোপ করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাই হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে সংস্কারের প্রথম ধাপ।” তবে সেই রোডম্যাপ ঘোষণার পর প্রায় ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো সচিবালয় গঠন বাস্তবায়নের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
প্রস্তাবনা জমা, কাজ চলমান
সুপ্রিম কোর্টের পাবলিক রিলেশনস অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে এবং বিষয়টি বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন।
সুপ্রিম কোর্টের একাধিক বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে তৈরি ওই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রশাসনিক বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাব আর থাকছে না। ফলে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মন্তব্য করেছেন, “মাসদার হোসেন মামলার ১২ দফা নির্দেশনার বাস্তবায়ন না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেবল তখনই সম্ভব, যখন প্রশাসনিকভাবে সেটি সম্পূর্ণ আলাদা হবে। একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে প্রধান বিচারপতির অধীনে পৃথক সচিবালয় এখন সময়ের দাবি।”
পটভূমি: মাসদার হোসেন মামলার রায়
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের লক্ষ্যে ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। এরপর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয় বিচার বিভাগকে। কিন্তু এসব নির্দেশনার অধিকাংশই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। স্বাধীন সচিবালয় গঠন না হওয়ায় বিচার বিভাগের কাঠামোগত সমস্যাগুলো রয়ে গেছে, ফলে মামলাজটও বেড়েছে তিনগুণ।