অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন - ফাইল ছবি

ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের রিভিউ

মো. জাকির হোসেন : 

সরকার ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ লক্ষ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠিত হয়েছে।

একটি মামলার রায় নানা কারণে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে এবং সংক্ষুব্ধ পক্ষ এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে পারে। বিচারকের ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে একটি মামলার রায় কোনো পক্ষের কাছে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। আবার কোনো মামলার রায় সঠিক হলেও কোনো পক্ষ এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে পারে। কোনো মামলার রায় তখনই ইচ্ছাকৃত ভুল হতে পারে যখন এর সঙ্গে রায়দানকারী বিচারকের অন্যায়-অবৈধ স্বার্থ ও পক্ষপাতিত্ব জড়িত থাকে। আর অনিচ্ছাকৃত ভুলের ক্ষেত্রে সাধারণত বিচারক ভ্রান্ত কিংবা বিভ্রান্তিকর যুক্তি-তর্ক বা সাক্ষ্য দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর কোনো মামলার রায় নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা, তর্কবিতর্ক হয়নি, যেমনটি হয়েছে ষোড়শ সংশোধনী মামলার ক্ষেত্রে। এ মামলার রায় ঘিরে পানি বহুদূর গড়িয়েছে। বোধ করি, বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে পানি দেশ-দেশান্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে। রায় প্রদানের আগেই এ মামলার শুনানি চলাকালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মধ্যে যে বাতচিৎ চলছিল, তখনই ধারণা করা গিয়েছিল এ রায় রাজনীতিতে উত্তাপের নতুন মাত্রা যোগ করবে।

