ছবি - কাজি ফয়েজুর রহমান

বেপরোয়া পুলিশ, ঊর্ধ্বতনরা বিব্রত নাকি স্রেফ বিচ্ছিন্ন ঘটনা?

কাজি ফয়েজুর রহমান : 

‘জঙ্গি ও মাদকের প্রতিকার, বাংলাদেশ পুলিশের অঙ্গীকার’ মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে গত সোমবার (৮ জানুয়ারি) শুরু হয়েছে পুলিশ সপ্তাহ-২০১৮। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে ২০১৭ সালে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ৩০ পুলিশ সদস্যকে ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)’, ৭১ জনকে ‘রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)’ এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামূলক আচরণের মাধ্যমে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য ২৮ পুলিশ সদস্যকে ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)-সেবা’ এবং ৫৩ জনকে ‘রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)-সেবা’ অর্থাৎ মোট ১৮২ জন পুলিশ সদস্যকে একদিকে যখন প্রধানমন্ত্রী পুরস্কৃত করছেন অন্যদিকে তখন নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন কতিপয় পুলিশ সদস্য।

গত দুই দিনে ঝিনাইদহে দুই এসআইসহ আটজন, খুলনায় পাঁচ পুলিশ কনস্টেবল, পাবনার ঈশ্বরদী রেলওয়ে (জিআরপি) থানার দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া সদ্য প্রত্যাহার করা সবচেয়ে আলোচনায় যিনি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার-ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে নানারকম অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে থাকার অভিযোগ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল বছরের শুরুতেই পুলিশের এমন বেপরোয়া আচরণে উর্ধ্বতনরা কি বিব্রত, নাকি স্রেফ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দায় এড়িয়ে যাবেন? গত দুই দিনে অনৈতিক আচরণের অভিযোগে ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেসব অপরাধের নমুনা –

ঘটনা -১

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার-ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে নানারকম অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে থাকার অভিযোগ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অস্ত্রের মুখে টিভি উপস্থাপিকা এক তরুণীকে তুলে নিয়ে বিয়ে করার অভিযোগ উঠেছে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে। ভাড়া করা ফ্ল্যাটে ৪ মাস সংসার করার পর পুলিশ কর্মকর্তার সাজানো মামলায় জেলও খাটতে হয় ওই তরুণীকে। এমনকি অপহরণপূর্বক বিয়ে আর নির্যাতনের খবর প্রকাশ করায় ওই তরুণীকে হত্যার হুমকিও দেন ডিআইজি মিজান। তরুণীর নাম মরিয়ম আক্তার ইকো।

ঘরে একাধিক স্ত্রী বহাল থাকা সত্ত্বেও একের পর এক পরকীয়ায় জড়িয়ে অনেক সম্ভ্রান্ত নারীর সর্বনাশ ঘটিয়েছেন মর্মে নানা অভিযোগ উঠেছে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে। পুলিশের এই পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

ঘটনা -২

মোবাইলে এক তরুণী রেলযাত্রীর ছবি তোলা ও তাঁর সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করার অভিযোগে পাবনার ঈশ্বরদী রেলওয়ে (জিআরপি) থানার দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাটি ঘটার পর রাতেই তাঁদের প্রত্যাহার করে সৈয়দপুর জেলা পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য হলেন সাজ্জাদ হোসেন ও অসীম কুমার।

জানা গেছে, মঙ্গলবার বিকেলে ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সাদা পোশাকে থাকা ওই দুই পুলিশ সদস্য এক তরুণী যাত্রীকে উত্ত্যক্ত ও অশ্লীল ইশারা করছিলেন। ওই তরুণী তাঁর মা ও ভাইকে নিয়ে ঈশ্বরদী স্টেশনে তখন ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন। সন্ধ্যায় ট্রেন আসলে ওই তরুণী তাঁর মা ও ভাইকে নিয়ে ট্রেনের কামরায় বসেন। এরপর ওই দুই পুলিশ সদস্য ট্রেনের কামরায় ঢুকে মুঠোফোন তরুণীর ছবি ধারণ করেন।

ঘটনা- ৩

খুলনায় স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত ও ভাইকে মারধরের অভিযোগ ওঠার পর পাঁচ পুলিশ কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বটিয়াঘাটা থানার সেই পাঁচ কনস্টেবল হলেন, মো. নাঈম, মামুন, রিয়াজ, আবির ও জাহিদ।

জানা গেছে, মঙ্গলবার উপজেলার খারাবাদ বাইনতলা কলেজিয়েট স্কুলের এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত এবং তার ভাইকে মারধরের অভিযোগ উঠে কনস্টেবল নাঈমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার পর ওই পাঁচজনকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে যুক্ত করা হয়েছে।

ঘটনা -৪

দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে ঝিনাইদহে দুই এসআইসহ আটজন পুলিশ সদস্যকে গতকাল মঙ্গলবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। আটজন পুলিশ সদস্য হলেন- মহেশপুর থানার এসআই আনিসুর রহমান, নাজমুল হক কনস্টেবল আব্দুল গাফ্ফার, ইমরান হোসেন, মনিরুজ্জামান, এরশাদ আলি, ওলিয়ার রহমান ও আসাদুল হক।

জানা গেছে, গত ৪ জানুয়ারি রাতে মহেশপুরের পুরন্দপুরে ঢাকা থেকে আসা সোনারতরী পরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৭ জানুয়ারি এসআই আনিসুর অজ্ঞাত ৭/৮ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এ বিষয়ে তদন্তের পর দায়িত্বে অবহেলায় ওই প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে যুক্ত করা হয়েছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো দেখুন – দায়িত্ব অবহেলা, স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত ও অভিযোগ করায় ভাইকে মারধর, মোবাইলে এক তরুণী রেলযাত্রীর ছবি তোলা ও তাঁর সঙ্গে অশ্লীল আচরণ এবং সবচেয়ে আলোচিত তরুণীকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে! সিনিয়র পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা এমন বেপরোয়া হলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? এ রকম একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্র ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র যদি জঘন্য পর্যায়ে চলে আসে তাহলে তো ধরে নিতে হবে তার নিয়ন্ত্রণকারী কেউ নেই।

একদিকে আশার কথা হল তুলনামূলক অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে ডাকাতি, খুন, নারী নির্যাতন, অপহরণের মতো অপরাধের ঘটনার হার কমেছে। তবে খোদ পুলিশ সদস্যদের অপরাধ কতটা কমেছে সেই হিসেব কি আছে? এদেশে খুব বেশি অপরাধী পুলিশের সাজা হয়েছে বলে মনে হয়না। তবে হ্যাঁ, অভিযোগ উঠার পর সাময়িক প্রত্যাহারের সংখ্যা হয়তো দেশের মোট পুলিশের সংখ্যার কাছাকাছি হবে! সম্ভবত অপরাধী পুলিশের লঘু শাস্তিই অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পুলিশের এমন নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মের লাগাম টানতে না পারলে জনগণের স্বস্তি ও শান্তিতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বৃন্দাবনে কুরিয়ার করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কেননা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার দায় যাদের হাতে ন্যস্ত তারাই যদি আইনবহির্ভূত কাজে লিপ্ত হয় তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?

লেখক : সহকারী সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম