শাইখ মাহদী, আইনজীবী

জরুরীভাবে প্রয়োজন একটি টেলিমেডিসিন নীতিমালা

শাইখ মাহদী:

বাংলাদেশের বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি শব্দ টেলিমেডিসিন, যার মাধ্যমে একজন চিকিৎসক রোগীর সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ ছাড়াই তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা দিতে পারছেন। চলমান লক-ডাউন পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষার অভাবে যেখানে রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ের জন্যেই হাসপাতাল-ক্লিনিকে গিয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ করা ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে রোগীদের প্রাথমিক পর্যায়ের পরামর্শ, প্রেসক্রিপশন এমনকি একটু মানসিক সাহস যোগানোর জন্যেও টেলিমেডিসিন হয়ে উঠছে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম।  এ কারনে সরকারী-বেসরকারী নানা পর্যায়ের উদ্যোগে আমরা বিভিন্ন মাত্রায় টেলিমেডিসিন কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছি। তবে এই সংক্রান্ত কোন নীতিমালা, নির্দেশনা বা প্রবিধান তথা কোন আইনগত ভিত্তি না থাকায় সম্ভাবনাময় এই সেবা খাতটিতে ঝুঁকিও বাড়ছে। আজকের আলোচনায় টেলিমেডিসিন সেবার সাথে সম্পর্কিত আইনগত ঝুঁকি এবং তা দূরীভূত করবার জন্য আইনগত বা নির্বাহী পদক্ষেপ নেবার প্রয়োজনীয়তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

প্রায়োগিক সমস্যাসমূহ ও আইনগত সীমাবদ্ধতা:

টেলিমেডিসিন সেবার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে মোবাইল ফোনভিত্তিক হটলাইন, যেখানে একজন রোগী একটি তালিকা থেকে পছন্দমত চিকিৎসককে ফোন করে তার সমস্যাগুলো বলবার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সমাধান পেতে পারেন।  আরও উন্নততর প্রযুক্তিতে বিশেষায়িত অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে ভিডিও, অনলাইন প্রেসক্রিপশন সহ নানা সেবা পাওয়া সম্ভব।  এই টেলিমেডিসিন সেবার বিনিময়ে সাধারণত এককালীন, মাসিক বা বার্ষিক হারে সাবস্ক্রিপশন ফি চার্জ করা হয়, তবে তা বিনামূল্যেও (বিশেষত সরকারী মাধ্যমে) দেয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আমরা বর্তমানে সরকারী ই–স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের পাশাপাশি একগুচ্ছ বেসরকারী টেলিমেডিসিন কোম্পানীর উত্থান ও প্রসার দেখতে পাচ্ছি।  কোভিড-১৯ এর প্রকোপে চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকগণ ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেও বিভিন্ন টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন।

এই সেবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেনসিটিভ যে বিষয়টি প্রথমেই সামনে আসে, তা হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং রোগী থেকে সংগৃহীত তথ্যের সুরক্ষা। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সম্পত্তির নাম ব্যক্তিগত তথ্য, বা পার্সোনাল ডাটা।  টেলিমেডিসিন সেবায় রোগীর কাছ থেকে তার রোগ সম্পর্কে জানবার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে অথবা চিকিৎসকের মাধ্যমে যে সকল তথ্য সংগৃহীত হয়ে থাকে, আগ্রহী ক্রেতাদের কাছে তার মূল্য ধারণাতীতভাবে বেশি।  এ কারণে, একান্ত ব্যক্তিগত এই সকল তথ্য সংরক্ষণের যথাযথ প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা এবং আইনগত সুরক্ষা না থাকলে তথ্য চুরি বা অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়ে যায়।

একই সাথে উঠে আসে পরামর্শদানকারীচিকিৎসকের প্রদত্ত প্রেসক্রিপশনের কার্যকারিতা, এবং প্রফেশনালিজম এবং ম্যালপ্র্যাকটিস সংক্রান্ত বিষয়াবলী। কোন আইনগত সীমারেখার অনুপস্থিতিতে টেলিমেডিসিন সেবায় এই বিষয়গুলো সহজেই লঙ্ঘিত হতে পারে, যে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিটি কোন সমাধান পাবেন না এবং লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও কোনরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সামনে দাঁড়াবে না।

আইনী সীমানাগুলো কোথায় প্রয়োজন:

প্রথমেই প্রয়োজন টেলিমেডিসিন গ্রাহক বা রোগীদের কাছ থেকে সংগৃহীত ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা। আমাদের দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিদ্যমান আইনগত কাঠামো (যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৬ এবং তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর অধীনে প্রণীত সংশ্লিষ্ট প্রবিধানসমূহ)গুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করে তথ্য চুরি বা অপব্যবহারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।