পরীক্ষার প্রয়োজনে এবং পাঠদানের প্রয়োজনে আমি সংবিধান পড়েছি। নিজের দেশের পাশাপাশি অন্য বেশ কয়েকটি দেশের সংবিধান পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সীমিত সাংবিধানিক জ্ঞান দ্বারা এটুকু বুঝি, যে যুক্তি দ্বারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়েছে, তা সাংবিধানিক তত্ত্বগতভাবে সঠিক নয়। তাই এটি পুনর্বিবেচনার জোরালো দাবি রাখে। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায় বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় আইনের অন্যতম উৎস। বলতে গেলে সংসদ প্রণীত আইনের পরই আইনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন (রায়) হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন (রায়) অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হইবে। ’ কাজেই রায়ে কোনো বড় আইনজীবী বা সংবিধান রচয়িতা যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, তা আবেগ হিসেবে গ্রহণ করার বা তাঁদের যুক্তিকে অভ্রান্ত মনে করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা আপিল বিভাগের রায় আইন। অনেকেই হয়তো যুক্তি উত্থাপন করবেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো সংবিধান রচয়িতাসহ সব বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছেন—আমি বলছি সাংবিধানিক তত্ত্বগতভাবে সঠিক নয়। তাঁদের আমি বিনীতভাবে বলব, পৃথিবীর সব মানুষ একজোট হয়েও যদি বলে নদীর পানি দুধের নহর বা নর্দমার পানি কমলালেবুর রস, তাহলেও নদীর পানি দুধের নহর বা নর্দমার পানি কমলালেবুর রস হয়ে যায় না। উচ্চ আদালতেরও ভুল হতে পারে। তাইতো ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাঁর চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার ও রিভিউ খারিজের পরও সুবিচার নিশ্চিত করতে কিউরেটিভ পিটিশনের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। ২০০২ সালে Rupa Ashok Hurra v. Ashok Hurra and Another মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মারাত্মক কোনো ভুলের কারণে কারো প্রতি অবিচার হলে রিভিউ খারিজের পরও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ন্যায়বিচারের স্বার্থে রায়ের ভুল সংশোধনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারবে। সুপ্রিম কোর্ট এ ধরনের আবেদনের নাম দিয়েছেন কিউরেটিভ পিটিশন। কেউ কেউ একে ‘দ্বিতীয় রিভিউ পিটিশন’ বলে আখ্যায়িত করলেও এটি রিভিউ পিটিশন থেকে ভিন্ন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভারতের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রদত্ত আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের স্বার্থে রিভিউ খারিজের পরও এ ধরনের কিউরেটিভ পিটিশনের সুযোগ তৈরি করেছেন। এর পেছনে মূল দর্শন রিভিউতে উচ্চ আদালতেরও ভুল হতে পারে, ভুলের কারণে কেউ যাতে ন্যায়বিচারবঞ্চিত না হয় তাই অতিরিক্ত রক্ষাকবচ হিসেবে কিউরেটিভ পিটিশনের প্রচলন। Rupa Ashok Hurra মামলার M.S. Ahlawat (2000), Harbans Singh v. State of Uttar Pradesh (1982) and Supreme Court Bar Association v. Union of India (১৯৯৮) মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে কেউ অবিচারের শিকার হলে সংশোধনীর জন্য আবেদন করতে পারবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন। তবে Rupa Ashok Hurra মামলায় রিভিউ খারিজের পর কোন ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অনুসরণ করে কিউরেটিভ পিটিশন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হবে, তার একটা কাঠামোগত রূপ দেওয়া হয়। এ মামলায় বলা হয়, কিউরেটিভ পিটিশন আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে কিছু আবশ্যিক শর্ত পূরণ করতে হবে। শর্তগুলো হলো—এক. আবেদনকারীকে দেখাতে হবে রায়ে স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে বা সাংবিধানিক ব্যত্যয় হয়েছে; দুই. মামলার বিষয়বস্তু বা মামলার কোনো পক্ষের সঙ্গে কোনো বিচারকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিল, যা বিচারক প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং যা দ্বারা বিচারকের পক্ষপাতদুষ্টতা উপলব্ধি করা যায় এবং এর ফলে রায় দ্বারা আবেদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন; তিন. কিউরেটিভ পিটিশনের বিষয়গুলো রিভিউ আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং তা খারিজ করা হয়েছে; চার. কিউরেটিভ পিটিশনের সঙ্গে এ মর্মে একজন সিনিয়র আইনজীবীর সার্টিফিকেট যুক্ত থাকতে হবে যে কিউরেটিভ পিটিশনের যুক্তিগুলো রিভিউ পিটিশনে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং আদালত তা খারিজ করে দিয়েছেন; পাঁচ. পিটিশনটি সুপ্রিম কোর্টের তিনজন সবচেয়ে বলিষ্ঠ বিচারকের কাছে এবং যাঁরা বিচার করেছেন তাঁদের কাছে পাঠাতে হবে যদি তাঁরা কর্মরত ও লভ্য হন; ছয়. যথাযথ কারণ না থাকা সত্ত্বেও যদি পিটিশন দাখিল করা হয় সে ক্ষেত্রে আদালত আবেদনকারীর ওপর দৃষ্টান্তমূলক মোকদ্দমার ব্যয় আরোপ করতে পারবেন।

