মাজহারুল ইসলাম

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বঞ্চিত করা প্রসঙ্গে আইন-আদালত

মাজহারুল ইসলাম :

সাম্প্রতিক প্রবণতা একদল যোগ্যতাসম্পন্ন জাতীয়, বেসরকারি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনকারীদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে বাদ দেয়া যা বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯, ১৯, ৪০, ২৭, ২৬ ও উচ্চ আদালতের সুপ্রতিষ্ঠিত বিচারিক সিদ্ধান্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যদিও এ ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন আবেদনকারীরা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অথবা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জনসহ তাদের পূর্ণ মেধা, প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞা দ্বারা সুনামের সঙ্গে জাতিকে সেবা করে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী, কিছু স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এসব যোগ্যতাসম্পন্ন আবেদনকারীদের নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ অর্থ অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকারসংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলিয়া ঘোষিত হইতে পারে, এইরূপ অন্য কোন কর্ম।’

যদিও, বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। অনুচ্ছেদটির ব্যাখ্যায় উচ্চ আদালত মতামত প্রদান করেন যে ‘নাগরিকের দেয়া সুযোগ তাদের যোগ্যতা সাপেক্ষে হতে হবে। আমাদের বিবেচনা করতে হবে সমান যোগ্যতা এবং সমান দাবির ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করা হয়েছিল কিনা’ নজরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ (৪৬ ডিএলআর)। অন্য একটি রায় অনুযায়ী ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ তাদের নিজস্ব আইন দ্বারা হলেও কোনোভাবেই তা নির্বিচারে বা খেয়াল-খুশিমতো করা যাবে না বরং তা হতে হবে নিরপেক্ষ ও আইন অনুযায়ী’ ড. মো. আলমগীর বনাম উপাচার্য, বুয়েট এবং অন্যান্য (৫৩ ডিএলআর)। আর এ কারণেই সংবিধান প্রণয়নের সময় অনুচ্ছেদ ১৯ ‘সুযোগের সমতা’, অনুচ্ছেদ ৪০ ‘পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা’ এবং অনুচ্ছেদ ২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতার বিধানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যদিকে ‘কর্মসংস্থানের সম্মান’ শব্দটি এত গভীর যে এটা আগে এবং পরবর্তী প্রাথমিক নিয়োগসহ কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সব বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত” গাজী জসিমউদ্দিন বনাম বাংলাদেশ সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সরকার (৫০ ডিএলআর)। সুতরাং, এসব তথাকথিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বৈধতা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ প্রশ্ন করতেই পারেন, কিসের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তারা তাদের ইচ্ছা এবং খেয়াল-খুশিমতো এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিনা?

উপরন্তু, অনুচ্ছেদ ২৯ অনুসারে সরকারি চাকরির সুযোগের সমতা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের আওতায় পরে ‘মৌলিক অধিকার এমন একটি অধিকার যা সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত, কোনো আইন দ্বারা তা কেড়ে নেয়া যাবে না’ জিবেন্দ্রা কিশোর বনাম পূর্ব পাকিস্তান (পিএলডি ১৯৫৭)। অন্যদিকে ‘আইনের সব ধরনের লঙ্ঘন মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন নয়, পদ ও চাকরির শর্তাবলি লঙ্ঘন আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। কিন্তু যদি একটি নির্দিষ্ট প্রতিকার সংবিধানে প্রদত্ত থাকে সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার প্রতিকারের জন্য সংবিধানকেই বেছে নেবে সাধারণ আইনকে নয়’ বাংলাদেশ ও অন্যান্য বনাম সরকার মোহাম্মদ ফারুক (৫১ ডিএলআর)। অতএব, কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের অধিকার নেই প্রজাতন্ত্রের কোনো নিয়োগ পরীক্ষার প্রক্রিয়া অংশগ্রহণ থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন আবেদনকারীদের বৈষম্য করার।

ধারা ২১(২) মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র মতে, ‘নিজ দেশের সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।’ আবার, ধারা ২৫ (গ) (আইসিসিপিআর) পুনরায় গুরুত্বারোপ করে যে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের কোনো পার্থক্য ছাড়া তার দেশের সরকারি চাকরিতে অধিকার ও সুযোগ আছে এবং দিতে হইবে।’ এ ক্ষেত্রে আমরা (আইসিসিপিআর)-এর ধারা ২৬-এর উদাহরণ টানতে পারি যেখানে উল্লেখ আছে যে, ‘সকল ব্যক্তি কোনো বৈষম্য ছাড়াই আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় অধিকারপ্রাপ্ত।’