এর পাশাপাশি,টেলিমেডিসিন সেবাকে আইনগত স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এর সার্বিক প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এর আওতাধীনে আনাজরুরী।টেলিমেডিসিন সেবায় প্রদত্ত চিকিৎসকের অনলাইন ব্যবস্থাপত্রকেহাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে প্রদত্ত ব্যবস্থাপত্রের সমান কার্যকারিতা প্রদাণ (বিশেষত প্রেসক্রাইবড ঔষধপত্র কেনার ক্ষেত্রে), টেলিমেডিসিন সেবায় কর্মরত চিকিৎসকদের লাইসেন্স ও অন্যান্য শিক্ষাগত-পেশাগত যোগ্যতার প্রকাশ ও প্রয়োজনসাপেক্ষে তার ভেরিফিকেশন সহ আধুনিক ও কল্যাণমুখী স্বাস্থ্যসেবায় একজন চিকিৎসক হাসপাতালে সেবা প্রদাণের ক্ষেত্রে যে সকল অধিকার-কর্তব্য-নিরাপত্তার আইনী বৃত্তে আবদ্ধ ছিলেন, সেই একই বৃত্ত অনলাইন বা ভার্চুয়াল জগতেও যথাসম্ভব টানা প্রয়োজন।

একই সঙ্গে, টেলিমেডিসিনের প্রায়োগিক দিকগুলো সূচারুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে লাগসই প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিৎ।  এই সেবাকাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের (যেমন চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, প্রশাসক এবং  রোগী) আচরণবিধি, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া  সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা থাকা জরুরী।

এক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে আসতে পারে মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইনের অধীনে একটি পূর্নাংগ টেলিমেডিসিন নীতিমালা, বা প্রবিধান কিংবা প্র্যাকটিস গাইডলাইন, যাতে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো সহ টেলিমেডিসিন সেবা সংক্রান্ত নানা দিকের সংজ্ঞা ও মানদন্ডসহ একটি সামগ্রিক আইনী কাঠামো দেয়া থাকবে। মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার জরুরী ভিত্তিতে এই নির্দেশিকা/ নীতিমালা বা প্রবিধান জারী করতে পারে।  বর্তমানে মন্ত্রীপরিষদে বিবেচনাধীন খসড়াস্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনটিসংসদে পাস হলে সেখানেও টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত বিধানাবলী প্রবিধান বা নোটিফিকেশন হিসেবে অধিভুক্ত করা যেতে পারে।

এখানে উল্লেখ্য যে, সরকারী ই-স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধণের উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে যে খসড়া “ই-স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত মানদন্ডসমূহ ও বিভিন্ন ডাটাবেজসমূহের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ কাঠামোর গাইডলাইন” প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি।  যেহেতু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে টেলিমেডিসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষিত এবং প্রশংসিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এর সহায়ক আইনী কাঠামো বা নির্দেশিকা প্রণয়নেও এই ধরণের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা কেবলই সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়াবে।

টেলিমেডিসিন গাইডলাইন ও প্রতিবেশী দেশ ভারত:

প্রসঙ্গত, বিগত এক দশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের উচ্চ আদালতে টেলিমেডিসিন সেবা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে, যার মধ্যেদ্বীপ সঞ্জীব পুষ্কর বনাম মহারাষ্ট্র (২০১৮) মামলার রায়ে দুই চিকিৎসকের টেলিফোনে প্রদত্ত ভুল পরামর্শের উপর ভিত্তি করে টেলিমেডিসিন সেবার বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বোম্বে হাইকোর্ট।  এর সূত্র ধরে টেলিমেডিসিন সেবা ও এর বৈধতা সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দূর করবার জন্য ভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি জোরদার আহবান জানানো হয়, যার প্রেক্ষিতে লক-ডাউন চলাকালীন অবস্থাতেই গত ২৫ মার্চ, ২০২০ সালে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত গাইডলাইন প্রকাশ করে।  ভারতের চিকিৎসা সেবা ও আইন অঙ্গনে এই পদক্ষেপটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

শেষ কথা:

দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবাকাঠামোতে অবকাঠামোগত বা যোগাযোগব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং ফার্মা কোম্পানী ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অসুস্থ বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার প্রভাব কমিয়ে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দিতে টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রমকে আরও জোরদার করা জরুরী।  এই খাতে জরুরী ভিত্তিতে আইনী কাঠামো প্রণয়ন করবার মাধ্যমে একদিকে যেমন রোগী-চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের অধিকার ও কর্তব্য সুচিহ্নিত হবে, তেমনিভাবে তরুণ কিংবা প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাগণও এতে এগিয়ে আসবার জন্য প্রণোদিত হবে, যার ফলে বলীয়ান হবে করোনা-পরবর্তী বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশ।

লেখক- ভারটেক্স চেম্বারসে কর্মরত একজন অ্যাডভোকেট এবং ফিউচার ল ইনিশিয়েটিভ এর প্রতিষ্ঠাতা।