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট আজ পর্যন্ত কিউরেটিভ পিটিশনের বিষয় কোনো মামলার রায়ে উল্লেখ করেননি। এ মামলার রিভিউয়ের রায়ে আদালত যদি কিউরেটিভ পিটিশন বিষয়ে কোনো মতামত না দেন, তবে রিভিউই সর্বশেষ সুযোগ। কাজেই রিভিউ আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি সাবধানতা অবলম্বন ও মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে কিছু ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ব্যত্যয় যেমন হয়েছে, তেমনি মামলার সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতির নাজায়েজ স্বার্থ জড়িত থাকার বিষয় বারবার আলোচনায় এসেছে। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে রিভিউয়ে বিস্তারিত যুক্তি-তর্কের সুযোগ থাকা দরকার বলে সমীচীন মনে করি। এ রিভিউয়ের ক্ষেত্রে যেসব সাংবিধানিক বিষয় পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে সেগুলো হলো—এক. বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল ঘোষণা করতে পারেন। ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘…জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন ও অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইবে। ’ প্রশ্ন হলো, ষোড়শ সংশোধনী কিভাবে সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলো? যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ অসংখ্য সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের সাংবিধানিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা রয়েছে। তার মানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে প্রদান সাংবিধানিক বা তত্ত্বগতভাবে স্বাধীন বিচার বিভাগের পরিপন্থী নয় বা সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণও নয়। তাহলে বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণক্ষমতা, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত সংস্থা কর্তৃক প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে সংসদের হাতে ন্যস্তকরণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী কিভাবে সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলো? ষোড়শ সংশোধনী মূলত যে দুটি কারণে বাতিল করা হয়েছে তা হলো, এটি সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তথা সংবিধান পরিপন্থী। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলের সংসদ সদস্যরা হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের নেই। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাঁরা দলের বাইরে যেতে পারবেন না। এই সংশোধনী থাকলে বিচারপতিদের সংসদ সদস্যদের করুণাপ্রার্থী হয়ে থাকতে হবে। একটি আইনের কথা, আরেকটি আশঙ্কার। বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে প্রদান যদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী তথা সংবিধান পরিপন্থী হয়, তাহলে শত শত বছর ধরে এ বিধান পৃথিবীর উন্নত, উন্নয়নশীল, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে এবং পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিভাবে টিকে আছে? ভবিষ্যতে কোনো আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে—এ কারণে কোনো আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার এখতিয়ার সংবিধান আদালতকে প্রদান করেছে কি? ষোড়শ সংশোধনী অনুযায়ী সংসদ কি ইচ্ছাখুশি কোনো বিচারককে অপসারণ করতে পারে? উত্তর, অবশ্যই না। ষোড়শ সংশোধনীর ৯৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অসদাচরণ তদন্তে প্রমাণিত না হলে তা তো সংসদের কাছে যাবেই না। তদুপরি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সাংবিধানিকতা নিয়ে একটি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন। হাইকোর্ট যদি ৭০ অনুচ্ছেদ অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন, তখন ৭০ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের যুক্তির অবস্থান কী হবে? রাজনীতি খারাপ, সংসদ সদস্যদের মান ভালো নয়, প্রশাসন মেধাহীন, অকার্যকর গণতন্ত্র—এসব কারণে কোনো আইন অসাংবিধানিক হতে পারে কি? দুই. আধুনিক সাংবিধানিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ক্ষমতার পৃথক্করণ। ক্ষমতার পৃথক্করণ অর্থ রাষ্ট্রের সমুদয় ক্ষমতা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, সমঝোতা, জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্যের নীতির মাধ্যমে বণ্টন ও পরিচালনা। এই ধারণার মূল ভিত্তি হলো রাষ্ট্রের এক অঙ্গ অপর অঙ্গ থেকে স্বাধীন ও হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে যার যার দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু এ স্বাধীনতার অর্থ কোনোভাবেই কোনো অঙ্গের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়। তাই পৃথক্করণের পাশাপাশি ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়েছে। পৃথক্করণের মূল বক্তব্য হলো, আইন বিভাগ আইন তৈরি করবে, নির্বাহী বিভাগ সে আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করবে আর বিচার বিভাগ আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করবে। কোনো বিভাগ যাতে স্বৈরাচারী না হয়ে উঠতে পারে সে জন্য তিনটি বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাহী বিভাগ শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে যদি আইন লঙ্ঘন করে সে জন্য সংসদে তার জবাবদিহির ব্যবস্থা রয়েছে। আর বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে সম্পাদিত কাজকে বাতিল ও অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি শাস্তি প্রদানও করতে পারে। আইন বিভাগ সংবিধান পরিপন্থী কোনো আইন পাস করলে বিচার বিভাগ তা অসাংবিধানিক ঘোষণা ও বাতিল করতে পারে। বিচার বিভাগের জবাবদিহির জন্য নিম্ন আদালতের বিচারকদের উচ্চ আদালতের কাছে আর উচ্চ আদালতের বিচারকদের সংসদ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল সার্ভিস কোর্ট বা ট্রাইব্যুনাল, জুডিশিয়াল কনডাক্ট কমিশনার ও জুডিশিয়াল কনডাক্ট প্যানেলসহ নানা পদ্ধতি চালু আছে। যদি ধরে নিই, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের যুক্তি সঠিক, তাহলে প্রশ্ন হলো, সুপ্রিম কোর্ট কি সংসদের বাতিল করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংক্রান্ত আইন পুনর্বহাল করতে পারে? ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানে সংযোজন করার জন্য সংসদকে দুটি কাজ করতে হয়েছে। প্রথমত, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি বাতিল এবং দ্বিতীয়ত, ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানে সংযোজন। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিবেচ্য বিষয় ছিল ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, না অসামঞ্জস্যপূর্ণ? বাতিল করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করা কোনোভাবেই সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারের মধ্যে নয়, বরং এটি সংসদের সার্বভৌমত্ব ও সংসদের আইন প্রণয়নের কাজে হস্তক্ষেপের শামিল। সংসদের বাতিল করা আইন সুপ্রিম কোর্ট পুনর্বহাল করতে পারেন—এ নীতি গ্রহণ করা হলে তা হবে বিপজ্জনক এবং ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতির পরিপন্থী। সংসদ যদি মনে করে বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদ ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কারো কাছেই থাকবে না, বরং বিচারক অপসারণের জন্য তারা কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আইনজীবী, বিচারক বা আইনজীবী নন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে আলাদা ট্রাইব্যুনাল, কমিশন বা প্যানেল করবে, সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত সংসদের ওপর বিচার বিভাগের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত হবে নাকি? সংসদের আইন তৈরির ক্ষমতা খর্বকারী এ ধরনের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত সংবিধান সমর্থন করে কি? সুপ্রিম কোর্ট যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য উপযুক্ত মনে করেন, তবে তা পুনর্বহাল করার জন্য সংসদকে অনুরোধ করে রায় দিতে পারেন; কিন্তু আদালত নিজে সংসদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাতিল করা আইন পুনর্বহাল করতে পারেন না। তিন. অধস্তন আদালতগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ এ মামলার বিচার্য বিষয় না হওয়া সত্ত্বেও ১১৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত ক্ষমতা সংবিধান সংশোধন না করে বিচারিক রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সুপ্রিম কোর্টে নেওয়ার প্রচেষ্টা কিভাবে সংবিধানসম্মত হতে পারে? চার. সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি নির্ধারণ করার দায়িত্ব সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারকদের জন্য আচরণবিধি নির্ধারণ সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদের সরাসরি ব্যত্যয় নয় কি? কারণ রায়দানকারী সব বিচারক সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্য নন।

ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের আলোচনা-সমালোচনায় গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক, আইনগত যুক্তি-তর্ক প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক বিষয় হতে পারত। কিন্তু মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন অপ্রাসঙ্গিক, অযাচিত, অসমীচীন ও রাজনৈতিক বিষয়ের অবতারণা এবং আদালতের ভাষার পরিবর্তে ভাষার জনপ্রিয় রূপের ব্যবহার করে যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন, তাতে পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে সাংবিধানিক ও আইনগত বিতর্ক চাপা পড়েছে। সরকার যদি রিভিউ করে, তবে আদালতের সামনে সুযোগ সৃষ্টি হবে সাংবিধানিক বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করার। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত আপিল বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা অনুযায়ী আপিল বিভাগ ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনবোধে নতুন করে ষোড়শ সংশোধনীর রায় লিখতেও পারেন। ১০৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আপিল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যেকোনো মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেইরূপ নির্দেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করিতে পারিবেন। ’ আপিল বিভাগের রায় নজির হিসেবে অধস্তন আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় আইনের পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে আইন শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য পঠন-পাঠনেরও বিষয়। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউয়ের রায়ে দৃশ্যমান সাংবিধানিক ব্যত্যয়গুলো বিবেচিত না হলে এবং বর্তমান আকৃতি ও প্রকৃতিতে বহাল থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে বৈকি।

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ; E-mail : zhossain@justice.com