অতএব আমরা বলতে পারি, আইনে যে কোনো বৈষম্য নিষিদ্ধ এবং সব ব্যক্তির বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমান এবং কার্যকর সুরক্ষা গ্যারান্টি আছে। এবং তা দৃঢ়ভাবে বিভিন্ন স্থানের বিচার বিভাগ দ্বারা সমর্থিত ‘কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণিকে আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, যা দ্বারা একই যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য ব্যক্তি বা শ্রেণি সুবিধা গ্রহণ করে থাকে’ জিবেন্দ্রা কিশোর বনাম পূর্ব পাকিস্তান (পিএলডি ১৯৫৭)।

অন্য একটি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘যখন একই যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে বা অন্যদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে বাদ দেয়া হয়, কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়া এবং তাদের শুনানির কোনো সুযোগ প্রদান ছাড়া তখন সেই ব্যক্তিসমষ্টিকে বৈষম্য করা হয়েছে বলে গণ্য হবে’ আবেদা বেগম ও অন্যান্য বনাম সরকারি কর্মকমিশন (১২ বিএলসি ২০০৭)।

অনুচ্ছেদ ৭(২) অনুযায়ী বাংলাদেশ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে সেই আইনের যতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটা বাতিল হবে? এ অনুচ্ছেদটির ব্যাখ্যায় আদালত অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ‘সংবিধান জনগণের ইচ্ছার পরম অভিব্যক্তি এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন কোনো ব্যক্তি এমনকি সংসদ সদস্য যদি তা লঙ্ঘন করে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার আছে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে সেসব কাজের বৈধতা যাচাই করার। আনোয়ার হোসেন খান বনাম বাংলাদেশ সংসদের স্পিকার এবং অন্যান্য (৪৭ ডিএলআর)।

অনুচ্ছেদ ২৬ বলছে ‘মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সব প্রচলিত আইন যতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন থেকে সেই সব আইনের ততটুকু বাতিল হয়ে যাবে। এবং রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন প্রণয়ন করবে না এবং এরকম কোনো আইন প্রণীত হলে তা মৌলিক অধিকারের সঙ্গে যতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটা বাতিল হয়ে যাবে। অতএব, প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি যে কোনো যোগ্য প্রার্থীকে পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগকে রহিত বা বঞ্চিত করতে পারে না তথাকথিত ভিত্তিহীন ও মনগড়া পার্থক্যের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক বিধান ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কাজের দ্বারা ।

যোগ্যতাসমপন্ন ব্যক্তিদের সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আইনিভাবেও সহজ। তথাকথিত ভিত্তিহীন, মনগড়া ও সংবিধানের মৌলিক বিধান পরিপন্থী কাজটি বন্ধের দরজাও উন্মুক্ত। অতএব, যে কোনো ব্যক্তি একটি রিট পিটিশনের মাধ্যমে বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আনতে পারেন। এমনকি ‘একজন ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে সংক্ষুব্ধ না সেও আদালতে আসতে পারে যদি তার হৃদয় কোনো বঞ্চিত সহকর্মীর জন্য কাঁদে বা কষ্ট পায় সরকারের কোনো ভুলের জন্য। সরকারের কোনো কাজ বা ভুল যখন একটি অনির্দিষ্ট সংখ্যা মানুষের মৌলিক অধিকারের উদ্বেগের কারণ হয় তখন যে কোনো ব্যক্তি সরকারের এসব কাজের জন্য উচ্চআদালতে যাওয়ার অধিকার রাখেন_ চৌধুরী মাহমুদ হাসান ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ এবং অন্যান্য (৫৪ ডিএলআর)।

এতে করে, এটি একটি সুস্পষ্ট সংকেত হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য এবং এটি সাহায্য করবে আন্তর্জাতিক কনভেনশন, প্রতিষ্ঠিত বিচারিক সিদ্ধান্ত ও সংবিধানের বিধান উপর রাষ্ট্র পরিচালনা করতে। উপরন্তু এটি যোগ্যতাসমপন্ন ব্যক্তিদের সরকারি চাকরির অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি জাতিকে সেবা করার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাও নিশ্চিত করবে।

লেখক : পিএইচডি অধ্যয়নরত, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লী, ভারত।